খান বাহাদুর আবদুল মাজিদ এক উজ্জ্বল নক্ষত্র

সিলেট মুরারিচাঁদ কলেজের ইতিহাসের এক মহান নায়ক সৈয়দ আবদুল মাজিদ (কাপ্তান মিয়া) আজ ইতিহাসের পাতা থেকে বিলুপ্ত। আমরা অনেকেই জানি, রাজা গিরিশচন্দ্র সিলেটের শিক্ষার জন্য নতুন যুগের সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি সিলেট এইডেড স্কুল, রাজা জিসি হাইস্কুল, সংস্কৃত শিক্ষা টোল এবং ১৮৯২ সালে মুরারিচাঁদ কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথম ২০ বছর রাজা নিজে সব ব্যয়ভার গ্রহণ করেন।
১৮৯৭ সালের বিরাট ভূমিকম্পের ফলে রাজার বাড়িঘর ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। তিনি ঋণ গ্রহণ করে তা পুনর্নির্মাণ করতে গিয়ে ধীরে ধীরে আর্থিক অনটনে পড়েন। ১৯০৮ সালে রাজা গিরিশচন্দ্রের মৃত্যুর পর কলেজটি আর্থিক বিপাকে পড়ে যায়। ফলে বাধ্য হয়ে সরকারি সাহায্য নিতে হয় এবং কলেজ একটি এইডেড প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। বাবু দুলালচন্দ্র দেব ও কাপ্তান মিয়ার উদ্যোগে কলেজটি নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পায়। ১৯১২ সালে এটি পূর্ণাঙ্গ সরকারি কলেজে পরিণত হয়। ১৯১৬ সালে কলেজকে প্রথম গ্রেডের ডিগ্রি কলেজে উন্নীত করতে সিলেটে এক জোরদার আন্দোলন শুরু হয়। কাপ্তান মিয়া সেই আন্দোলনের ছিলেন পুরোধা। তিনি নিজের ও অন্য ৮ জন সিলেটবাসীর পক্ষ থেকে ১৮ হাজার টাকার জামিনদার হন। ফলে কলেজটি প্রথম শ্রেণিতে রূপান্তরিত হয়। ১৯২১ সালে কাপ্তান মিয়া সিলেট সদর থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসাম আইন পরিষদের সভ্য নির্বাচিত হন। হিন্দু-মুসলিম সব সম্প্রদায়ের কাছে ছিল তাঁর এমন জনপ্রিয়তা। নতুন ব্যবস্থাপনায় তিনি আসামের শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পান। সিলেটের শিক্ষা বিস্তারের জন্য উদ্যোগ নেন তিনি।
সেই সময় মুরারিচাঁদ কলেজ সিলেট শহরের ভেতর ছিল এবং প্রথম শ্রেণির ডিগ্রি কলেজের উপযুক্ত পরিবেশ ও দালানকোঠা সেখানে ছিল না। কাপ্তান মিয়া তখন সিলেটে বিশ্ববিদ্যালয় করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। আসাম ভ্যালির পূর্বে সুরমা ভ্যালিতে বিশ্ববিদ্যালয় করতে হলে উপযুক্ত জমির ও কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন। তাই তিনি শহর থেকেই তিন মাইল দূরে ১২০ একর জমি অধিগ্রহণ করে শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে বর্তমান মুরারিচাঁদ কলেজ প্রাঙ্গণের ভিত্তির সূচনা করেন এবং ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করার জন্য আসামের তদানীন্তন গভর্নর স্যার উইলিয়াম মরিসকে আমন্ত্রণ জানান। ১৯২৫ সালে থ্যাকারের টিলায় (বর্তমানে টিলাগড়) নতুন কলেজের উদ্বোধন করেন স্যার বিডসন বেল। তখন কাপ্তান মিয়া আর