করোনা-পরবর্তী অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জে কি প্রস্তুত বাংলাদেশ

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

করোনাভাইরাসের প্রভাব জাতীয় অর্থনীতিতে কতটুকু আশঙ্কার বিষয়, তা এখনই পুরোদমে পরিমাপ করা সম্ভব নয়। তবে ধারণা করা হচ্ছে, অতি দ্রুত আমরা অর্থনৈতিক মন্দার সম্মুখীন হচ্ছি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ভাষ্য অনুযায়ী, ১৯৩০ সালের অর্থনৈতিক মহামন্দা-পরবর্তী বিশ্বে এই প্রথম আবারও আমরা আরেকটি মহামন্দার সম্মুখীন হতে যাচ্ছি। শুধু বাংলাদেশ পরিমণ্ডলে নয়, বহির্বিশ্বকে সামনে অত্যন্ত কঠিন এক অর্থনৈতিক মন্দার মধ্য দিয়ে যেতে হবে।

তবে সৌভাগ্যের বিষয়, বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে দুভাবে ভাগ করা যায়। একটি হলো কৃষি খাত, অন্যটি হলো অকৃষি খাত। কৃষি খাতকে বলা হয় দেশের শিকড় কাঠামো এবং অকৃষি খাতকে বলা হয় দেশের স্বাস্থ্য কাঠামো। এখন দেশে কৃষি খাতের অবস্থা কী? আমরা জানি, কৃষি খাতের প্রধান ফসলগুলো হচ্ছে ধান, গম, পাট ও ভুট্টা। কিন্তু এই ফসলগুলোর উৎপাদন ব্যাহত হয়নি বরং তা আগের থেকে ভালোই উৎপাদন হয়েছে। আবার অন্যদিকে করোনাকালে কিছু ক্ষেত্র যেমন: হাঁস-মুরগির খামার, মৎস্য চাষ, দুধ উৎপাদন ও শাকসবজি চাষ প্রভৃতি ক্ষেত্রে ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে, যা অনেকাংশে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক সময়ে অবসরকালীন কিছু শিক্ষার্থীর মাধ্যমে সম্ভব হয়েছে। মোট কৃষি খাতের ২-৩ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

২০১৮ সালের সর্বশেষ জিডিপির তথ্য অনুযায়ী, কৃষি খাতের অবদান ১৩.০৭ শতাংশ, শিল্প খাতে ২৮.৫৪ শতাংশ এবং পরিষেবা খাতে ৫২.৯৬ শতাংশ। কৃষি খাতের অবদান এত কম হওয়া সত্ত্বেও এটিকে দেশের জাতীয় অর্থনীতির মেরুদণ্ড বলা হয়। কারণ শিল্প কিংবা পরিষেবা খাতের কোনো পণ্য বর্তমান বাজারে সরবরাহ কম থাকলেও তা বাজার অস্থিতিশীল করে না কিন্তু কৃষি পণ্য বাজারে সরবরাহ কম থাকলে তা অতি দ্রুত বাজার অস্থিতিশীল করে দেয়। যেটা সম্প্রতি আমরা পেঁয়াজ সরবরাহ ঘাটতির সময় দেখেছি। আবার শিল্প খাত যদিও মোট জিডিপির ২৮.৫৪ শতাংশ, কিন্তু সে ক্ষেত্রে দেখা যায় ৩০-১০০ শতাংশ উৎপাদন অব্যাহত ছিল। যেমন- ওষুধ শিল্প উৎপাদন এই মহামারির সময়ে বেশ অগ্রগামী। তবে অত্যন্ত ঝুঁকিতে আছে পরিষেবা খাত কিন্তু এই খাতের মধ্যে সবচেয়ে ভালো ব্যবসা করেছে হাসপাতাল ও ক্লিনিক খাতগুলো। আবার অনেক চিকিৎসক চেম্বারেও আসেননি। সেই সঙ্গে এই পরিষেবা খাতের অন্য অংশগুলো যেমন: বহুজাতিক কোম্পানি, ব্র্যাক, আরডিআরএস প্রভৃতি বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চা-শিল্প, পাটশিল্প, চামড়াশিল্প, মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, পরিবহন খাত সীমিত আকারে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষ করে এসব শিল্পের ওপর নির্ভরশীল উপখাতগুলো মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এখন আসি বাংলাদেশের অর্থনীতির ক্ষুদ্র অংশ যদি কৃষি খাত হয়, তাহলে তা দিয়ে কি পুরো দেশের অর্থনীতিকে মূল্যায়ন করা যায়?
উত্তর: হ্যাঁ, যায়।

