মুখোমুখি বর্ষীয়ান চিত্রশিল্পী গোপেশ মালাকার

টরন্টোতে পাঠশালার আয়োজনে চিত্রশিল্পী গোপেশ মালাকার
টরন্টোতে পাঠশালার আয়োজনে চিত্রশিল্পী গোপেশ মালাকার

১৯ জুলাই সন্ধ্যা। এগলিনটন স্কয়ার টরন্টো পাবলিক লাইব্রেরিতে অনুষ্ঠান। বিষয় ‘বাঙালি সংস্কৃতির শেকড়ের সন্ধানে: ৫৮’র চারুকলা’। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, চারুশিল্পী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের প্রাক্তন শিক্ষক গোপেশ মালাকার এ পর্বের অতিথি।
গোপেশ মালাকার কথা বলেন বাঙালির সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার নিয়ে। তিনি নিজের জীবনের বিচিত্র ঘটনাবলি তুলে ধরেন এবং সংগ্রাম ও ইতিহাসের অনেক বিষয়ে আলোকপাত করেন। নান্দনিক ও সৃজনশীল অনুষ্ঠানটির আয়োজক প্রতিষ্ঠান পাঠশালা। এটি তাদের ৬ষ্ঠতম আসর। বিষয়ভিত্তিক চিন্তার খোরাক জোগানোর মতো নানা আয়োজনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি ইতিমধ্যে সুনাম কুড়িয়েছে।
সুনামগঞ্জের ছাতক স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় গোপেশ মালাকার কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য পরিচালিত ‘কিশোর বাহিনী’তে যোগ দেন। সেসময় ‘মুকুল ফৌজ’ নামেও একটি শিশু-কিশোর সংগঠন ছিল। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের পরে জয়নুল আবেদীনের করা স্কেচ নিয়ে যে প্রদর্শনী হয়, সেটির মূল উদ্যোক্তা ছিল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি। ৫০’র মন্বন্তরের সময় জয়নুল আবেদীনের ৩টি স্কেচ ও সুনীল জানার আঁকা ২টি ছবি দিয়ে পিকচার কার্ড ছাপানো হয়। তৎকালীন ছাত্র ফেডারেশন তা বিক্রির উদ্যোগ নেয়। সিলেটে সেই পিকচার কার্ড কয়েক হাজার বিক্রি হয়।
সেসময়ে গোপেশ মালাকার ছাতক থেকে গিয়ে সিলেটে কমিউনিস্ট পার্টির কার্যালয়ে থাকতেন। সে সময়ে ৩ টি ছাত্র সংগঠন ছিল: ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্র কংগ্রেস ও মুসলিম ছাত্র ফেডারেশন। জনসংযোগের অংশ হিসেবে ছাত্র ফেডারেশনের সদস্য গোপেশ মালাকার ছবি আঁকা, পোস্টার লেখা ও নাটকে অংশ নিতেন। তখন টাইফয়েড জ্বরের ওষুধ ছিল না, রোগাক্রান্ত হলে ক্রমাগত মাথায় পানি ঢালাই ছিল ওষুধ। রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে তাঁরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে টাইফয়েড রোগীদের মাথায় পানি ঢালায় সহযোগিতা করতেন। এ ছাড়া ফেডারেশনের তরফ থেকে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন ও দেশাত্মবোধক নাটক মঞ্চস্থ হতো।
গোপেশ মালাকার ৪৭’ সালে এসএসসি পাস করেন। দেশভাগের পর তিনি সর্ব-ভারতীয় ছাত্র ফেডারেশনের ডাকে কলকাতার কাউন্সিল মিটিংয়ে অংশ নেন। এই সভায় ভারত ও পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র ফেডারেশন দুই ভাগে ভাগ হয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়। জন্ম হয় পূর্ব বঙ্গ ছাত্র ফেডারেশনের। দেশ ভাগের পর পরই তাঁর বাবা-মা ভারতে পাড়ি জমান। অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি ভারতে না গিয়ে বাংলাদেশেই পড়ে থাকেন। পূর্ববঙ্গ ছাত্র ফেডারেশনের প্রথম অধিবেশন ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত হয়। শহীদুল্লা কায়সার প্রথম সেক্রেটারি হন। গোপেশ মালাকার সিলেট জেলার ছাত্র ফেডারেশনের সাংস্কৃতিক সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। অচিরেই ফেডারেশনের নেতাদের একে একে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁকেও যেতে হয় কারাগারে। শেষ পর্যন্ত ছাত্র ফেডারেশন আর টিকতে পারেনি।
