অদ্ভুত রহস্যে ঘেরা তাঁর জীবন!

ওয়ারেন, রিথ, পলিন ও তাঁর ভাই টেড। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে।
ওয়ারেন, রিথ, পলিন ও তাঁর ভাই টেড। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে।

মেয়েটির নাম পলিন ডেকিন। আর দশজনের চেয়ে পলিনের জীবনটা আলাদা। আলাদা না বলে বলা যায় অদ্ভুত, রহস্যময়ও। ছোটবেলা থেকে অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন পলিন। খুঁজেছেন জীবনজটের সমাধান। কিন্তু মেলেনি।

কানাডায় শৈশব কাটে পলিন ডেকিনের। কারও সঙ্গে পারিবারিক জীবন নিয়ে কথা বলার অনুমতি ছিল না। অন্য ছেলেমেয়েরা যখন হেসেখেলে বেড়াত, পলিন ও তাঁর ভাই যেন লুকিয়ে লুকিয়ে থাকতেন। দুই ভাইবোন ভাবতেন, কেন তাঁদের জীবনটা অন্যদের থেকে আলাদা?

এভাবেই কাটছিল জীবন। হঠাৎ জীবনের বাঁকে হোঁচট। পাঁচ বছর বয়সে পলিনের বাবা ওয়ারেন ও মা রিথের বিচ্ছেদ ঘটে। সে সময়টায় পলিনের স্কুলে ভর্তি হওয়ার কথা। বাবা সফল ব্যবসায়ী ছিলেন। তবে মদ গিলতেন প্রচুর। মাতাল হয়ে প্রায়ই উন্মত্ত হয়ে উঠতেন ওয়ারেন। রিথ আর এই চাপ নিতে পারছিলেন না।

সাত বছর বয়সী পলিনকে নিয়ে মা রিথ কানাডার ভ্যাঙ্কুভার থেকে এক হাজার মাইলেরও বেশি দূরের উইনিপেগে চলে যান। সবই এত তাড়াতাড়ি ঘটে গিয়েছিল, কারও কাছ থেকে বিদায় নেওয়ারও সুযোগ পাননি পলিন।

এভাবে দূরে কেন যাচ্ছি?

পলিনের এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতেন না মা রিথ। শুধু বলতেন, বড় হলে জানবে।

উইনিপেগেও বেশি দিন থাকা হলো না। চার বছর পর রিথ আবার পলিনকে নিয়ে চলে গেলেন কানাডার পূর্ব উপকূলের নিউ ব্রান্সউইকে। নতুন শহরে আবারও নতুন জীবন শুরু হলো পলিনের।

অস্থিরতা কমল না। ১১ বছর বয়স পর্যন্ত ছয়বার স্কুল বদলাতে হয় পলিনকে। বাবার সঙ্গে যোগাযোগ একরকম বন্ধই হয়ে যায়। মা প্রায়ই অদ্ভুত আচরণ করতেন। বাসায় জমে থাকা খাবার ফেলে দিতেন, কখনো পলিনকে নিয়ে পাহাড়ের তাঁবুতে গিয়ে থাকতেন। কেন এমন হচ্ছে জানত চাইতেন পলিন। মা উত্তর দিতেন না।

এই অস্থির জীবনে পলিন মায়ের সঙ্গে স্ট্যান সিয়ার্স নামের একজন সঙ্গীকে দেখতেন। মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের পরিবারকে সহায়তা দানকারী একটি দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন স্ট্যান। পলিনের বাবার মদ্যপানের সুবাদেই স্ট্যানের সঙ্গে যোগাযোগ হয় মা রিথের। যতবার রিথ ও পলিন জায়গা বদল করেছেন, ততবারই স্ট্যানের পরিবারও জায়গা বদল করেছে। পলিন মনে মনে জানতেন, যা ঘটছে, কোথাও না কোথাও স্ট্যানের সেগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে।

এভাবে কেটে যায় সময়। ১৯৮৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করেন পলিন। কাজ নেন স্থানীয় একটি পত্রিকায়। সেন্ট জন শহরে ওই পত্রিকার কার্যালয় ছিল। সে সময় মা রিথের কাছ থেকে আসা একটি ফোনে চমকে যান পলিন।

মা বলেন, এবার তিনি পলিনকে সব খুলে বলবেন। অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাবেন পলিন।

পলিন ডেকিন। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
পলিন ডেকিন। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

