টরন্টোতে 'লালজমিন'-এর ১১৫তম মঞ্চায়ন

‘লালজমিন’ নাটকে মোমেনা চৌধুরী
‘লালজমিন’ নাটকে মোমেনা চৌধুরী

গত ৩০ এপ্রিলে রয়্যাল কানাডিয়ান লিজিয়ন হলে থিয়েটার ফোকস টরন্টোর আয়োজনে মঞ্চায়িত হলো লালজমিন নাটকের ১১৫ তম মঞ্চায়ন। মান্নার হীরার রচনা এবং সুদীপ চক্রবর্তীর নির্দেশনায় শূন্যন

রেপার্টরি থিয়েটারের নাটকে একক অভিনয় করেন মোমেনা চৌধুরী।

২০১১ সালের ১৯ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটমন্ডলে ‘লালজমিন’এর প্রথম মঞ্চায়ন হয়। তারপর থেকে শুরু হয় এর নিরন্তর যাত্রা। নাট মণ্ডল থেকে শুরু করে বিলেতের চিকেন শেড থিয়েটার, আমেরিকা (অংশবিশেষ), ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ এবং দেশের বিভিন্ন মঞ্চে প্রদর্শিত হয়ে আজ লালজমিন শততম মঞ্চায়ন পার করে দর্শকের ভালো লাগার একটি স্থানে আসন করে নিয়েছে। আর এটি সম্ভব হয়েছে’ ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে শক্তিশালী একটি কাহিনি বিন্যাস, বলিষ্ঠ নির্দেশনা এবং অসম্ভব দুর্দান্ত দাপুটে অভিনয় এর জন্য। টরোন্টোবাসী নাট্যপ্রেমী দর্শকদের তাই সীমাহীন আগ্রহ ছিল লালজমিন এর মঞ্চায়নের দিনটির জন্য। আবহাওয়া কিছুটা বাধ সাধলেও নির্ধারিত সময় এর কিছু আগেই দর্শকের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সেই কালজয়ী গানগুলোর সঙ্গে দর্শক আসন গ্রহণ করেন। ঘড়ির কাঁটা ৭টা বেজে ৩০ মিনিটে পৌঁছতেই মঞ্চে অজন্তা চৌধুরী, সৃজনী ও নভেরার ভিন্ন ধরনের উপস্থাপনায় শুরু হয় লালজমিন মঞ্চায়নের প্রথম পর্ব। মার্চ মাসের ২৫ তারিখের কালো রাত্রি থেকে শুরু করে বিজয় ছিনিয়ে আনার দিনটি পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ ও তার প্রেক্ষাপট নিয়ে উপস্থাপিকাদের শুরুটা ছিল কিছুটা ভিন্ন আঙ্গিকের। এর মাঝে ‘৭১ এর চিঠি’ গ্রন্থ থেকে তিনটি হৃদয়গ্রাহী সংগৃহীত চিঠি পাঠ দর্শকদের নিয়ে যায় সেই সংগ্রামী দিনগুলিতে যখন মুক্তিযোদ্ধারা অকাতরে নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়ে স্বাধীন একটি দেশের জন্য যুদ্ধ করে চলেছিল।

এরপর মঞ্চে আমন্ত্রণ জানানো হয় ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর এবং প্রেসিডেন্ট ড. অমিত চাকমাকে। তিনি শুভেচ্ছা বক্তব্যের মাধ্যমে ধন্যবাদ জানান আয়োজকদের। পরবর্তী আয়োজনে ছিল দেশের গানের সঙ্গে খুদে শিল্পীদের একটি ব্যতিক্রমধর্মী নৃত্য পরিবেশনা। এর পরে অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক সূচনা করবার জন্য মঞ্চে আমন্ত্রণ জানানো হয় স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের সংগ্রামী শব্দশিল্পী রঙ্গলাল দেব চৌধুরীকে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সেই অগ্নিঝরা দিনগুলির প্রতি আলোকপাত করে লালজমিনের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন। সঙ্গে বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকা হাতে তুলে দেন পরবর্তী প্রজন্মের কাছে। আর তারপরেই শুরু হয় লালজমিনের সেই ৮০ মিনিটের অনবদ্য একক অভিনয়। অভিনেত্রী মোমেনা চৌধুরী তাঁর অভিনয়শৈলীর পারদর্শিতায় হলভর্তি দর্শককে টেনে নিয়ে যান একাত্তরের সেই দিনগুলিতে। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নারী মুক্তি এবং নারীদের সম্পৃক্ততা যথার্থভাবেই ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন মোমেনা চৌধুরী। আলোক পরিকল্পনা, আলোক নিয়ন্ত্রণ এবং আবহ সংগীতে লালজমিন হয়ে উঠে একটি সার্থক রূপায়ণ। সঙ্গে ছিল মোমেনা চৌধুরীর আবেগ, অভিব্যক্তির ক্ষিপ্রতা, স্বরশক্তি এবং বয়সের সঙ্গে মানানসই নৃত্য চলনের এক অবিস্মরণীয় অভিনয়। ঘটনা প্রবাহে দর্শক চলে যান সেই সময়কালে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় মিশে গিয়ে অনেকেই চোখের পানি আটকে রাখতে পারেননি। নাটকের শেষে উপস্থিত দর্শক করতালি দিয়ে দাঁড়িয়ে শিল্পীকে সম্মান জানান। দর্শকদের সঙ্গে অভিনেত্রীর মুক্ত আলোচনা ছিল খুব আবেগময় একটি পর্ব। মঞ্চ নাটকের শব্দ নিয়ন্ত্রণে ছিলেন রিঙ্কু, আলোক ও আবহ সংগীত পরিচালনায় ছিলেন রিয়াজ মাহমুদ জুয়েল, তাসলিমা জামাল শিমু এবং নভেরা। উপস্থিত দর্শকবৃন্দ মনে করেন সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার জন্যই এমন একটি মঞ্চায়ন সম্ভব হয়েছে।

টরন্টো—যাকে বলা হয় আরেক খণ্ড ছোট বাংলাদেশ, এখানকার সংস্কৃতিমনা নাট্য পিপাসু মানুষ লালজমিনের এই ঐতিহাসিক মাইলফলকে নিজেদের যেভাবে একাত্ম করেছেন, থিয়েটার ফোকস টরন্টোর সদস্যরা তার জন্য সবার কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। তাঁরা আরও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন অনুষ্ঠানের দুজন স্পনসর রিয়েল এস্টেট এজেন্ট ফারাহ খান ও মর্গেজ ব্রোকার আসাবুদ্দিন খান আসাদের কাছে।