নিজেদের গুলিতে মারা পড়ছে আমেরিকানরা

দুর্ভিক্ষ নয়, মঙ্গা নয়— নিজেরা নিজেদের অস্ত্রে মারা পড়ছে আমেরিকানরা। এ সপ্তাহে লাস ভেগাসের নারকীয় ঘটনা এ সত্যকেই আবার উন্মুক্ত করেছে। 

উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে আমেরিকাই একমাত্র দেশ যেখানে অস্ত্রের অবাধ প্রাপ্তি নিশ্চিত করা হয়েছে সংবিধানে।
আমেরিকার নাগরিকেরা অস্ত্র কেনা এবং নিজের কাছে রাখার শাসনতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করেন। কিন্তু এ অধিকার তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অস্ত্রই বছরের পর বছর নিজেরা নিজেকে কিংবা স্বদেশিদের হত্যার জন্য ব্যবহার করছেন। এটা আমেরিকার নিজের তৈরি নিজস্ব সমস্যা। অস্ত্রের সহজলভ্যতার কারণে আমেরিকা উন্নত দেশসমূহের মধ্যে সবচেয়ে সহিংস জনপদ। এ সহিংসতা বন্ধ করাও কঠিন। আগ্নেয়াস্ত্রের কারণে আমেরিকার কানাডার চেয়ে ছয়গুণ এবং জার্মানির চেয়ে ১৬ গুণ বেশি নরহত্যার ঘটনা ঘটে। হার্ভার্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথস ইনজুরি কন্ট্রোল রিসার্চ সেন্টারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আমেরিকায় আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারে গণমৃত্যুর কারণ একটাই, এখানে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র রয়েছে জনসাধারণের কাছে।
২০১২ সনের হিসাব অনুযায়ী বিশ্বের ১৩টি উন্নত দেশের মধ্যে আগ্নেয়াস্ত্রে খুনের ঘটনা আমেরিকাতে সবচেয়ে বেশি। প্রতি দশ লাখের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ায় ১.৪ জন, নিউজিল্যান্ডে ১.৬ জন, জার্মানিতে ১.৯ জন, ডেনমার্কে ২.৭ জন, নেদারল্যান্ডসে ৩.৩ জন, সুইডেনে ৪.১ জন, ফিনল্যান্ডে ৪.৫ জন, আয়ারল্যান্ডে ৪.৮ জন, কানাডায় ৫.১ জন, লুক্সেমবার্গে ৬.২ জন, বেলজিয়ামে ৬.৪ জন, সুইজারল্যান্ডে ৭.৭ জন এবং আমেরিকায় ২৯.৭ জন খুন হন।
‘হার্ভার্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথ’স ইনজুরি কন্ট্রোল রিসার্চ সেন্টার’ অস্ত্রাঘাতে মানুষ খুন হওয়ার ঘটনার বিষয়ে ব্যাপক গবেষণা চালিয়ে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, অস্ত্রের সহজ প্রাপ্তির কারণেই অন্যান্য উন্নত দেশের তুলনায় আমেরিকাতে খুন-খারাবি বেশি।
সারা দুনিয়ার মোট জনসংখ্যার ৪.৪ শতাংশ আমেরিকান। কিন্তু সারা দুনিয়াতে বেসামরিক জনগণের কাছে প্রাপ্ত অস্ত্রের প্রায় অর্ধেকের বেশি আমেরিকানদের কাছে রয়েছে। ‘গান ভায়োলেন্স আর্কাইভ ড্যাটাবেস’ অনুযায়ী আমেরিকাতে প্রতিদিন একটির বেশি গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এ হিসেব মতে, ২০১৪ সনে আমেরিকাতে বেসামরিক গুলির আঘাতে ৩৩ হাজার জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। 

