শৈশবের বৈচিত্র্যময় শিক্ষায় অশনিসংকেত

বাসার অন্য একটি কক্ষে পড়ার টেবিল। প্রায় দিনই পড়ার বইগুলো অগোছালো দেখতে পেতাম। প্রতিদিন পড়ার জন্য হয়তো প্রতিদিন গোছানো সম্ভবপর হয়ে উঠত না। অগোছালো টেবিলটা দেখতেও মন্দ হতো না।

পড়ায় অনেক দিন ধরে তেমন মন বসাতে পারছে না আমাদের অনিরুদ্ধ। তাই হয়তো বইগুলো তেমন নাড়াচাড়া করা হয় না। আগের অগোছালো টেবিলটা আর চোখে পড়ে না। দু–একটা বই হাতে নিয়ে আবারও গুছিয়ে রেখে দেওয়া হয়। কী যেন অগোছালো ভাবখানাই চলে গেছে। ওখানে অগোছানোর মাঝেও একটা শিল্প কাজ করত। আজ হয়তো গোছানো বইগুলোর মাঝে শিল্পটুকুর অপর্যাপ্ততাই বিদ্যমান থেকে যায়। খাতাগুলোর পাতা কেমন যেন খসখসে হয়ে আছে। খাতায় পুরোনো লেখাগুলোর কালি লেপ্টে মলিনতার ছাপ রেখে গেছে। কয়েকটা বই মাকড়সার জালে বন্দী হয়ে আছে। কলমদানিতে কলমগুলো একপেশে থেকে কালি শুকিয়ে আসছে। সবকিছু মিলিয়ে পড়াশোনার আভাসে শূন্যতা বিরাজ করছে।

সকালের স্নিগ্ধতায় মোড়ানো ভোরের সোনালি সূর্য এসে মনকে রাঙাতে পারে না। নিস্তব্ধতায় আঁধার বারবার ধেয়ে আসে শিশুদের মনে। পরিবেশটাও কেমন যেন আজ মলিনতায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। মনের মধ্যে জেগে থাকা তাদের ঈপ্সিত স্বপ্নগুলো স্তিমিত হয়ে আসে। এখন হয়তো সকালে ঘুম থেকে ওঠার জন্য অ্যালার্ম ঘড়িটা কাছে রাখতে হয় না। তাড়াতাড়ি ঘুমাতে গেলেও মনে ছন্দ ফেরে না।

অনেকটা দিন চলে গেল মহামারির প্রকোপে শিশুদের প্রিয় বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে আছে। রহস্যভেদ আঁকড়ে প্রাণের তরে জেগে ওঠেনি জাগরণের প্রতিধ্বনি। প্রিয় শিক্ষকের শ্রুতিমধুর কণ্ঠে ফিরে পায় না স্নিগ্ধতায় মুখর দিনগুলো। ব্যাগের মাঝে বইগুলো নিয়ে এখন আর স্কুলের উদ্দেশে গমন করতে হয় না। পাঠ চুকিয়ে বাড়িতেই অবস্থান করতে হচ্ছে। সকালবেলা আধো আধো ঘুম নিয়ে মনের মাঝে ভেসে আসে প্রিয় বিদ্যাপীঠের অবয়ব। হয়তো কেউ কেউ আনমনা হৃদয়ে বারবার ঘুম থেকে জেগে সহসাই ধায়—স্কুলে যেতে পারব তো?

স্কুল বন্ধ থাকায় তাদের শিক্ষা কিংবা শারীরিক দিক দিয়ে বলীয়ান হওয়ার কথা নয়। বিদ্যালয়ের আঙিনা শিশুদের জন্য শুধু লেখাপড়ার মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। শিশুরা একে অন্যকে দেখে নতুন কিছু ভাবতে শেখে কিংবা নতুন কিছু তৈরি করার প্রবণতা তৈরি হয়। সেটা হতে পারে খেলাধুলার মাঝে, গল্পের মধ্য দিয়ে, আর্ট শেখার মাঝে কিংবা গানের ক্লাস বা নাচের ক্লাসের মাধ্যমে। সে জন্যই খেলাধুলার প্রতি প্রবল আকর্ষণের দরুণ কিংবা বন্ধুবান্ধবের কাছে পাওয়ার আশায় তাদের স্কুলের প্রতি অনেক বেশি আগ্রহ বিদ্যমান থাকে। আনন্দ আছে বলেই উৎসাহ টেনে নিয়ে যায়। আনন্দের সহিত হয়তো শিক্ষাদান করা হয়ে থাকে, সে জন্য ক্লাসে উপস্থিত হওয়া আনন্দদায়ক মনে করে। সেখানে পড়ালেখার পাশাপাশি মনোবিকাশের সময়টুকু পর্যাপ্ত পরিমাণে পেয়ে থাকে। তাদের বুদ্ধির প্রকৃত বিকাশ ঘটে থাকে।

