পরিবর্তনের অসাধারণ গল্প

ঈদের সাজে পরিবারের সঙ্গে উপস্থাপিকা ও ব্যবসায়ী ফাতেমা শাহাব রুমা
ঈদের সাজে পরিবারের সঙ্গে উপস্থাপিকা ও ব্যবসায়ী ফাতেমা শাহাব রুমা

দেশ ছেড়ে প্রায় দুই যুগ আগে এই দূরদেশে এসেছি। তখন নিউইয়র্ক শহরে ঈদের দিন ঈদের কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যেতো না। সবকিছু প্রতিদিনের মতোই স্বাভাবিক নিয়মে এগিয়ে যেত। রোজকার মতোই সকালে ঘুম থেকে উঠে ঢুলুঢুলু চোখে কর্মস্থলে যেতাম। বিকেলে ঠিক সন্ধ্যা নামার আগে বাড়ি ফিরতাম। রাতের খাবার শেষে ক্লান্ত দেহ এলিয়ে দিতাম বিছানায়। আমাদের নিরানন্দের ঈদ যখন শেষ হতো, তখন বাংলাদেশে ঈদের সকাল। ফোনে কথা বলা ব্যয়বহুল বলে বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা হতো সামান্যই। আম্মা কী শাড়ি পরেছে, কী কী আইটেম রেঁধেছে, পাড়া, প্রতিবেশী, বন্ধু ও আত্মীয়দের কারা কারা আসবে, এমন কিছু কৌতূহলী প্রশ্ন করতাম। আমার ব্যস্ত মা হরহর করে উত্তর দিতেন। আমার না থাকা নিয়ে দীর্ঘশ্বাস নিতেন। ফোনের এই প্রান্ত থেকে আমি তা স্পষ্টই শুনতে পেতাম। আমাদের মা-মেয়ে দুজনেরই গলা ধরে আসত। কথা আর বেশি দূর এগোত না। ফোন রেখে বাতি নিভিয়ে অন্ধকারে মা-বাবা, ভাইবোনের সঙ্গে কাটানো ঈদ স্মৃতি হাতরে বেড়াতাম। মুহূর্তেই বন্ধ চোখের সামনে ভেসে উঠত বাবা-মায়ের হাত ধরে ট্রেনে চড়ে গ্রামে দাদার বাড়ির উদ্দেশ্যে ঈদ করতে যাওয়া এক বালিকার ছবি।
নতুন জামা পরে খুব ভোরে বাবা-চাচার হাত ধরে ঈদগায় যাওয়া, মুরালি কেনা, বাঁশের বাঁশি, মাটির খেলনা কেনা—আরও কত কী! ভাবতে ভাবতে কখন যে নিদ্রাদেবীর কোলে ঢলে পড়তাম! সকালের আলোয় ঈদ নীরবে এসে দুপুর গড়িয়ে রাতের অন্ধকারে নীরবেই বিলীন হয়ে যেত। শুধু আমরা দেশ ছেড়ে আসা কিছু মানুষ দূরে, বহুদূরে রেখে আসা প্রিয়জনদের স্মরণ করে, ফোনে কথা বলে, অশ্রুজলে দিনটি কাটিয়ে দিতাম। কয়েক বছর বাদে এ দেশে কিছু বন্ধু হলো। তখন আমরা বন্ধুরা মিলে ঘরোয়াভাবে ঈদের উৎসব করতাম। দেশ থেকে কেউ এলে ঈদের নতুন জামা, শাড়ি আনিয়ে রাখতাম। বাড়িতে ভালোমন্দ রান্না হতো। ক্যাসেট ভাড়া করে এনে বাংলা কিংবা হিন্দি সিনেমা দেখে ঈদের আনন্দ উপভোগ করতাম। একবার ঈদে শাড়ি আর পাঞ্জাবি পরে আমরা স্বামী-স্ত্রী যাচ্ছিলাম বন্ধুর বাসায়। খুব অস্বস্তি নিয়ে লক্ষ করলাম, পথে বিদেশিদের অনেকেই অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছেন আমাদের, যেন আমরা আজব কোনো পোশাক পরেছি। কেউ কেউ আমরা ভারত বা পাকিস্তান থেকে এসেছি কিনা জানতে চাইতো। খুব গর্বের সঙ্গে বলতাম, আমরা বাংলাদেশি। বাংলাদেশ যে এশিয়ার স্বাধীন সার্বভৌম একটি দেশ, সে কথাও বলতে ভুলতাম না।
এখন এত বছর বাদে আমার শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া মেঘনার স্রোতোধারার ন্যায় সময় বয়ে গেছে অনেক দূর। দুবছর হয় ঈদ উপলক্ষে নিউইয়র্ক শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকে। ভিনদেশি শিক্ষার্থীরা জানে ঈদ মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসবের দিন। বিষয়টি আমাদের জন্য বেশ আনন্দ ও স্বস্তির। বাড়তি আনন্দ নিয়ে মুসলমানদের ঘরে ঘরে ঈদ আসে এই বিদেশ বিভুঁইয়ে। বাঙালি অধ্যুষিত জ্যাকসন হাইট্‌স হয়ে উঠে কোলাহল মুখর। রং-বেরঙের আলোকসজ্জায় সাজানো হয় পুরো এলাকা। পবিত্র রমজানের শেষের দিকে মধ্যরাত অবধি দোকানপাট খোলা থাকে। বাঙালি, ভারতীয়, পাকিস্তানি দোকানগুলোতে মূল্যছাড়ের অফার থাকে। গ্রোসারিগুলোতে লম্বা লাইন লেগে থাকে। ভিড় থাকে পারলারগুলোতে। এমনকি বেশির ভাগ দর্জি বাড়িতেও রমজানের শুরুতে অর্ডার নেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। কেননা, নিউইয়র্কের কাছের দূরের শহর কিংবা গ্রাম থেকেও মানুষ আসে শপিংয়ের উদ্দেশ্যে। গত কয়েক বছর ধরে যেন খুব দ্রুতই বদলে গেছে আগের সেই চিত্র। চাঁদ রাতে জ্যাকসন হাইট্‌সে রাস্তার দুপাশে মেহেদি উৎসব হয় রাতভর। সব কাজ গুছিয়ে রাত দশটার পর আমরা বন্ধুরা একযোগে বেরিয়ে পড়ি দুহাতে মেহেদি দেওয়ার উদ্দেশ্যে। দীর্ঘসময় লাইনে দাঁড়িয়ে মেহেদি দিই, জটলা করে রাস্তার পাশের দোকান থেকে চা পান করি, অনেকটা আমাদের দেশের টং দোকানে দাঁড়িয়ে চা পান করার মতন। সে অন্যরকম এক অনুভূতি!

