দুই দু'গুণে চার

আমাদের দেশে যেকোনো প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে একটি দৃশ্য চোখে পড়বে কিংবা কানে শোনা যাবে, ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে সশব্দে কবিতা পড়ছে, ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি...’, নয়তো নামতা মুখস্থ করছে, ‘দুই একে দুই, দুই দু’গুণে চার,...’। শিক্ষক/শিক্ষিকা মহোদয় একটি বেত হাতে নিয়ে শ্রেণিকক্ষের ভেতর ঘুরে বেড়াচ্ছেন, যেন অনেকটা পাহারা দেওয়ার মতো কেউ যাতে ফাঁকি না দেয়। কোমলমতি ছেলেমেয়েদের চোখ তখন থাকে জানালার বাইরে, মাঠে কোন ছাগল দৌড়ে বেড়াচ্ছে, কিংবা আকাশে ঘুড়ি কাটাকাটি করছে। মন তাদের ছুটে চলেছে দিগন্তের পানে যখন ঠোঁটে ফেনা তুলছে, ‘সদা সত্য কথা বলিব...’।

এভাবেই আমাদের শিক্ষাজীবনের শুরু। ওপরের দৃশ্যটি শহুরে ইংরেজি মাধ্যমের প্রতিষ্ঠানে কিছুটা ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু মূলনীতিটি একই, মুখস্থবিদ্যা। শিক্ষার শুরু হয় মুখস্থ করা দিয়ে, শেষ অবধি মুখস্থ করার ক্ষমতাই একজন শিক্ষার্থীর যোগ্যতার মাপকাঠি হয়ে দাঁড়ায়। আমরা শিশুদের বাহবা দিই, কে কত বেশি কবিতা মুখস্থ করল কিংবা কে কত দ্রুত সব নামতা মুখস্থ করতে পারল। আমাদের ধর্মীয় শিক্ষার ক্ষেত্রেও একই মূলনীতি, মুখস্থ করো। আমরা সবাই কম বিস্তর কিছু সুরা ও দোয়া মুখস্থ জানি, কিন্তু কজন এসবের অর্থ বুঝি সে প্রশ্ন রয়েই যাবে। অন্য ধর্মশিক্ষার ক্ষেত্রেও এর ব্যত্যয় হচ্ছে বলে মনে হয় না।

শিশুদের শিক্ষা শুরুই হয় কিছু ছড়া মুখস্থ দিয়ে। ছড়ার ভেতর একটা ছন্দ রয়েছে বলে শিশুরা সহজেই তা আয়ত্তে নিয়ে আসে। শিশুদের হয়তো এর ভেতর দিয়ে আরও অনেক মজা দেওয়া যেত, তাদের শিক্ষার আগ্রহকে জাগিয়ে তোলা যেত, শিক্ষাপদ্ধতির প্রতি তাদের আকৃষ্ট করা যেত। কিন্তু যখন আমরা এ সুযোগ নিয়ে তাদের ওপর আরও অনেক বিষয় চাপিয়ে দিই, ভাষা, গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস—সবই যখন তাদের মুখস্থ করতে বলা হয়, তখন মূলত তাদের সব আগ্রহ আমরা নিভিয়ে দিই। অক্ষর শেখার মধ্যেও আমাদের নেই কোনো মজা, যা শিশুদের মনোযোগ আকৃষ্ট করতে পারে। কেবল মুখস্থ করে যাও, ‘অ’-তে অজগর, ‘আ’-তে আম, ইত্যাদি। ‘অ’-তে যে অজগর ছাড়া আরও কিছু হতে পারে, ‘অ’ লেখার ভেতর যেকোনো মজার দৃশ্যকল্প লুকিয়ে থাকতে পারে, সে শিক্ষা শিশুরা কখনোই পায় না। অক্ষর নিয়ে আমাদের কোনো মজার খেলা কি আছে, যা শিশুদের মাতিয়ে রাখতে পারে?

প্রাথমিক তো বটেই, প্রাক্‌-প্রাথমিক বিদ্যালয়ের (নার্সারি, কিন্ডারগার্টেন, ইত্যাদি) শিক্ষার্থীদেরও বিদ্যালয়ে যাওয়ার সময় একটি মোটা ব্যাগে ভারী ভারী বই নিয়ে যেতে হয়, যা বয়ে নিয়ে যাওয়ার শক্তি অনেকের তখনো তৈরি হয়নি। এসব বই শেখার নয়, মুখস্থ করার। এসব তাদের মাথায় ঢোকাতে ঢোকাতে গলদঘর্ম হয়ে ওরা হয়তো ভাবে, কেন জন্ম নিলাম। আমরা শিক্ষার নামে এ ধরনের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে শিশুদের কেবল শিক্ষার বিষয়ে অনাগ্রহী করে তুলছি না, তাদের শৈশবও আমরা কেড়ে নিচ্ছি। শৈশবের আনন্দ, উচ্ছলতা ও সজীবতা ওরা কখনোই অনুভব করার সুযোগটি পায় না। এ শিশুটি বড় হয়ে প্রকৌশলী, চিকিৎসক কিংবা আরও বড় কিছু হতে পারে, বিত্তবান হতে পারে, কিন্তু কখনো কি তার শৈশব ফিরে পেতে পারবে?