অন্যদিকে ‘পেডিয়াট্রিক’ এবং ‘সেন্টার ফর ডিসইজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন, মাদার জোন্স’ তাদের তথ্য-উপাত্ত একত্রিত করে দেখিয়েছে আমেরিকার যেসব অঙ্গরাজ্যে আগ্নেয়াস্ত্র বেশি সেগুলোতে বন্দুক-সংশ্লিষ্ট খুনের সংখ্যা বেশি। আবার আগ্নেয়াস্ত্র প্রাপ্তি তুলনামূলকভাবে কঠিন এমন অঙ্গরাজ্যগুলোতে গুলির আঘাতে মৃত্যুর ঘটনা কম। অর্থনীতিবিদ রিচার্ড ফ্লোরিডা বন্দুকের গুলির এবং অন্যান্য সামাজিক নির্দেশকগুলো বিশ্লেষণ করে বলেছেন, গুলির আঘাতে অধিক মৃত্যুর সঙ্গে অধিক জনসংখ্যা, অতিরিক্ত মানসিক চাপ, অধিক অভিবাসী কিংবা মানসিক অসুস্থতার কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি বলেন, যেসব অঙ্গরাজ্য বন্দুক নিয়ন্ত্রণে কঠোর নীতি অনুসরণ করে সেখানে বন্দুকের গুলিজনিত খুনের হার কম। তার মতে বন্দুক নিয়ন্ত্রণ জীবন বাঁচাতে পারে।
তা সত্ত্বেও বন্দুক-সংশ্লিষ্ট খুন-খারাবি এবং অন্যান্য অপরাধ গত দুই দশকে কমেছে। তবে ২০১৫ ও ২০১৬ সনে পুরো আমেরিকা জুড়ে বন্দুকের গুলি ছুড়ে মৃত্যুর ঘটনা বেড়েছে। অধিকাংশ গবেষক মনে করেন, অতিরিক্ত বন্দুক অপরাধ প্রবণতা হ্রাস করেছে। কিন্তু এ মন্তব্যের বিপরীতে বাস্তবে ‘হার্ভার্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথ’স ইনজুরি কন্ট্রোল রিসার্চ সেন্টার’এর গবেষণাকে সঠিক বলে মনে হয় যে, অস্ত্রের সহজ প্রাপ্তির কারণেই অন্যান্য উন্নত দেশের তুলনায় আমেরিকাতে খুন-খারাবি বেশি।
বন্দুক-সংক্রান্ত আমেরিকার রাজনৈতিক বিতর্ক জনগণের ওপর ভয়ংকর গোলাগুলি এবং গণহত্যা-কেন্দ্রিক হলেও অধিকাংশ বন্দুকের গুলি কেন্দ্রিক মৃত্যু ঘটে বন্দুক দিয়ে আত্মহত্যার কারণে। ডাইল্যান ম্যাথিউস বলেন, আগ্নেয়াস্ত্র প্রাপ্তির কারণেই বন্দুকের গুলির আঘাতে আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়ায়। যে অঙ্গরাজ্যে বন্দুকের সংখ্যা বেশি সেগুলোতে আত্মহত্যার সংখ্যাও বেশি। বন্দুকের মাধ্যমেই মানুষ নিজেকে সহজে খুন করতে পারে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘আমেরিকান ফাউন্ডেশন ফর সুইসাইড প্রিভেনশন’এর ভাইস-প্রেসিডেন্ট জিল হ্যারকেভি-ফ্রেইডম্যান ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন, বন্দুকের সহজলভ্যতা হ্রাস করা আত্মহত্যা রোধে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বিশেষ। তিনি বলেন, আত্মহত্যার উপকরণ ব্যক্তির কাছ থেকে দূরে রাখলে সে আত্মহত্যার জন্য আরেকটি উপকরণের দিকে সঙ্গে সঙ্গে ধাবিত হওয়ার সুযোগ কমই পায়। হয়তো একটু পরে ওই ব্যক্তি সাময়িক উত্তেজনাবশত আত্মহত্যার ভাবনা থেকে সরে আসতে পারে।
অস্ট্রেলিয়ার গবেষকগণ ব্যাপক গবেষণা চালিয়ে দেখিয়েছেন, অস্ট্রেলিয়া সরকার বন্দুক নিয়ন্ত্রণ করার পর থেকে সে দেশে আত্মহত্যার হার নাটকীয়ভাবে কমে গেছে। তাদের গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি এক লাখ নাগরিকের জন্য মাত্র তিন হাজার ৫০০ বন্দুক ক্রয়ের ব্যবস্থা করায় আগ্নেয়াস্ত্রের সাহায্যে আত্মহত্যার হত্যার হার ৫০ শতাংশ কমে যায়। আর বন্দুকের মাধ্যমে আত্মহত্যার হার ৭৪ শতাংশ কমে।
