নানা আয়োজনে ক্যালগেরিতে বর্ষবরণ

অনুষ্ঠানে ছিল শিশুশিল্পীদের মনোমুগ্ধকর নৃত্য পরিবেশনা
অনুষ্ঠানে ছিল শিশুশিল্পীদের মনোমুগ্ধকর নৃত্য পরিবেশনা

প্রচণ্ড ঠান্ডা আর প্রবল তুষারপাতের শেষে বসন্তের সোনালি সূর্যে উষ্ণতা বাড়ার পাশাপাশি দিনের স্থায়িত্বও যখন বাড়তে থাকে, ক্যালগেরিবাসী বাঙালিদের তখন থেকেই অপেক্ষার প্রহর গোনা শুরু কবে আসবে বৈশাখ, কখন শুরু উৎসব, কোথায় বসবে মেলা? এই অপেক্ষা আর প্রশ্নের উত্তর নিয়েই ব্যাপক আয়োজনে ক্যালগেরিতে হয়ে গেল বর্ষবরণ ১৪২৪। বাংলাদেশ কানাডা অ্যাসোসিয়েশন অব ক্যালগেরি ছাড়াও বিভিন্ন সংগঠন মাসাধিককালের প্রস্তুতি শেষে সাজানো ডালি নিয়ে স্থানীয় বাংলাভাষীদের বিনোদনের জন্য হাজির হয়েছিল সপ্তাহব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে।

কণ্ঠশিল্পী ফেরদৌস ওয়াহিদের একক পরিবেশনা
কণ্ঠশিল্পী ফেরদৌস ওয়াহিদের একক পরিবেশনা

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠান হয় ১৪ ও ১৫ই এপ্রিল ক্যালগেরির নর্থ-ইস্টের জেনেসিস সেন্টারে ‘বৈশাখী মেলা’ নামে। ইস্টার উপলক্ষে পাওয়া লম্বা সরকারি ছুটিতে প্রচুর দর্শকের সমাগম হয়েছিল এ দুদিনে।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে স্থানীয় শিল্পীদের পরিবেশনায় কবিতা, গান, নাচ ছাড়াও আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশের এক সময়ের জনপ্রিয় পপ-তারকা ফেরদৌস ওয়াহিদ এবং লাক্স চ্যানেল আই তারকা লিজা। দর্শকদের আগ্রহের কেন্দ্রে ছিল এই দুই শিল্পীর গান। মেলার শেষ ও মূল আকর্ষণ ছিল ফেরদৌস ওয়াহিদের জনপ্রিয় গানের একক সংগীতসন্ধ্যা; দর্শকদের উপচে পড়া ভিড় তাঁর সময়ের প্রবল জনপ্রিয়তার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। স্থান সংকুলান না হওয়ায় অনেক দর্শককে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বিভিন্ন খাবার ও পণ্যসামগ্রীর পসার নিয়ে বসেছিল ছোট ছোট স্টল। বৈশাখী মেলার মিডিয়া পার্টনার ছিল চ্যানেল আই এবং স্থানীয় পত্রিকা ‘বাংলা টাইমস’। ‘বাংলা বাজার’ নামে বাংলাদেশি গ্রোসারি স্টোর, তরুণ রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী ইকবাল রহমান ছাড়াও অন্যান্যদের পৃষ্ঠপোষকতায় বৈশাখী মেলা অনুষ্ঠিত হয়।

অন্যদিকে কয়েকজন উদ্যমী প্রবাসী বাঙালির উদ্যোগে ২২শে এপ্রিল মারলবোরো কমিউনিটি সেন্টারে হয়ে গেল ‘বৈশাখী মেলা ও আড্ডা’, যার প্রধান ভূমিকায় ছিলেন আহমেদ আল ইমরান নিক্কন নামের এক তরুণ প্রকৌশলী ও রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী। বিগত তিন বছর ধরে বৈশাখী এ আয়োজনে থাকে মূলত গ্রাম-বাংলার আনাচে-কানাচে প্রচলিত কিন্তু হারিয়ে যেতে বসা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে নতুন প্রজন্মসহ সবাইকে মনে করিয়ে দেওয়ার প্রয়াস; যেমন-পুথি পাঠ, গম্ভীরা, লাঠি খেলা, লোকনৃত্য, যাত্রাপালা, প্রভৃতি। আবহমান বাংলার এসব ঐতিহ্য ভুলতে বসা প্রবাসী বাঙালিদের সামনে তুলে ধরতে প্রচেষ্টার কমতি ছিল না এ অনুষ্ঠানে। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। ছোট ছোট শিশু ছাড়াও তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতীরা তাদের নাচ-গান-কবিতা নিয়ে অংশগ্রহণের পাশাপাশি বাবা-মাদের সঙ্গে দর্শক হিসেবেও মেলাস্থলকে মাতিয়ে রাখে। এ অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ ছিল বৈশাখী শোভাযাত্রা। আসন্ন চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাফল্য কামনায় এবারের শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য ছিল ‘বাঘ’।