আমাদের শিক্ষার দ্বিতীয় সীমাবদ্ধতা হচ্ছে শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করতে প্রচণ্ডভাবে নিরুৎসাহিত করা। শিল্পীর কণ্ঠে তাই শুনি, ‘বাচ্চারা কেউ ঝামেলা করো না, উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করো না...’। প্রশ্ন করা মানেই ‘বেয়াদবি’ করা। আর যদি শিক্ষক সে প্রশ্নের উত্তর না জানেন, তবে তো কথাই নেই। মনে পড়ে, ইংরেজি শেখার সময় আমার এক বন্ধু প্রশ্ন করেছিল, ‘স্যার, P+U+T পুট হলে B+U+T বুট হবে না কেন?’ (আমি নিশ্চিত, শিক্ষক মহোদয় উত্তর জানতেন) কিন্তু শিক্ষকের রাগী মূর্তি দেখে আমার বন্ধুটির কাপড় নষ্ট হওয়ার জোগাড়। ইংরেজি বানান ও উচ্চারণ নিয়ে আমার বন্ধুটির যেটুকু আগ্রহ ছিল, তা সেদিন সমূলে উৎপাটিত হয়েছিল। অথচ শিক্ষার মূলনীতি হওয়া উচিত ছিল অনুসন্ধিৎসা। একটি বিষয় পড়া বা শোনার পর যদি শিক্ষার্থীর মনে কোনো প্রশ্ন না জাগে তবে বুঝতে হবে সে কিছু শেখেনি। সভ্যতার আদি যুগ থেকে মানুষ প্রশ্ন করেই শিখেছে। জীবন ও জগৎ নিয়ে মানুষের মনে হাজারটা প্রশ্ন জেগেছে, আর তখন সে উত্তর খুঁজে বেড়িয়েছে। প্রশ্ন না জাগলে কিংবা মানুষ অনুসন্ধিৎসু না হলে সভ্যতার কোনো অগ্রগতি হতো না, আজও বনে বসে আমাদের শিকার করে কাঁচা মাংস খেতে হতো। শিক্ষকের দায়িত্ব শিক্ষার্থীদের কোনো বিষয় গিলিয়ে দেওয়া নয়, বরং তাদের মাঝে উল্লেখিত বিষয়ে উৎসাহ তৈরি করা, প্রশ্নের উদ্রেক করা এবং সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সাহায্য করা। শিক্ষকের ভূমিকা হওয়ার কথা পথপ্রদর্শকের, এ পথ প্রশ্নের উত্তরের নয় বরং প্রশ্নের উত্তর খোঁজার। স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাও আমাদের তাগিদ দিয়েছেন ঘরের বাইরে গিয়ে জগৎকে দেখার এবং তাঁর সৃষ্টিরহস্য উদ্‌ঘাটন ও অনুধাবনের জন্য। অথচ আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের বলছি, এটিই সঠিক উত্তর এবং এটি মুখস্থ করো।

আমাদের বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থায় আরও একটি ভয়াবহ দিক রয়েছে, আর তা হলো শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষা নিয়ে একটি ভয় বা আতঙ্কের জন্ম দেওয়া। ক্রমাগত মুখস্থ করার চাপে পড়ে শিক্ষার্থীদের মনে আপনা-আপনিই একটি ভীতি তৈরি হয়। এর ওপর শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের দাম্ভিক মূর্তি দেখে তাদের মনে সংশয় জাগে, তারা কি কারাগারে, তারা কি কোনো অপরাধ করেছে? শিক্ষক ও পঠিতব্য বিষয়ের প্রতি তাদের বন্ধুত্ব ও নির্ভরতা তৈরি না হলে শিক্ষা কখনোই সম্পূর্ণ হবে না। যুগ যুগ ধরে তৈরি হওয়া প্রথাগত শ্রেণিবৈষম্য আমাদের সবার মাঝেই বাস করে এবং তার প্রতিফলন সমাজের প্রতি ক্ষেত্রেই দেখা যায়। শ্রেণিকক্ষ এর একটি দৃষ্টান্ত। শিক্ষক সব সময়ই বিশ্বাস করেন, তিনি শিক্ষার্থীদের চেয়ে অধিক উত্তম, অতএব তার কথাই শিরোধার্য। এ কারণে নিজের অজান্তেই তিনি শিক্ষার্থীদের থেকে একটি মানসিক দূরত্ব তৈরি করে রাখেন। ফলে শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষককে বন্ধু ভাবা তো দূরের কথা, আপন ভাবতেও ভয় পায়। একসময় শিক্ষার্থীদের পেটানোর খুব প্রচলন ছিল, যে শিক্ষক যত পেটাতেন তিনি তত উচ্চ মানের শিক্ষক বলে গণ্য হতেন। অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তানদের শিক্ষকের হাতে দিয়ে বলতেন, ‘স্যার, আমাকে শুধু হাড় ফেরত দিলেই হবে, আর কিছু চাই না।’ ভাবা যায়, কোন পাথর যুগে আমরা বসবাস করতাম? এখন পেটানোর প্রচলন ক্রমে ক্রমে লুপ্ত হলেও শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মাঝে দূরত্ব একটুকুও কমেনি, বরং অন্য কোনো রূপে বিদ্যমান। এ দূরত্বের কারণেই শিক্ষার্থীরা কখনো শিক্ষককে প্রশ্ন করতে সাহস পায় না, নিজেদের ভালো লাগা, মন্দ লাগার কথা জানাতে পারে না। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মাঝে যদি দূরত্ব থাকে, পরস্পরকে যদি জানা না যায়, এক পক্ষ যদি অন্য পক্ষকে বুঝতে না পারে, তবে সেখানে কোনো শিক্ষার পরিবেশ বিরাজ করতে পারে না, শিক্ষার আদান-প্রদান হতে পারে না।

