কেমন আছেন শাটল রাজ্যের বাসিন্দারা

শাটল শব্দটি শুনলেই মাথায় আসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। একসময় যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকো বিশ্ববিদ্যালয়ে সার্ভিসটি চালু হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু রয়েছে ঐতিহ্যবাহী শাটল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গর্বের একটা বিশাল জায়গাজুড়েও রয়েছে শাটলের অবস্থান। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে মুখ থুবড়ে পড়েছে জনজীবন।

স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে পুরো বিশ্ব। এই যখন অবস্থা, তখন কেমন আছেন ২ হাজার ১০০ একরের বাসিন্দারা? কীভাবে কাটছে তাঁদের দিনগুলো?

খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পার করতে হতো ব্যস্ত সময়। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রতিনিয়ত ছুটতে হতো তাঁদের। দিনের শুরুটা হতো ডিপার্টমেন্টের স্যারের লেকচার শোনা দিয়ে। তারপর সেখান থেকে মুক্তি মিললেই প্রিয় ঝুপড়ি বা টং দোকানে বসে আড্ডা আর তার ফাঁকে ভর্তা-ভাত হজম করে তৃপ্তির ঢেকুর তোলা। এরপর সূর্যের তেজ একটু কমতে না কমতেই টিউশনির উদ্দেশে বেরিয়ে পড়া। বেশির ভাগ সময়েই শাটল ট্রেনে গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে কিংবা বাদুড়ঝোলা হয়ে এসব শিক্ষার্থীকে ছুটে চলতে হতো শহরের বুকে। আর এটি শহরের বাইরে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশনি করে চলা প্রতিটি শিক্ষার্থীর জীবনের নিত্যদিনের গল্প। এরপরের কাহিনি সবারই কম-বেশি জানা। রাতের আঁধারে প্রিয় ক্যাম্পাসে ফেরা এই মানুষগুলোই মজে যায় কোনো এক আড্ডায় অথবা হারিয়ে যায় গিটারের সুরে, অর্জন করে একগাদা মানসিক প্রশান্তি। এভাবে রাত যায়, দিন আসে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কেটে যেতে থাকে ক্যাম্পাসিয়ানদের ব্যস্ত জীবন।

কিন্তু হঠাৎ করে এ চক্রে আপত্তি জানিয়ে বসে করোনা নামক মহামারি। প্রতিটি শিক্ষার্থী যেখানে ব্যস্ত সময় কাটাতে অভ্যস্ত, সেখানে নিতান্ত অলস সময় কাটাতে হচ্ছে তাঁদের। মহামারির নির্মম বাস্তবতা পাল্টে দিয়েছে তাঁদের জীবনযাপনের সংজ্ঞা। অথচ দেখা যায়, এসব শিক্ষার্থীর মধ্যে অনেকের কিছুদিন পরে ছিল স্নাতকোত্তরের ফাইনাল পরীক্ষা। পড়ালেখা শেষ করামাত্র পরিবারের হাল ধরবেন, নিজের মধ্যে তিল তিল করে লালন করা এমন স্বপ্নগুলোও ফিকে হয়ে গেছে করোনা বাস্তবতার কাছে। আবার অনেকে শত চড়াই-উতরাই পেরিয়ে মাত্র প্রবেশ করেছিল নিজের স্বপ্নরাজ্যে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রঙিন জীবনের স্বাদ গ্রহণ করতে না পারলেও করোনার বিষাক্ততার স্বাদ তাঁরা ঠিকই কড়ায়-গন্ডায় উপলব্ধি করতে পেরেছেন। করোনার আঘাতে থমকে গেছে তাঁদের পৃথিবী।

তার ওপর সেশনজটের আশঙ্কা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে উপস্থিত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজারো শিক্ষার্থীর জীবনে। সেশনজটের ভাবনা নিয়মিত ভাবিয়ে তুলছে তাঁদের। এসব নেতিবাচক চিন্তা একদিকে যেমন তাঁদের মনে ভীতির জন্ম দিচ্ছে, অন্যদিকে তাঁদের করে দিচ্ছে মানসিকভাবে পঙ্গু। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের চিন্তায় হতাশায় ডুবে আছে হাজারো প্রাণ। বিশেষ করে, টিউশনি করে চলা শিক্ষার্থীদের চোখেমুখে এখন রাজ্যের দুশ্চিন্তা। করোনাকালীন আপদে এঁরাই বোধ হয় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। পড়ালেখার পাশাপাশি বন্ধ হয়েছে তাঁদের রুটি-রুজির একমাত্র অবলম্বন। স্বয়ং ভাগ্যদেবতা যেন তাঁদের ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। ফলে টিউশনিনির্ভর পরিবারগুলো পড়েছে চরম ভোগান্তিতে। এখন আর তাঁদের মাসের প্রথম দিনগুলোর আশায় অপেক্ষার প্রহর গুনতে দেখা যায় না। হয়তো মাস শেষে ছেলের পাঠানো এই টাকাতেই চলত অসুস্থ বাবা-মায়ের চিকিৎসা কিংবা ছোট ভাই-বোনের লেখাপড়ার খরচ, পূরণ হতো তাদের নিত্যনতুন শখ-আহ্লাদ।

এই নাজুক অবস্থাতে বাড়তি চাপ হিসেবে যুক্ত হয়েছে মেস বা হোস্টেলভাড়া। একমাত্র অবলম্বন টিউশনি হারিয়ে শিক্ষার্থীসমাজ যখন কোণঠাসা, তখন মেস বা হোস্টেলভাড়ার জন্য বাড়িওয়ালা কর্তৃক চাপ তাঁদের করছে দিশেহারা। তাঁরা নিজেরাও জানেন না, এখন তাঁদের কী করা উচিত। কীভাবে তাঁরা এ সমস্যা থেকে নিস্তার পাবেন। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে হতাশার অতল গভীরে ডুবে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তাঁরা।

বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া এসব শিক্ষার্থীর পাশে প্রশাসনকে এখনই দাঁড়াতে হবে, কাঁধে হাত দিয়ে তাঁদের ভরসা জোগাতে হবে, মেটাতে হবে তাঁদের অভাব-অভিযোগ, পূরণ করতে হবে তাঁদের আবদার, আশ্বাস দিতে হবে যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে পাশে থাকার। তাহলে তাঁরা পারবেন নির্ভয়ে স্বপ্নের বীজ বপন করতে, দেখতে পারবেন স্বপ্নকে তিল তিল করে গড়ে তোলার সৎ সাহস। নতুবা, করোনার তীব্র আগ্রাসনের সামনে খেই হারিয়ে ফেলবেন এসব স্বপ্নবাজের দল, অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যাবে তাঁদের দেখা স্বপ্ন, যা আমাদের জন্য মোটেও কল্যাণকর হবে না।

* লেখক: শিক্ষার্থী, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। পশ্চিম গাড়াখোলা, মধুখালী, ফরিদপুর