একটি মোটেলে মায়ের সঙ্গে দেখা করেন পলিন। মা পলিনকে একটি চিঠি ও খাম দেন। চিঠিতে লেখা ছিল, ‘কোনো কথা বোলো না। তোমার গয়না খুলে এই খামে রাখো। পরে সব বলব।’

হতবাক পলিন মায়ের সঙ্গে মোটেলের ঘরে ঢোকেন। সেখানে স্ট্যান সিয়ার্স তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।

স্টান ও রিথ জানান, ১৬ বছর ধরে তাঁরা মাফিয়াদের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। পলিনের বাবা ওয়ারেন সংঘবদ্ধ অপরাধীদের সঙ্গে জড়িত। তাঁর কারণেই মাফিয়ারা তাঁদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে। স্ট্যান আরও বলেন, মাফিয়া দলের একজনকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে তিনি সাহায্য করেছিলেন। এ কারণেও মাফিয়ারা তাঁদের ওপর চটে যায়।

মাফিয়ারা এখন স্ট্যান ও রিথের ওপর হামলার ফন্দি আঁটছে। এ কারণে রিথকে নিয়ে আত্মগোপনে যেতে চান বলেও জানান স্টান।

মাফিয়াদের হাত থেকে বাঁচতে কানাডায় বেশ কিছু এলাকায় সরকারি টাস্কফোর্স অনুসারে নিরাপদ আবাসস্থলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এগুলো উইয়ার্ড ওয়ার্ল্ড বা রহস্যময় পৃথিবী নামে পরিচিত। সেখানেই আত্মগোপনে যেতে চাইলেন স্টান ও রিথ।

চমক ভাঙে পলিনের। এখন বুঝতে পারেন, কেন তাঁরা এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় ছুটে বেড়াতেন। কেন মা বাড়িতে জমে থাকা খাবার ফেলে দিতেন। কারণ, মায়ের ভয় ছিল মাফিয়ারা সেসব খাবারে বিষ মিশিয়ে দিতে পারে।

সব শুনে বাড়ি ফিরে যান পলিন। অজানা ভয় তাড়া করে ফেরে তাঁকে। স্ট্যান ও রিথ তাঁকে সতর্ক করে দিয়েছেন। মাফিয়ারা তাঁর ওপরও হামলা করতে পারে। পলিনকে বিশেষ ধরনের ট্রান্সমিটার দেওয়া হয়েছে। বিপদে পড়লেই সেটি দিয়ে পলিন সংকেত দেবেন। তাঁকে উদ্ধারে এগিয়ে আসবে অনেকে।

পলিনের সব সময় মনে হতো, কেউ তাঁর পিছু নিচ্ছে। রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়ে মনে হতো, বিষ মেশানো নেই তো? স্ট্যান ও রিথ গোপন জায়গা থেকে বারবার পলিনকে সতর্ক করতেন। পলিন যাদের সঙ্গে মেশেন, তাদের অনেকেই মাফিয়া চক্রের সদস্য—এমনটাও বলা হতো। বলা হতো, পলিনের পরিচিতদের অনেকেই ছদ্মবেশে রয়েছে।

এসবের মধ্যেই পলিনের ভাইয়ের বিয়ে হয়। বিয়েতে অনেক বছর পর বাবার সঙ্গে দেখা হয় পলিনের। দেখা হয় তাঁর মায়ের বোনের সঙ্গেও। পলিনের মাও আসেন ওই বিয়েতে। তিনি বারবারই বলতে থাকেন, পলিনের বাবা ও খালা নকল। মাফিয়ারা তাঁদের ছদ্মবেশ নিয়ে রয়েছে।

এবার একটু খটকা লাগে পলিনের। ভাবেন এও কি সম্ভব? সন্দেহটা ক্রমেই ঘনীভূত হতে থাকে পলিনের। হিসেবে গরমিল লাগে। ঠিক করেন, মায়ের সঙ্গে গিয়ে গোপন আস্তানায় থাকবেন।

পলিন চাকরি ছেড়ে দেন। বাড়ি বিক্রি করে দেন। এরপর মায়ের সঙ্গে আত্মগোপনে চলে যান। পলিনের ছেলেবন্ধু কেভিনও তাঁর সঙ্গে আত্মগোপনে যেতে রাজি হন। কেটে যায় আরও পাঁচ বছর। ১৯৯৩ সালে পলিন আবারও বড় ধরনের চমকের মুখে পড়েন।