গ্রামের পাঠশালায় শিশুরা দল বেঁধে স্কুলে যেতে পছন্দ করে, হইহুল্লোড়ে মেতে ওঠে বলে আনন্দটুকু আরও বেড়ে যায়। মহামারির দরুন শঙ্কিতচিত্তে তাদের সেটা উপভোগ্য হয়ে ওঠে না। ফলে তাদের আচরণগত দিক কিংবা মানসিক দিক দিয়ে অনেকভাবে পরিবর্তন আসতে পারে। অকারণে জেদ ধরে বসে কান্নাকাটি করতে পারে। ঘরে বন্দী থেকে মোবাইলের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সময় পার করতে চাইবে, যা মনোবিকাশে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আবার মহামারির কারণে পরিবারে অন্যদের দুশ্চিন্তা শিশুরা আঁচ করতে পারে বলে তাদের মাঝে একধরনের উৎকণ্ঠা দেখা দিতে পারে। এতে শিশুদের মাঝে নেতিবাচক প্রবণতা তৈরি করতে পারে।

তা ছাড়া ভাষাজ্ঞান মাধুর্যতার জন্য সে সময়কাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময় হিসেবে বিবেচ্য। যদি বিদ্যালয় এভাবে অনেক দিন বন্ধ থাকে, তবে বিদ্যালয়ে সুষ্ঠু অর্জনের অবয়বটুকুর মাঝে আস্তে আস্তে বিভাজন সৃষ্টি হবে। লেখাপড়ায় শিশুদের মনোনিবেশ ঘটানো কঠিন হবে। পূর্ণোদ্যমে ফিরে পাবে না তাদের স্তিমিত গতিধারার আসল রূপ। স্ফুরণ ঘটাতে পারবে না তাদের মাঝে জেগে থাকা সুপ্ত বাসনাগুলো। ইউনেসকোর তথ্যমতে, মহামারির নেতিবাচক প্রভাবের কারণে গত এপ্রিল মাস থেকে বিশ্বব্যাপী ১৬০ কোটি শিশু স্কুল ও কলেজের বাইরে আছে, যা মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ৯০ শতাংশ।

স্কুল বন্ধ থাকায় পরম মমতায় কেউ আর হাত বুলিয়ে শিক্ষার আলোয় স্পন্দিত করার চেষ্টা করে না। শিক্ষার ছন্দটুকু হারিয়ে যাওয়ার ভাবনায় বারবার তাড়িত করে। খোঁজে পায় না স্তিমিত হয়ে যাওয়ার কারণ। মাঝেমধ্যে দুগাল হেসে শুনতে চায় প্রিয় বন্ধুদের কথন।

অনেক দিন হয়ে গেল প্রিয় বিদ্যালয়ের আঙিনায় শিশুদের যাওয়া হয় না! কখন যে আবার প্রাণোচ্ছল ভরে আনন্দে মেতে উঠবে প্রাণের বিদ্যালয়ে, আঁচ করতে পারে না। হয়তো বিদ্যালয়ের মাঠেও আগের মতো ছন্দ নিয়ে কেউ খেলতে আসে না কিংবা ক্লাস শুরুর আগে সবাই হইহুল্লোড়ে মেতে ওঠে না। সবটুকু মিলিয়ে স্তিমিত হয়ে আসে বন্ধুদের সঙ্গে আলাপন। যেন প্রাণোচ্ছল শৈশবের গতিধারা থেকে তারা অনেকটা আনমনা ভাব নিয়ে ভাবনায় দিন পার করছে। নিজেদের রঙে রাঙিয়ে কখনো কাউকে ডাক দিতে আসে না। হয়তো খেলাধুলা নেই বলে বিদ্যালয়ের মাঠটি নিস্তব্ধতায় ছেয়ে আছে। বিচিত্রতায় ভরপুর শৈশবকে হঠাৎ হারাতে বসে কারও হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে আসছে। শৈশবখানি যেন একপেশে হয়ে আসছে। ভাবনায় এসে জানান দিয়ে যায় অগোছালো মনের শঙ্কিত হাওয়ায়। সুন্দর সম্ভাবনার সীমানাটাই ক্ষীণ হয়েই ধরা দেয়। তাই কবিগুরুর ভাষায় বলতে ইচ্ছে করে,