ইহজগতে নেই। স্যার বিডসন বেল তাঁর উদ্বোধনী ভাষণে শ্রদ্ধাভরে কলেজ স্থাপনে কাপ্তান মিয়ার বিরাট অবদানের কথা স্মরণ করেন। তিনি কলেজের নতুন কোনো নাম বা নিজের নাম না দিয়ে এই নতুন প্রাঙ্গণে কলেজটিকে মুরারিচাঁদ কলেজের নামই রাখেন। রাজা গিরিশচন্দ্র যে বীজ বপন করেছিলেন, তাঁরই মতো আরেক শিক্ষানুরাগী কাপ্তান মিয়া সেটাকে মহিরুহতে পরিণত করেন। ক্ষমতার নির্লোভ ও সিলেটের মানুষের অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্য তাঁর এই অসামান্য উদাহরণে ভাস্বর হয়ে থাকবে।
কাপ্তান মিয়ার জন্ম হয়েছিল ১৮৭২ সালে সিলেটের কাজী ইলিয়াসে। তাঁর বাবা সৈয়দ আবদুল জলিলের পূর্বপুরুষ ছিলেন হজরত শাহজালালের অন্যতম আউলিয়া সৈয়দ শাহ মোস্তফা বাগদাদী। নিজে প্রাচীনপন্থী আলেম হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছেলেকে ইংরেজি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। কাপ্তান মিয়া নবাব তালেব স্কুল থেকে পাস করে পরে সিলেট জিলা স্কুল থেকে ১৮৮৭ সালে প্রবেশিকা ও কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ ও সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে ১৮৯২ বিএ পাস করেন। ১৮৯৪ সালে তিনি বিএল পাস করেন। তাঁর কর্মজীবন ছিল বৈচিত্র্যময়। তিনি দীর্ঘ ১৫ বছর সিলেট লোকাল বোর্ডের সদস্য ছিলেন। ১৯০৬ থেকে ১৯০৯ পর্যন্ত তিনি সিলেট পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান ও পরে তিন বছর চেয়ারম্যানের দায়িত্বভার পালন করেন। কৃষি খাতে উন্নতির জন্য তিনি কয়েকটি কৃষিখামার গড়ে তোলেন। চা-শিল্পের উন্নতির জন্য তিনি তিনটি চা-বাগান তৈরি করেন এবং চা-শিল্পে স্বদেশিদের মধ্যে ছিলেন পথিকৃৎ। চা-শিল্প ছাড়াও তিনি একটি ভোজ্যতেলের কলও প্রতিষ্ঠা করেন। আসাম প্রদেশে এটাই জাতীয় প্রথম ভারতীয় প্রচেষ্টা। শিল্প স্থাপনেই শুধু নয়, তিনি সমাজসেবা ও স্বদেশকর্মী হিসেবেও ছিলেন অগ্রদূত।
১৯০৬ সালের মুসলিম লীগের জন্মের আগে মুসলমানদের একমাত্র রাজনৈতিক সংগঠন আঞ্জুমানে ইসলামিয়ার ১৯০২ সালে তিনি ছিলেন সিলেট জিলার সেক্রেটারি এবং পরে সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি নিখিল ভারত মোহামেডান কনফারেন্সের সভ্য ছিলেন। ব্রিটিশরাজ তাঁর সমাজ সম্প্রসারণের কাজে অতুলনীয় অবদানের জন্য তাঁকে খান বাহাদুর উপাধি দিয়ে সম্মান প্রদান করে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৯ সালে সিলেটে এলে তাঁকে যে সংবর্ধনা দেওয়া হয়, সেই অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি ছিলেন আবদুল মাজিদ কাপ্তান মিয়া। ১৯২২ সালে মাত্র ৫০ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আমরা মুরারিচাঁদ কলেজে তাঁর ইতিহাসকে সংরক্ষণ করার আহ্বান জানাই।

ডা. জিয়াউদ্দিন আহমেদ, ফিলাডেলফিয়া