ছবি আঁকায় গোপেশ মালাকারকে উৎসাহিত করেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস। সে সময়ে সিলেটের মফস্বলে নানকার আন্দোলন গড়ে ওঠে। সিলেটে এর প্রচারের দায়িত্ব পরে গোপেশ মালাকারের ওপর। নানকার আন্দোলনের প্রচারপত্র বিলি করার সময় তিনি প্রথম গ্রেপ্তার হন। জেলখানায় মনকে চাঙা রাখার জন্য কাঠ-কয়লা দিয়ে দেয়ালে বিদ্রোহের ছবি আঁকতেন তিনি। মূলত প্রেস অ্যাক্ট ও স্পেশাল অরডিন্যান্সে তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তার আগে জেলে যান বরুণ রায়, ভূপতি চক্রবর্তী ও চঞ্চল শর্মা। ছাত্র ফেডারেশনের পরে সিলেটেই প্রথম ছাত্র ইউনিয়ন গঠনের আওয়াজ ওঠে।
৫৬’ সালের সেপ্টেম্বরে গোপেশ মালাকার জেল থেকে ছাড়া পান। আতাউর রহমান তখন যুক্তফ্রন্টের মুখ্যমন্ত্রী। কারা ফটকে এসে তাঁকে গ্রহণ করেন রাজশাহী কারাগারের খাপড়া ওয়ার্ডে গুলিবিদ্ধ বন্ধু নাসির। নাসিরের মাকে গোপেশ মালাকার মাসি বলে সম্বোধন করতেন। এই মাসি হলেন জয়নুল আবেদীনের শাশুড়ি। তারপর ২৭ বছর বয়সে পড়ার জন্য ঢাকা গভ. আর্ট ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন। সেসময়ে কোনো ছাত্র সংসদ ছিল না; কিন্তু একটি ছাত্র কমিটি ছিল। তিনি ছাত্র কমিটির সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন। সেসময় আর্ট ইনস্টিটিউটকে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু মনে করা হতো।
৫৮’ সালে আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করেন। আর্ট ইনস্টিটিউটের শিক্ষকরাও রাজনৈতিকভাবে সংঘবদ্ধ হয়ে স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে কর্মসূচি নেওয়ার পরিকল্পনা শুরু করেন। এ কাজে নেতৃত্ব দেন শিল্পী জয়নুল আবেদীন ও কামরুল হাসান। ৫৮’ সালে সিদ্ধান্ত হয় বাংলার ঐতিহ্য নিয়ে বড় আকারে একটি প্রদর্শনী করা হবে ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গণে। গোপেশ মালাকার প্রদর্শনী কমিটির সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন। দীর্ঘ সময় ধরে প্রস্তুতি নিয়ে আয়োজিত হয় এই প্রদর্শনী; যা দর্শক ও বাঙালি জাতিকে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে আন্দোলিত করে। সংগ্রহ করা হয় নকশি কাঁথা, নকশি পিঠার ছাঁচ, বিভিন্ন হস্তশিল্প, লোকজ পোশাক, মৃৎপাত্র ও শাড়ি। শণের ঘরের ছাঁচে বাঁশ ও বেত দিয়ে তৈরি হয় মূল গেট। প্রবেশ পথে এই প্রথম আঁকা হয় আলপনা। প্রদর্শনীতে সমাগত দর্শকদের আপ্যায়ন করা হয় নকশি পিঠা ও মাটির ভাঁড়ে চা দিয়ে। প্রদর্শনীতে কামরুল হাসানের নকশা করা কলাবতী শাড়ি হট কেকের মতো বিক্রি হয়। ৫৮ সালেই প্রথম ইনস্টিটিউটের বকুল তলায় সভার আয়োজন করা হয়। ৫৮’র চারুকলা প্রদর্শনীর পরের বছর থেকে আলপনা আঁকার ঐতিহ্য আর্ট ইনস্টিটিউটের চৌহদ্দি পেরিয়ে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত পৌঁছায়। নকশি পিঠাও যে বাঙালি ঐতিহ্যের অংশ হতে পারে, ৫৮র চারুকলা প্রদর্শনীর মাধ্যমে তা প্রতিষ্ঠিত হয়। এভাবেই চারুকলা ইনস্টিটিউট বাঙালির সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়ায়। গোপেশ মালাকার বলেন, রাজনীতি ও সংস্কৃতি সর্বদা হাত ধরাধরি করে চলে; একটা থেকে আরেকটা বিচ্ছিন্ন নয়।
মিলনায়তন ভর্তি দর্শক উপভোগ করেন শিল্পী গোপেশ মালাকারের কথা। তাঁদের নানা প্রশ্নের উত্তর দেন শিল্পী। ‘পাঠশালা’র এই আসর পরিচালনা করেন উদ্যোক্তা ফারহানা আজিম শিউলী। এই প্রচেষ্টা সম্পর্কে তিনি জানান। বলেন, ‘প্রায় বছর হতে চলল আমরা বিষয়ভিত্তিক কয়েকটি অনুষ্ঠান আয়োজনের চেষ্টা করেছি।