আজ আমি লুকিয়েছি মা পুঁথিপত্তর যত,
পড়ার কথা আজ বল না যখন বাবার মত।
বড় হব তখন আমি পড়ব প্রথম পাঠ
আজ বলো মা কোথায় আছে তেপান্তরের মাঠ।

সত্যিই যদি লেখাপড়া থেকে অবকাশ পেয়ে যেত মন্দ হতো না। কিন্তু এ অবকাশ যে অনেক লম্বা, অনেক দূরত্বের। তাতে কি আর শখের চূড়া নেমে আসে? স্থিততা সেখানে ফিরে আসে না।

কিন্তু মহামারির কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় ঘরে বন্দিদশার মাঝে তাদের মুখের হাসিটুকু ম্লান হয়ে আসে। তারা অনেকেই বুঝতে পারে না তাদের প্রিয় বিদ্যালয়টিতে অনেক দিন ধরে যেতে পারছে না। আঁচ করতে পারছে না দেশের সামগ্রিক জীবনধারা। সে জন্য মাঝেমধ্যে অবুঝ মনে খোঁজে ফিরে প্রিয় পাঠশালার প্রিয় আঙিনা। বলতে গেলে স্বাভাবিক জীবনের স্নিগ্ধ পরশটুকু নিতে পারছে না।

আবার, আর্থিক পরিস্থিতি বিবেচনাপূর্বক অনেক শিশু বিভিন্ন পেশায় জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। পরিবারের উপার্জনের লক্ষ্যে কাজ করবে। এতে শিক্ষাক্ষেত্র থেকে ঝরে পড়ার আশঙ্কা বেড়ে যাবে।

শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা সেভ দ্য চিলড্রেনের এক তথ্যমতে, ‘মহামারির কারণে বিশ্বজুড়ে প্রায় এক কোটি শিশু চিরদিনের মতো শিক্ষার সুযোগ হারাবে’! সংস্থাটির মতে, যে ২৮টি দেশে শিশুরা স্কুল থেকে ঝরে পড়ার উচ্চ বা মাঝারি ঝুঁকিতে রয়েছে, বাংলাদেশ সেগুলোর মধ্যে অন্যতম।

আশার কথা হলো যে এই ক্রান্তিকালীন কোনো ছাত্রকে দেখিনি এক ঝাপটা বইয়ের বোঝা বইয়ে যেতে। কিংবা তাদের অভিভাবক কর্তৃক সটান হয়ে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে যেতে। ছাত্ররা এখন প্রাইভেটের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়েছে। এখন অভিভাবকদের সাহায্যেই পড়া তৈরি করতে পারে কিংবা নিজেই গুছিয়ে নিতে শিখে গেছে। কোচিং সেন্টারগুলোতেও এখন আর ভিড় নেই। পড়ালেখার জন্য এতটুকু মানসিক চাপ অনুভব করে না।

মহামারির যাতনার মাঝেই হয়তো আস্তে আস্তে বছরটি শেষ হয়ে আসবে। হয়তো বইয়ের ভেতর কলম দিয়ে দাগানো প্রিয় শব্দগুলো বারবার খুঁজে ফিরবে শিশুরা! পুরাতন বইয়ে মলিনতায় ভরপুর পাতাগুলো উল্টিয়ে খোঁজে নিতে চাইবে প্রাণের মমত্ববোধ। তারই মাঝে হয়তো নতুন বছর শুরু হবে। আবারও হয়তো নতুন বই আসবে, পাতাগুলো উল্টিয়ে মনের ভেতরটাকে আরও বেদনায় পর্যবসিত করবে পুরোনো বইয়ের দুঃসহ যাতনায়!

মাঝেমধ্যে হয়তো নতুন বইয়ের মাঝে পুরোনো বইয়ের গন্ধটুকু খুঁজে নেওয়ার বৃথা চেষ্টা করবে! কিন্তু পড়ার মাঝে পুরোনো বইয়ের সঙ্গে যে মেলবন্ধন রচিত হয়েছিল, নতুন বইয়ের ধারায় তার সীমানা কোথাও খুঁজে পাবে না।

এভাবেই হয়তো ঘোর অমানিশা কেটে গিয়ে আস্তে আস্তে আলো ফিরে আসবে। আবারও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেবে, কোমলমতি শিশুদের ক্লাসে দেখা যাবে পূর্ণোদ্যমে। থাকবে না তাদের মাঝে মলিনতার ছাপ। তাড়া করবে না তাদের অগোছালো দিনগুলোর জন্য। আবারও শিশুদের জানান দেবে ছন্দময় জীবনের সুন্দর মুহূর্তটুকু।

লেখক: ব্যাংক কর্মকর্তা ও লেখক। [email protected]