ট্রাম্পের ছিঁড়ে ফেলা নথি, চিঠি জোড়া লাগাতেন তাঁরা!

ডোনাল্ড ট্রাম্প । ছবি: রয়টার্স
ডোনাল্ড ট্রাম্প । ছবি: রয়টার্স

টেবিলে ছড়ানো টুকরো টুকরো কাগজ। সেগুলো স্বচ্ছ স্কচটেপ দিয়ে জোড়া লাগাচ্ছেন একদল মানুষ। গভীর মনোযোগ রাখতে হচ্ছে, যাতে স্কচটেপ দিয়ে টুকরোগুলো ঠিকঠাক জোড়া লাগানো যায়। 

ছেঁড়া কাগজ যখন জোড়া লাগানো হচ্ছে, তখন বুঝতেই হবে কাগজটি জরুরি। তবে প্রশ্ন থেকে যায়, কতটা জরুরি? এটা পাশের দোকান থেকে আনা সওদাপাতির হিসাব নাকি ধোপার বিল? নাকি বাড়ির দলিল, শিক্ষাজীবনের সনদ বা অফিসের গুরুত্বপূর্ণ নথির মতো জরুরি কিছু? এরপরের প্রশ্নটি আসে—এমন জরুরি কাগজ ছেঁড়া হলো কেন? আর কাজে লাগবে না, এটা ভেবেই কি ছিঁড়ে ফেলা হয়েছিল, নাকি মনের ভুলে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। এরপরের প্রশ্নটি হয়তো সবচেয়ে গুরুত্ব বহন করে। কে এমন কাজ করলেন? এই পর্যায়ে এসে নামটি শুনে অনেকে চমকে যেতে পারেন। কেউ বিস্মিত হতে পারেন এই পর্যায়ের একজন ব্যক্তি এমন কাণ্ড করেন কীভাবে, সেটি ভেবে। আবার অনেকে মুখ টিপে হেসে বলতে পারেন, তাঁর পক্ষে ‘সবই সম্ভব’।

নথি, কাগজপত্র হরদম ছিঁড়ে ফেলা এই ব্যক্তি আর কেউ নন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। নিয়ম অনুসারে, মার্কিন প্রেসিডেন্টদের প্রত্যেকটি কাগজ সংরক্ষণ করতে হয়। আর এ কারণে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছিঁড়ে ফেলা কাগজ পরম যত্নে জোড়া লাগানো হয়।
ট্রাম্পের ছিঁড়ে ফেলা কাগজপত্র জোড়া লাগাতেন এমন দুজন ব্যক্তির বয়ানে উঠে এসেছে এ তথ্য।

বছরের প্রথম পাঁচ মাস ওল্ড এক্সিকিউটিভ অফিস বিল্ডিংয়ে ট্রাম্প প্রশাসনে রেকর্ড ব্যবস্থাপনা বিশ্লেষক হিসেবে এ কাজ করেছেন সলোমন লারটি (৫৪)। আর এ কারণে তাঁকে বছরে বেতন দিতে হয়েছে ৬৫ হাজার ৯৬৯ ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় তা ৫৫ লাখ ৬১ হাজার টাকার বেশি। সরকারি চাকরির ৩০ বছরের অভিজ্ঞতা ছিল তাঁর। কিন্তু চাকরিজীবনে এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি তাঁকে কখনো হতে হয়নি বলে জানিয়েছেন তিনি। প্রেসিডেন্টের ছিঁড়ে ফেলা কাগজের টুকরো তিনি কখনো এভাবে জোড়া লাগাননি।

রাজনীতিবিষয়ক মার্কিন সংবাদমাধ্যম পলিটিকোর খবরে বলা হয়, সহকর্মীদের নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছিঁড়ে ফেলা কাগজের টুকরা একত্রে জোড়া লাগাতেন লারটি। তাঁর ভাষায়, এটা ‘পাজল মেলানোর মতো’। ছেঁড়া কাগজগুলোর অনেকগুলো শুধু ওপর-নিচে দুই ভাগে ছিঁড়ে ফেলেন ট্রাম্প। তবে অনেক কাগজ এতই টুকরা টুকরা করা হয় যে সেগুলোকে অতিথি বরণে মাথার ওপর ছিটিয়ে দেওয়া রঙিন কাগজের টুকরোর মতো লাগে।
কাগজ ছেঁড়ার ট্রাম্পের এই বাতিকের সঙ্গে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা।