ফাতেমা শাহাব রুমা
ফাতেমা শাহাব রুমা

বাড়ি ফিরি মধ্যরাতে। দুই ঘণ্টা ঘুমিয়েই আবার উঠে যেতে হয়। বাচ্চাদের তৈরি করে সঙ্গে নিয়ে নামাজের উদ্দেশ্যে ছুটি। যাওয়ার সময় পুরোটা পথজুড়ে পাঞ্জাবি-পায়জামা-টুপি পরা, জায়নামাজ হাতে মানুষের ঢল দেখা যায়। এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য, ভিন্ন আমেজ। মসজিদগুলোতে স্থান সংকুলান হয় না বিধায় কোথাও কোথাও রাস্তায় যানবাহন চলাচল বন্ধ রেখে ঈদের নামাজ হয় দফায় দফায়। কোথাওবা স্কুলের বিশাল মাঠে নামাজ আদায় করা হয়। দিনব্যাপী এখানে-ওখানে দলে দলে শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ পরিহিত নারীদের বেড়াতে যেতে দেখা যায়। আমরা বন্ধুরা বাচ্চাদের নিয়ে সারা দিনই একে অন্যের বাসায় বেড়াতে যাই। আত্মীয়-স্বজনহীন এই ভিনদেশে বন্ধুরাই তো আমাদের পরিবার হয়ে উঠেছে। সবচেয়ে বড় আনন্দের বিষয়, আমাদের সন্তানেরা ঈদের আনন্দ উপভোগ করে সকাল থেকে রাত্রি অবধি। বিদেশ বিভুঁইয়ে জীবনে এমন এক পরিবেশে ঈদ হবে—তা দুই যুগ আগে স্বপ্নেও ভাবিনি। নিঃসন্দেহে এটি পরিবর্তনের অসাধারণ এক গল্প। যে গল্প পাঠ শেষে অপার আনন্দে বুক ভরে শ্বাস নেওয়া যায়। এক সময়ের ‘কোথাও কেউ নেই’ এর দেশে আমাদের নতুন প্রজন্মকে নিয়ে এমন ঈদ মানে আমার কাছে বিশাল এক স্বাধীনতা, সারা বিশ্বেই বাংলাদেশ খুঁজে পাওয়া।
হাসি আনন্দে ঈদের পুরো একটি দিন শেষ হয়ে এলেও কোথাও যেন খাঁ খাঁ শূন্যতা আর একাকিত্ব পেয়ে বসে। খুঁজে ফিরি প্রিয়মুখগুলোকে। এক জোড়া বিষণ্ন চোখে খুঁজে ফিরি আমার মধ্যবিত্ত স্বপ্নপুরকে। আমার রেখে আসা রাশি রাশি স্মৃতিকে। প্রবাসীরা জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে, বাস্তবতার তাগিদে দেশ ছেড়ে এই দূর দেশে অবস্থান করছে হয়তো। তাঁদের সারা বছর কর্মব্যস্ততায় কেটে যায়। দেশে রেখে আসা পরিবার আর স্বজনদের অর্থ পাঠিয়ে ভালো রেখে আনন্দ পায়। কিন্তু বিশেষ দিনগুলোতে মনের গহিনের হাহাকার তীব্র হয়ে উঠে। মন যেন বলে, ফিরে যাই, ফিরে যাই। আমাদের আর ফেরা হয় না কোনদিন। সত্যিই ফেরা হয় না। শুধু সবার অগোচরে ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’ গানটি শোনা হয়ে যায় বহুবার...
মন বলে চল্‌ ফিরে আবার
স্বপ্ন যাবে বাড়ি আমার...