পলিনের মা রিথ ও তাঁর সঙ্গী স্টান। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
পলিনের মা রিথ ও তাঁর সঙ্গী স্টান। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা, তা নিয়ে সন্দেহ ক্রমেই বাড়ছিল পলিনের মনে। একদিন পলিন নিজেই নিজের ঘরে ভাঙচুর চালান। মাকে বলেন, কেউ তার ঘরের ভাঙচুর চালিয়েছে। মা স্টানকে সব জানান। স্ট্যান বারবার পলিন ও তাঁর মাকে পুলিশকে কিছু জানাতে নিষেধ করেন। বিষয়টি তিনি নিজেই তদন্ত করবেন বলে জানান।

স্টান জানান, পলিনের ঘরে ঢুকে মাফিয়ারা হামলা ও ভাঙচুর চালিয়েছে। এবার পলিন বুঝতে পারেন, পুরো ব্যাপারটাই ধোঁকাবাজি। কারণ, ভাঙচুরটা তিনি নিজেই চালিয়েছিলেন।

পলিন মাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, স্টান তাঁদের ভুল বোঝাচ্ছেন। কিন্তু মা কিছুতেই তা মেনে নেননি।

স্টান কেন এমন ধোঁকাবাজি করে যাচ্ছেন—তার উত্তর খুঁজতে শুরু করেন পলিন। এতে স্টানের কোনো স্বার্থ খুঁজে পান না। স্টানের কিছু কিছু আচরণ পলিনের অস্বাভাবিক বলে মনে হয়। পলিন শরণাপন্ন হন মনোবিদের। মনোবিদ জানান, পুরো ঘটনাটিই স্টানের কল্পনা। বাইরে থেকে স্টানকে স্বাভাবিক মনে হলেও আসলে তিনি ফলিডিয়াক্স রোগে আক্রান্ত। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি অলীক কল্পনার জগতে বাস করেন। চারপাশের সবাইকে শত্রু মনে করেন।

কিন্তু কয়েক মাস চেষ্টা করেও মাকে সে কথা বোঝাতে পারেননি পলিন। বুঝতে পারেন, মাকেও স্ট্যান অনেক ধোঁকা দিয়েছেন। মা একধরনের মানসিক রোগে ভুগছেন।

স্ট্যানকে কেন্দ্র করে পলিন ও তাঁর মায়ের সম্পর্ক আর কখনো স্বাভাবিক হয়নি। পলিনের বিয়ে হয়। সন্তানও হয়। এরপর সম্পর্ক কিছুটা স্বাভাবিক হয়। কিন্তু রিথ কখনোই স্টানকে অবিশ্বাস করেননি।

২০১০ সালে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান রিথ। শেষ নয় মাস তিনি মেয়ের কাছে এসে থাকেন।

রিথ মারা যাওয়ার আগেই পরলোকে যান স্ট্যান। তাঁর মৃত্যুর পর থেকে গোপন আস্তানা থেকে আর কোনো চিঠি আসত না। মাফিয়াদের আনাগোনা নিয়ে কোনো খবরও আসত না। কিন্তু রিথ প্রবলভাবে বিশ্বাস করতেন, মাফিয়ারা তাঁদের ওপর নজর রাখছে। মৃত্যুর সময়ও বারবার পলিনকে সতর্ক করেন তিনি।

চার বছর আগে চিকিৎসা সাময়িকীতে মনোরোগ নিয়ে একটি লেখা পড়েন পলিন। দেখা করেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে। বোঝেন, ডিলুজন ডিসঅর্ডার রোগে ভুগছিলেন স্ট্যান।

স্ট্যানের এই মনোরোগের জন্য পলিন ও তাঁর মায়ের জীবন আকাশে কালো মেঘ নেমে এসেছিল। মা রিথের কথা ভেবে এখনো মনটা দুঃখে ভরে যায় পলিনের। নিজের ও তার ভাইয়ের জন্যও দুঃখ হয়। কারণ, বড়দের এই জটিলতার চাপে পড়ে তাদের জীবন হয়ে গিয়েছিল নিষ্প্রভ।

পলিন ডেকিন কানাডার ন্যাশনাল ব্রডকাস্টার সিবিসিতে অনেক বছর ধরে কাজ করেছেন। এখন তিনি কানাডার হ্যালিফ্যাক্সের ইউনিভার্সিটি অব কিংস কলেজে শিক্ষকতা করেন। ‘রান, হাইড, রিপিট: আ মেমোয়ের অব আ ফিউজিটিভ চাইল্ডহুড’ বইয়ের লেখকও তিনি।

বিবিসি অবলম্বনে শুভা জিনিয়া চৌধুরী