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

এ খাতের মোট কর্মসংস্থান হয় ৩২ শতাংশ। দেশের খাদ্য উৎপাদন ইনডেক্স হচ্ছে ১৩৮ অর্থাৎ আবাদি জমির তুলনায় প্রায় দেড় গুণ। ইতিমধ্যে অনেক অর্থকরী ফসল যেমন কমলালেবু, মাল্টা, পেয়ারা ও বাতাবিলেবু পর্যন্ত দেশে ব্যাপকভাবে চাষ শুরু হয়েছে। তাই দেশের অর্থনীতি যতই ছোট হোক না কেন, তা হচ্ছে ভোগ অর্থনীতি। যা অত্যন্ত দুর্ভিক্ষকে হারাতে পারে। সুতরাং, বাংলাদেশ সরকারপ্রধান প্রধানমন্ত্রীর ভাষ্য অনুযায়ী, ‘দেশে ১/২ শতাংশ আবাদি জমি যেন আর না পড়ে থাকে, তাহলে আমরা আর দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হব না। এটাই হচ্ছে অর্থনীতির ফোরসাইটনেস।’

এখন, শিল্প খাতে গত কয়েক মাস অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকায় এ খাত মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্পর্কে বিশ্বব্যাংক যে ধারণা দিচ্ছে সেটি রীতিমতো আঁতকে ওঠার বিষয়। বাংলাদেশ আশা করেছিল ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন মাস পর্যন্ত জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৮.২ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক বলেছে, এখন একই মেয়াদে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে ২-৩ শতাংশ, অবস্থা আরও খারাপ হবে ২০২১ সালে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, দেশে প্রায় ৮০ লাখ শিল্প উদ্যোক্তা আছেন, এর মধ্যে ৯৮ শতাংশ হচ্ছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প। বাকি ২ শতাংশ শিল্প হচ্ছে গার্মেন্টস এবং ফার্মাসিউটিক্যালস খাত। তবে করোনা মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে থাকলে বর্ষা মৌসুম শেষে নভেম্বরের পর আবার উন্নয়ন বাজেটের ব্যয় বিশেষ করে, প্রণোদনার টাকা, করোনার জন্য বিশেষ বরাদ্দ, ডোনার সংস্থার অতিরিক্ত বরাদ্দ প্রভৃতির টাকা চলে যাবে শহর থেকে গ্রামের মানুষের হাতে। পণ্যের চাহিদা তখন আবার বৃদ্ধি পাবে। বাজার তখন চাঙা হবে। তাই উল্লিখিত চ্যালেঞ্জগুলোর যথাযথ ব্যবহার হলে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার ভাব থাকলেও বাংলাদেশ একটু আয়েশেই থাকবে।

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি বড় শক্তি হচ্ছে ভোক্তা ব্যয়। অর্থাৎ বিভিন্ন খাতে মানুষ যে টাকা খরচ করে, সেটার ওপর নির্ভর করে শিল্পপ্রতিষ্ঠান টিকে আছে। ভোক্তা ব্যয় আমাদের জিডিপির ৬৯ শতাংশ। এই ব্যয় যদি করা সম্ভব না হয়, তাহলে এই ব্যয়ের ওপর নির্ভরশীল যাঁরা আছেন, ছোট উৎপাদক থেকে শুরু করে শিল্প খাত এবং পরিষেবা খাত সবই বিক্রির সংকটে পড়বে। তাই, আর কোনোভাবেই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখা যাবে না।

সুতরাং, করোনা-পরবর্তীতে সরকারের নেওয়া সঠিক কর্মপরিকল্পনা এবং তা দ্রুত বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই।

*লেখক: শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর