আমার দেখা নিউইয়র্ক বইমেলা

কেমন করে এতগুলো গৌরবোজ্জ্বল বইমেলা অনুষ্ঠিত হলো। বিশ্বের রাজধানী খ্যাত নিউইয়র্ক শহরে কত জ্ঞানী-গুণী কবি-সাহিত্যিক মেলার উদ্বোধন করে আমাদের ধন্য করলেন, মুগ্ধ করলেন! মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের বিশ্বজিৎ সাহা ছোট একটি মোমবাতির শিখাকে আজ এক মশালের রূপ দিয়েছেন। বাঙালি আজ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। আর যেখানেই বাঙালি নোঙর ফেলেছে, সেখানেই বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে তার মধ্যে লালিত ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি প্রেম ও মমত্বের প্রকাশ ঘটেছে। আর বাঙালির চিরায়ত প্রেমের প্রকাশটিই ঘটেছে বিশ্বজিৎ সাহার হাত ধরে। তিনি প্রতিনিয়ত তাঁর স্বপ্নের প্রতি নিবেদিত থেকেছেন। তাঁকে জানাই শ্রদ্ধা।
বাংলাদেশের মুক্তধারা— পুরোনো ঢাকার ফরাশগঞ্জে যার জন্ম ও বিস্তার, তাকেই বিশ্বজিৎ সাহা নিয়ে এসেছেন নিউইয়র্কের বাস্তবতায়। সেই একই মমতায় মুক্তধারাকে প্রতিষ্ঠা করেছেন এখানে, আমার মতো ক্ষুধার্ত পাঠকের জন্য যা আশীর্বাদ।
১৯৯৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি এই শহরে প্রথম এসেই আবিষ্কার করি নিউইয়র্কে বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার একটি বিশাল মাঠ রয়েছে। বিশ্বজিৎ সাহার মতো নিবেদিত এক প্রাণ পুরুষ আছেন এখানে, যার ধ্যান, জ্ঞান, সাধনা, বাঙালির ভেতরে যে সুষমা, লালিত্য এবং ভাষা ও বই প্রেম জাগিয়ে তোলা। আমি তখন নতুন এখানে। মনে পড়ে, ১৯৯৫ সালের বইমেলা উদ্বোধন করলেন পূরবী বসু। সেটিই এখানে আমার দেখা প্রথম বইমেলা। নিউইয়র্কে এমন জমজমাট বইমেলা হয়, তা স্বচক্ষে না দেখলে বুঝতাম না। ওই বছর সম্ভবত মে মাসে মেলাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কত বাঙালির আনাগোনা বইমেলায়। শুধু বাংলাদেশি বাঙালি নয়, পশ্চিম বাংলার বাঙালিরাও মেলায় এসেছেন। আমাদের বাঙালিরা, বইমেলার কথা শুনলে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসবেন; এটিই স্বাভাবিক।
মেলায় যেমন নতুন বইয়ের গন্ধ থাকে, তেমনি অনেক কবি সাহিত্যিক তাঁদের নানান কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মেলাকে করে তোলেন বর্ণাঢ্য। কবিতা পাঠ, সেমিনার, সংগীত, নাটকসহ নানা আয়োজনে মেলাকে বর্ণিল করে তোলেন তাঁরা।
নিউইয়র্কে এসেই তখন স্থানীয় পত্রিকাগুলোতে লিখতে শুরু করি। মেলায় পরিচয় হয় আরও অনেক লেখক-লেখিকাদের সঙ্গে। নির্মল আনন্দে মন ভরে যায়। দেখি আপাদমস্তক বাংলাপ্রেমী মানুষদের, বাংলাদেশের মৃত্তিকার পরশ যার বুকের ভেতর দুলে ওঠে, যিনি স্বপ্ন দেখেন নতুন প্রজন্মের মুখে বাংলা বর্ণমালার সুর তুলে দেওয়ার। অবাক হই দেখে, মেলার নানা আয়োজন দেখে। এ দেশে জন্ম হওয়া, বেড়ে ওঠা প্রজন্মের জন্য বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির নানান বিষয়ে প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয় সেখানে।
মনে পড়ে, পূরবী বসু ফিতা কেটে মেলার উদ্বোধন করলেন। ১৯৯৫ সাল; আমি দুলে উঠি, কেঁপে উঠি। নারীর অগ্রগতি, সম্মান, মূল্যায়ন আমার আরাধ্য। মনে মনে বিশ্বজিতের দূরদর্শিতাকে অভিনন্দন জানাই। সেই থেকে বইমেলার পাশে ছায়ার মতো আছি। মনে মনে বলি ভালোবাসি, ভালোবাসি বইমেলা তোমাকে।
১৯৯৬ সালে মুক্তধারার বইমেলার উদ্বোধন করেন লন্ডন থেকে আগত বরেণ্য সাংবাদিক ও একুশে ফেব্রুয়ারির অমর গানের রচয়িতা আবদুল গাফফার চৌধুরী। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি!’ সেই আমার কাছ থেকে প্রথম আবদুল গাফফার চৌধুরীকে দেখা। শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে আমার। কথা শুনি মুগ্ধ হয়ে।
এক একটি মেলার রূপ, রস, বর্ণ এক-এক রকম। সবকিছুর মধ্যেই বাংলাদেশ। বাংলা ভাষা, বাংলার সুর, যা আন্দোলিত করে হৃদয়কে। বড় বড় স্বনামধন্য লেখক কলকাতা থেকে, বাংলাদেশ থেকে আসছেন। তিন দিনব্যাপী মেলা হচ্ছে। প্রতিদিনই যাই, মেলা থেকে পছন্দের বই কিনি।
১৯৯৭ সালে বইমেলা উদ্বোধন করতে আসেন বাংলাদেশে থেকে হুমায়ূন আহমেদ। আকাশছোঁয়া জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদকে মেলায় পেয়ে সে বছর দর্শক সমাগম হয় অনেক বেশি। আমেরিকায় হুমায়ূন আহমেদের পাঠকের অভাব নেই। অটোগ্রাফ নিয়ে প্রিয় লেখকের বই কিনে পাঠকেরা ধন্য হচ্ছে; চেয়ে চেয়ে দেখি। হুমায়ূন আহমেদ একের পর এক সিগারেট ফুঁকেই যাচ্ছেন। ছবি তোলার জন্য হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে নারীদের আগ্রহ দেখে বিষম খাই। এদিকে মঞ্চে গান পরিবেশিত হচ্ছে। কবিতা পাঠে অংশগ্রহণ করছি। মনে হয় ঢাকায় আছি। কত খ্যাতিমান শিল্পী আছেন এখানে; ঢাকা ও পশ্চিম বাংলা থেকেও আমন্ত্রিত শিল্পীরা আসছেন।
১৯৯৮ সালে প্রবাসী পত্রিকার সম্পাদক সৈয়দ মোহাম্মদউল্লা বইমেলার উদ্বোধন করেন, যিনি সুদূর প্রবাসে অধুনালুপ্ত প্রবাসী পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
এখন পর্যন্ত প্রতিটি মেলায় অংশগ্রহণ করে সীমাহীন আনন্দ পেয়েছি। অবাক হতাম বিশ্বজিৎ দাদার পরিশ্রমের মাত্রা দেখে। আসলে বইমেলাকে বেগবান রাখার জন্য শক্তিশালী কিছু মেধাবী মানুষ বরাবর সহযোগিতা করেছেন। করছেন একেক সময় এক জায়গায় মেলার আয়োজন। এসব জায়গায় মেলা করা শুরুতে সহজসাধ্য ছিল না।
১৯৯৯ সালে বইমেলার উদ্বোধন করেন দিলারা হাশেম। সেটিও আমার কাছে অনন্য এক মেলা। দিলারা হাশেম আপা আমাকে অপার স্নেহে ভরিয়ে দিলেন। এর কয়েক বছর পর ওয়াশিংটন ডিসিতে ভয়েস অব আমেরিকায় কর্মরত দিলারা হাশেম বইমেলায় এলে আপাকে আমি মেলা শেষে রাত্রিযাপনের জন্য বাসায় নিয়ে আসি। আপাকে পেয়ে কী যে ভালো লেগেছিল! বাড়ি যেন আমার ধন্য হলো। দিলারা হাশেম আপাকে আপ্যায়নের জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠি। এসবে মন নেই আপার। আমাকে বলেন, ‘বস তো মেয়ে। আমার জন্য অস্থির হতে হবে না। শোন নাসরিন, লেখালেখির জন্য লাইব্রেরিতে চলে যাবে। সেখানে মনোযোগ দিয়ে লিখতে পারবে। সংসারের কাজে তোমার এত নিবেদিত হবার দরকার নেই।’ ফিরে যাওয়ার সময় এল আপার। দুজনে মিলে ম্যানহাটনে আপাকে মেরিল্যান্ডের বাসে তুলে দিয়ে এলাম।
২০০০ সালে ভাষা সৈনিক আবদুল মতিন মেলা উদ্বোধন করলেন। দেশের বরেণ্য কৃতি সন্তানদের মাধ্যমে বইমেলা উদ্বোধন করে মুক্তধারা ফাউন্ডেশন তাদের যে সম্মান জানিয়েছে, তা তুলনাহীন। এত এত আলোকিত ও বরেণ্য লেখক, ভাষা সৈনিক, শিক্ষক, সংগীত শিল্পীর সমাগম ঘটেছে এখানে, যা এই মেলাকে সত্যিই অনন্য করেছে। ওই বছরের মেলায় ভাষা সৈনিক আবদুল মতিন তাঁর উদ্বোধনী বক্তব্যে নিউইয়র্ক বইমেলার ভূয়সী প্রশংসা করেন।
২০০১ সালে দশম বইমেলায় উদ্বোধক ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি একাই যথেষ্ট ছিলেন মেলাকে বর্ণিল করতে। কিন্তু সে বছর যেন সবকিছুকে ছাড়িয়ে যাওয়ার জন্যই এসেছিল। মেলায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদ, সমরেশ মজুমদার ও ইমদাদুল হক মিলন। প্রতিটি মেলায় নতুন প্রজন্মের জন্য ছিল বাংলা রচনা প্রতিযোগিতা, গান, কবিতা আবৃত্তি, নাচের প্রতিযোগিতা। এ সমস্ত প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানগুলোতে কখনো বিচারক, কখনো পরীক্ষক হিসেবে কাজ করেছি আমি। তখন অনুভব করেছি আমাদের প্রজন্ম কতটা মেধাবী। রচনা লেখা প্রতিযোগিতা; সে তো অসাধারণ! বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশকে চেনানোর জন্য অক্লান্ত চেষ্টা করেছে মুক্তধারা ও এর অবিচ্ছেদ্য অংশ বিশ্বজিৎ সাহা। তিনি বাতিটি জ্বালিয়েছিলেন বলেই তা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়েছে।
২০০২ সালে বইমেলা উদ্বোধন করেন ড. হুমায়ূন আজাদ। সে বছর আগামী প্রকাশনী থেকে আমার ছোটগল্পের বই প্রকাশিত হয় একাকী একজন। সে বছর আগামী প্রকাশনীর ওসমান গনিও মেলায় অংশ নেন। হ‌ুমায়ূন আজাদ আমার স্যার। মনে পড়ে, এমএ পড়ার সময় বাংলা বিভাগ থেকে পিকনিকে গিয়েছিলাম। স্যারও ছিলেন মধুপুরের সেই বিখ্যাত পিকনিকে। সে এক অনন্য স্মৃতি।
বিশ্বজিৎ দাদা হ‌ুমায়ূন স্যারের জন্মদিন পালন করেন মুক্তধারায়। সেই জন্মদিন অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলাম। আহা কী মধুর স্মৃতি জমা থাকে বুকে! তার পরের বছরই বোধ হয় মুক্তমনা ও প্রথাবিরোধী লেখার জন্য ড. হ‌ুমায়ূন আজাদকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়।
ঢাকায় বাংলা একাডেমির বইমেলা ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হয়। একবারও যেতে পারি না। দুঃখ নেই। বিশ্বজিৎ সাহার মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের আয়োজিত বইমেলার আয়োজন ও শহীদ মিনার তৈরি করে আমাকে ভরিয়ে দিয়েছে, পূর্ণ করেছে, পিপাসা মিটিয়েছে। এখানে আসার পর এমন একটিও বইমেলা খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেটিতে যাইনি। বইমেলার জন্য তিনটি দিন রীতিমতো রূপোর কৌটায় ভরে সযতনে তুলে রাখি।
২০০৩ সালে বইমেলা উদ্বোধন করতে আসেন কলকাতা থেকে জয় গোস্বামী। সঙ্গে কবি রফিক আজাদ, ড. আবদুন নূর, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ও আনিসুল হক। এক একজন কবি সাহিত্যিক আসেন আলোর কণিকার মতো করে। আমরা মুগ্ধ; তৃপ্ত।
বইমেলা ধীরে ধীরে আমাদের চোখের সামনে পাপড়ি মেলতে মেলতে রূপ নিয়েছে মুক্তধারা ফাউন্ডেশন আয়োজিত আন্তর্জাতিক বইমেলায়। হাসান আজিজুল হক ২০০৯ সালে বইমেলার উদ্বোধক ছিলেন। সে এক অনুভূতি তাঁকে কাছ থেকে দেখার।
২০১২ সালে বইমেলা উদ্বোধন করেন শামসুজ্জামান খান। সে বছর আমার নীল দরোজা উপন্যাস প্রকাশিত হয়। বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন শামসুজ্জামান খান। সে এক আলোমাখা অধ্যায়।
মুক্তধারা আমাদের চোখের সামনে একের পর এক খ্যাতিমান সাহিত্যিককে উড়িয়ে নিয়ে এসেছে। এসেছেন কত শিল্পী। বইমেলার চেহারা বর্ণে, ছন্দে, আনন্দে কত পরিবর্তিত হয়েছে। হয়েছে আরও হৃদয়ছোঁয়া। বিশ্বজিৎ দাদা অনন্য এক মানুষ। তাঁকে শ্রদ্ধা, আমাদের অপেক্ষার তালিকায় বইমেলাকে যুক্ত করার জন্য।