গবেষণা এবং তথ্য-উপাত্ত একটা স্পষ্ট বার্তা দেয় যে, কোনো রাষ্ট্র বা দেশ আত্মহত্যার সংখ্যা ব্যাপকভাবে হ্রাস করতে সক্ষম হয় যদি বন্দুক বা আগ্নেয়াস্ত্র প্রাপ্তির সুযোগ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়।
এমন সহিংসতার মধ্যেও আমেরিকায় গর ২০ বছর থেকে ‘আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ’ এবং ‘নাগরিকদের অধিকার রক্ষার জন্য আগ্নেয়াস্ত্র রাখা’ বিতর্কে হাবুডুবু খাচ্ছে। নাগরিক অধিকার রক্ষার জন্য নিজেদের কাছে অস্ত্র রাখার ব্যাপারে জনমত বাড়তে দেখা গেছে পিউ রিসার্চ সেন্টারের জরিপে। কলোম্বাইন হাই স্কুল বা সেন্ডিহুক এলিমেন্টারি স্কুলে বন্দুক হামলায় হতাহতের পর জনগণের কাছে নিজেদের আয়ত্তে বন্ধুক রাখার পক্ষে জনমত বৃদ্ধি দেখা যায় পিউ রিসার্চ সেন্টারের দেওয়া তথ্য মতে। আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে নারকীয় সব বড় বড় ঘটনা ঘটার পরও আমেরিকার জনমত বিস্ময়করভাবে নিজেদের কাছে অস্ত্র রাখার অধিকারের পক্ষে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট থাকার সময়ে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ নিয়ে জোরে কথা উঠেছিল। তখন নাগরিকদের মধ্যে বন্দুক কেনার হিড়িক পড়ে যায়। পরের বাস্তবতা আরও ভিন্ন। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বন্ধুক রাখার অধিকার নিয়ে ঐক্যবদ্ধ সংগঠন ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশনের ব্যাপক সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসেন। তাদের সমর্থন এখন চাঙা সর্বত্র।
লাস ভেগাসে গণগুলি বর্ষণে ৫৮ ব্যক্তি নিহত এবং পাঁচ শতাধিক আহত হওয়ার পর বন্ধুক নিয়ন্ত্রণ বিতর্ক আবার চাঙা হয়ে উঠেছে। এমন বিতর্কের শুরুতেই বলা হয়, এখন শোকের সময়-রাজনৈতিক বিতর্কের সময় নয়। ডেমোক্র্যাট বা উদারনৈতিকেরা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের জন্য উচ্চকণ্ঠ হলেও রিপাবলিকানরা রক্ষণশীলদের পক্ষে। আমেরিকার সংবিধানে দেওয়া এ প্রাণঘাতী অধিকার রক্ষায় তারা অনড়। নানা সব শর্ত আরোপ করে, শক্ত ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করে আগ্নেয়াস্ত্র বিক্রির ব্যাপারে এখন জনমত প্রবল। যদিও ঢালাওভাবে নাগরিকদের অস্ত্র প্রাপ্তি কঠিন করার কোনো দ্রুত উদ্যোগ আমেরিকার রাজনীতিবিদদের আগ্রাধিকারে আছে বলে মনে হয় না। এ নিয়ে তাদের মতৈক্য অন্যান্য জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মতো সুদূর পরাহত বলেই মনে হচ্ছে লাস ভেগাস ঘটনার পরও।
মানবাধিকার নেতা কংগ্রেসম্যান জন লুইস হতাশার কণ্ঠে বুধবার ওয়াশিংটনে বলেছেন, রক্তের বা বেদনার কোনো পরিমাণ-হতাহতে কোনো সংখ্যাই কংগ্রেসকে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় করতে পারছে না। শাসনতান্ত্রিক অধিকার আর জীবন হানির বিতর্কের মধ্যে কংগ্রেসম্যান লুইসের বক্তব্যে আমেরিকার অগুনতি মানুষের হতাশার প্রতিদ্বন্দ্বী মাত্র।