প্রভিন্সিয়াল সরকারের সংস্কৃতি ও পর্যটন মন্ত্রী রিকারডো মিরান্ডার শুভেচ্ছা বক্তব্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। শুভেচ্ছা বক্তব্যের পর খালিদা নাসরীন বানীর উপস্থাপনায় ছোটদের অনুষ্ঠান ‘কচিকাঁচার আসর’ শিশুদের সুপ্ত প্রতিভাকে বের করে আনার এক অনন্য প্রয়াস। শিশুরা তাদের নাচ-গান-কবিতা দিয়ে উপস্থিত দর্শকদের মুগ্ধ করে। মুনতাহার নাচ-গান-কবিতা, জারার গান, মাহদিয়ার কবিতা, পিঙ্কী নাচের দলের মনোমুগ্ধকর নাচ এককথায় ছিল অসাধারণ। এরপর একে একে চলে বড়দের নাচ-গান-কবিতা। ধামাইল নাচ ও পুতুল নৃত্য দর্শকদের ব্যাপক বিনোদন দেয়। এ ছাড়া মোহসিনা জাহান হ্যাপির উপস্থাপনায় ‘ইত্যাদি’র মাধ্যমে বাংলাদেশের জনপ্রিয় টিভি ম্যাগাজিন ইত্যাদির স্বাদ পান দর্শকেরা। এতে আরও ছিল যাত্রাপালা, ছায়াছন্দ, বৈশাখী ধামাকা প্রভৃতি মজার মজার অনুষ্ঠান। এই ‘বৈশাখী মেলা ও আড্ডা’য় বাংলার চিরায়ত মাটির খেলনা, বাঁশি, নাগরদোলা, খই-মুড়কি হয়তো ছিল না; কিন্তু নানা রকম পিঠা, শাড়ি-চুড়ি, চটপটি-হালিম-ফুচকা, ঝালমুড়ি-চানাচুর, দই-মিষ্টি, বিরিয়ানি-লুচি, হাওয়া মিঠাই প্রভৃতির ছোট ছোট স্টলগুলো বাংলাদেশের মেলার কথাই মনে করিয়ে দেয়। এই মেলার আরেক অনুষঙ্গ ছিল টং দোকানে চায়ের আড্ডার আমেজ; এখানে চা-পান এর পাশাপাশি দলে দলে আড্ডা চলতে থাকে মেলা শেষ হওয়া অবধি। ‘বৈশাখী মেলা ও আড্ডা’র সার্বিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে ছিলেন আহমেদ আল ইমরান নিক্কন, জন অধিকারী ও মাসরুর আহমেদ দীপক। কোনো সাংগঠনিক ভিত্তি ছাড়া শুধুমাত্র তাদের ঐকান্তিক আগ্রহ আর প্রচেষ্টায় একটি সার্থক অনুষ্ঠান দেখতে পেল ক্যালগেরীবাসী। স্বীকৃতিস্বরূপ প্রাদেশিক মন্ত্রী ইরফান সাবির উদ্যোক্তাদের সম্মাননা প্রদান করেন।

এদিকে সাইমন্স ভ্যালি ইউনাইটেড চার্চে ২১শে এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয় ‘বৈশাখে আনন্দ উৎসব’ নামে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ক্যালগেরি ছাড়াও লেথব্রিজে বসবাসরত বাঙালিরা লেথব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন করেন বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে।

বর্ষবরণ উপলক্ষে ক্যালগেরীস্থ বাংলাদেশি গ্রোসারী স্টোর-বাংলা বাজার, স্বদেশী বাজার, শাপলা, রূপসী বাংলায় নববর্ষের বিভিন্ন অনুষঙ্গ বিশেষ করে ইলিশ মাছ, শুঁটকি-চ্যাপা, কচুর লতি, ইত্যাদির ওপর ছিল বিশেষ মূল্য ছাড়। বাংলাদেশি গ্রোসারি ছাড়াও প্রধান প্রধান চেইনশপগুলোতেও ছিল বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে বিশেষ ছাড়।

প্রবাসের এই ব্যস্ত জীবনে একই শহরে থেকেও বন্ধু-পরিচিতজনদের সঙ্গে যখন দেখা হয় কালেভদ্রে, বৈশাখের এই সব উৎসব তাই বাঙালিদের জন্য হয়ে যায় মিলনমেলা; একই শহরের তো বটেই, উৎসবকে ঘিরেই দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসা পরিচিতজনদের সঙ্গেও দেখা হয়, কথা হয়, হয় প্রাণখোলা আড্ডা। সাংগঠনিক এসব উৎসবের পাশাপাশি ব্যক্তিগত পর্যায়ে বাড়ির আঙিনায় চলে বৈশাখী আয়োজন, শুভেচ্ছা বিনিময়, ছোট ছোট দল বেঁধে ঘুরে বেড়ানো; এক কথায় এবারের বৈশাখ ক্যালগেরী প্রবাসী বাঙালিদের একই বিন্দুতে নিয়ে এসে বেঁধেছিল একই সুতোয়। প্রানোন্মদনায় ভরপুর এমন বৈশাখ যেন প্রতি বছর ফিরে আসে।