মার্কিন প্রেসিডেনশিয়াল রেকর্ড অ্যাক্ট অনুসারে, প্রেসিডেন্টের হাতের স্পর্শ পাওয়া যেকোনো মেমো, চিঠি, ই-মেইল ও কাগজপত্র ঐতিহাসিক রেকর্ড হিসেবে নিরাপদে রাখার জন্য দেশটির জাতীয় আর্কাইভে পাঠানো হয়। কিন্তু হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারা কোনো অবস্থাতেই কাগজ ছেঁড়া থেকে ট্রাম্পকে বিরত রাখতে পারছেন না। ট্রাম্প কাগজগুলো পড়া হয়ে গেলেই স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে তা ছিঁড়ে ফেলে ঝুড়িতে বা মেঝেতে ফেলে দেন। তাঁর এ স্বভাবের সঙ্গে এখন অভ্যস্ত তাঁর স্টাফরা। প্রেসিডেন্ট আইন অমান্য করছেন না এই নিশ্চয়তা দিতে তারা কাগজের টুকরোগুলো ঝুড়ি বা মেঝে থেকে তুলে নিয়ে জোড়া লাগানোর জন্য পাঠান। শুধু ওভাল অফিস নয়, ট্রাম্পের ব্যক্তিগত বাসভবন থেকেও তারা তাঁর ছিঁড়ে ফেলা কাগজ সংগ্রহ করেন।

লারটি বলেন, স্বচ্ছ স্কচটেপ দিয়ে কাগজগুলো জোড়া লাগানোর পর সুপারভাইজারের কাছে ফেরত দেওয়া হতো। সেগুলো ঠিকমতো ফাইল করে রাখার জন্য জাতীয় আর্কাইভে পাঠাতেন স্টাফরা।
লারটি জানান, তাঁর কাছে আসা এমন কাগজগুলোর মধ্যে ছিল ট্রাম্পের হিজিবিজি করে লেখা কিছু নোট, বৃত্তাকার শব্দ, আমন্ত্রণপত্র, আইনপ্রণেতাদের কাছ থেকে পাওয়া চিঠি। এর মধ্যে সিনেটে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতা চাক শুমারের চিঠিও ছিল। শুমারের চিঠিটি এতটাই টুকরো টুকরো অবস্থায় ছিল, তা দেখে বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলেন লারটি।

লারটির সঙ্গে কাজ করেছেন রেজিনাল্ড ইয়াং জুনিয়র (৪৮)। তিনি জ্যেষ্ঠ রেকর্ড ব্যবস্থাপনা বিশ্লেষক হিসেবে ছিলেন ওই দলে। তিনি বলেন, তাঁর দুই দশকের বেশি সময়ের সরকারি চাকরিজীবনে এমন ঘটনা কখনো ঘটেনি। এ কাজ করতে হবে জেনে অবাক হয়ে পরিচালককে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তোমরা আসলেই এ কাজ করতে বলছ? বছরে আমরা ৬০ হাজার ডলারের বেশি পাই। এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ আমাদের করা উচিত।’ তিনি বলেন, ‘কাজের সবচেয়ে খারাপ কিছু মনে হচ্ছিল এটাকে।’

তবে লারটি আর রেজিনাল্ড কেউই এখন আর ওই দলে নেই। তাঁদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। কেন তাঁদের চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, সে সম্পর্কেও জানেন না তাঁরা।
লারটি জানান, অবসরের দ্বারপ্রান্তে এসে তাঁকে এভাবে চাকরিচ্যুত হতে হবে ভাবেননি। গত ২৩ মার্চ তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। চিঠিতে লেখা হয়েছিল, আরও ভালো চাকরির জন্য তিনি পদত্যাগ করছেন। অথচ তিনি এখনো বেকার।
রেজিনাল্ড জানান, ১৯ এপ্রিল তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। চিঠিতে পদত্যাগ করেছেন উল্লেখ থাকায় তিনি প্রতিবাদ করেন। পরে সেখানে পদত্যাগের পরিবর্তে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।

ওই দুজনের চাকরিচ্যুতির বিষয়ে মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান আইরিন পোরাদার কাছে পলিটিকো ই-মেইলে মন্তব্য চেয়ে অনুরোধ করলেও তিনি এতে সাড়া দেননি। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাগজপত্র ছেঁড়ার এ অভ্যাস সম্পর্কে হোয়াইট হাউসের মুখপাত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
লারটি ও রেজিনাল্ড জানান, এর ঠিক বিপরীত চিত্র ছিল ওবামা প্রশাসনের। একটি সুনির্দিষ্ট কাঠামোর ও প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে রেকর্ড ব্যবস্থাপনা চলত।

এ ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ফার্স্ট স্টাফ সেক্রেটারি লিসা ব্রাউন বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট ওবামা কখনো কোনো জিনিস ছুড়ে ফেলে দিয়েছেন, এমনটা আমি মনে করতে পারি না। ওভাল অফিসে যত কাগজপত্র যেত, এর সবই আবার সেভাবে ফেরত এনে সংরক্ষণ করা হতো।’
তিনি বলেন, ‘বারাক ওবামা কাগজপত্র সংরক্ষণের ব্যাপারে খুব সজাগ ছিলেন। আমার মনে আছে, একবার তিনি নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে বক্তব্য হাতে লিখেছিলেন। সেই হাতে লেখা কাগজটি তিনি আমার কাছে পাঠান সংরক্ষণের জন্য। যদিও নির্বাচনী প্রচারে সময়ে দেওয়া বক্তব্য হোয়াইট হাউস বা আর্কাইভে সংরক্ষণের কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না।’