সৃষ্টিকর্তা মানুষকে তৈরি করেছেন অনেক ক্ষমতা দিয়ে। মানুষের মস্তিষ্ক যেমন তথ্য সংরক্ষণ করতে পারে, তেমনি পারে তথ্য প্রক্রিয়াজাত করতে। আমাদের মুখস্থবিদ্যা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মস্তিষ্কে হাজার হাজার তথ্য ও উপাত্ত দিয়ে ভরিয়ে দিচ্ছে, ফলে সেসব তথ্য ও উপাত্ত কাজে লাগানোর জন্য যে গাণিতিক ও যৌক্তিক জ্ঞান প্রয়োজন, তা আর ধারণ করার কোনো স্থান অবিশিষ্ট থাকছে না। আমরা ভুলে যাচ্ছি, তথ্য সংরক্ষণের জন্য মানুষ ইতিমধ্যে আরও বহুবিধ সস্তা উপায় বের করে ফেলেছে। আমরা শিক্ষার্থীদের যেসব কবিতা, গণিত বা ইতিহাস মুখস্থ করতে বলছি, সেগুলো সব অল্প টাকায় কেনা কয়েকটি সিডিতে রেখে দেওয়া যায়। একজন মানুষের মস্তিষ্কের মূল্য কি তবে ওই কটি সিডির সমান? ইন্টারনেটে একটি প্রশ্ন লিখলে তার হাজারটা উত্তর বের হয়ে যায়। আমাদের কি এখন ওই উত্তর মুখস্থ করা প্রয়োজন নাকি ওই উত্তর কীভাবে ও কোন কাজে লাগানো যায় সে শিক্ষা প্রয়োজন? সভ্যতার আদি যুগে তথ্য সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা ছিল না বলে মানুষ মুখস্থ করত। কিন্তু আজকের যুগে তথ্য সংরক্ষণ নয় বরং তথ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের বিদ্যা প্রয়োজন।

আমরা যা জেনেছি বা শিখেছি তা শেষ নয়, শিক্ষার দিগন্ত অনন্ত। সে অনন্তের পথে এগিয়ে যেতে হবে আমাদের আগামী প্রজন্মকে। এ প্রজন্মকে হতে হবে অনেক তুখোড়, বুদ্ধিমান ও সমস্যা মোকাবিলায় অকুতোভয়। পিটিয়ে, মুখস্থ করিয়ে সে প্রজন্ম তৈরি করা যাবে না। নামতা মুখস্থ নয় বরং গুণ করার আরও সহজ ও মজাদার পদ্ধতি শেখাতে হবে (ইতিমধ্যে বহু আকর্ষণীয় পদ্ধতি আবিষ্কৃত ও প্রচলিত হয়েছে)। কবিতা মুখস্থ নয় বরং কাব্য উপলব্ধি করার রসবোধ তৈরি করতে হবে। ইতিহাস মুখস্থ নয় বরং ইতিহাস বিশ্লেষণ করা ও ভবিষ্যৎ নির্মাণে ইতিহাসের শিক্ষা কীভাবে ব্যবহার করা যায়, সে শিক্ষা দরকার। বিজ্ঞানের সূত্র মুখস্থ নয় বরং সে সূত্র জীবন ও জগতের রহস্য উদ্‌ঘাটনে কিংবা সভ্যতার উন্নয়নে কীভাবে সহায়ক হবে, সে জ্ঞান অর্জন প্রয়োজন।

আর তবে মুখস্থ আওড়াব না—দুই দু’গুণে চার। বরং প্রশ্ন করব, কেন দুই গুণ দুইয়ে চার হবে, পাঁচ হবে না কেন। শ্রেণিকক্ষকে মুখস্থবিদ্যার পাঠশালা না করে খেলাঘর করলে কেমন হয়?

লেখক: শিক্ষক, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র