বানভাসিদের জীবন

ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে খুশি কিন্তু সিরাজগঞ্জের বানভাসি মানুষের কাছে ঈদ বিষাদে মোড়ানো কষ্টে জড়ানো ক্ষতবিক্ষত কয়েক ঘণ্টার সমষ্টি ছাড়া কিছু নয়। যেখানে এক বেলা খাবারের নিশ্চয়তা নেই, সেখানে ঈদ তো অমাবস্যার চাঁদ ছাড়া কিছু নয়।

এক মাস আগেও সব ঠিক চলছিল। গোয়ালে গরু ছিল, গোলায় ধান ছিল, পুকুরে মাছ ছিল, খেতে ফসল ছিল—সর্বোপরি সংসারে সুখ ছিল। অনেকে আবার কোরবানি দেওয়ার প্রস্তুতি শুরু করেছিলেন। কিন্তু পানি আসার সঙ্গে সঙ্গে ঈদের সব আয়োজন ভেসে গেছে। বানের জলে ঢাকা ফসলের মাঠ! রাস্তায় পানি, ঘরে পানি, উঠানে পানি। তা ছাড়া যেদিকে চোখ যায় পানি আর পানি। পানির জন্য কেউ আশ্রয় নিয়েছে ঘরের চালে, কেউ রেললাইনে, আবার কেউ স্কুলের ছাদে। অনেকের বসতভিটাও নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। বেঁচে থাকার শেষ সম্বলটুকু অবশিষ্ট নেই।

শুধু আশ্রয় থাকলেই হয় না। খাবার কেনা বা সন্ধানে বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়। চলাচলের জন্য নৌকা ছাড়া গতি নেই কিন্তু সবার তো নৌকা কেনার সামর্থ্য নেই। তাই কলাগাছের ভেলায় সীমিত আকারে চলাচলের ব্যবস্থা করেছে কেউ কেউ। কাদামাটি আর পানিতে থাকতে থাকতে অধিকাংশ মানুষের হাতে পায়ে স্যাঁতসেঁতে ঘা।

এর মধ্যে ঘটে যাচ্ছে মর্মান্তিক অনেক ট্র্যাজেডি। বাড়ি ভেঙে গেছে যমুনায়, গবাদিপশু ভেসে গেছে পানিতে, সাতটা বোনের একটা ভাই জলে ডুবে পরপারে চলে গেছে! প্রিয়জনকে সমাহিত করার সামন্য উঁচু জায়গা অবশিষ্ট নেই!

করোনার প্রাদুর্ভাব আর লকডাউনে গ্রামীণ অর্থনীতি অনেকটা স্থবির। অনেক কর্মহীন শহরের মানুষ স্থায়ীভাবে গ্রামে ফিরে আসছে আর গ্রামের মানুষ সহায়সম্বলহীন হয়ে অথই জলে অনাহারে–অর্ধাহারে লম্বা সময় ধরে ভাসছে। এর আগে এতটা লম্বা সময় বন্যা দেখা যায়নি।

খাবারের অভাব, বিশুদ্ধ পানির অভাব, ঘুমানোর জায়গা নেই। চারদিকে বিষাক্ত সাপ-পোকামাকড়ের আনাগোনায় জীবন হাতের মুঠোয়। তারপর আছে করোনার ভয়।

কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে বেঁচে থাকার অদম্য লড়াই করে যাচ্ছে বানভাসি মানুষেরা। ইতিমধ্যে পানি কমতে শুরু করেছে। কৃষক আবার বীজতলা তৈরি করবে, মাঠে ফসল ফলাবে, পুকুরে মাছ ছাড়বে, ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাবে। সবুজে সবুজে, শস্য শ্যামলে ভরে উঠবে ফসলের মাঠ। মানুষ আবার ঘুরে দাঁড়াবে।

জীবন তো টিকে থাকার লড়াই ছাড়া কিছু নয়।