বর্ণবাদবিরোধী নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার অগ্রদূত

আধুনিক বিশ্বে কানাডা বহুমাত্রিক সংস্কৃতির প্রতি সহনশীল এক রাষ্ট্র রূপে স্বীকৃত। তবে কানাডায় দীর্ঘ ঐতিহাসিক পথ পরিক্রমা একেবারে মসৃণ ছিল তা বলা চলে না। এই পথে সংঘটিত হয়েছে নানা সামাজিক আন্দোলন। যুগ যুগ ধরে বহু মহীয়সী নারী বিশ্ব সভ্যতার বিনির্মাণে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন। কানাডার বর্ণভিত্তিক বৈষম্য, সিভিল রাইটস বা সাধারণ নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার অগ্রদূত হিসেবে যে নারী ব্যক্তিত্বের নাম প্রণিধানযোগ্য, তিনি হলেন ভায়োলা আইরিন ডেসমন্ড। মানবতার নিকৃষ্টতম এক প্রকাশ বর্ণভিত্তিক বিভাজন ও বিরাজমান বৈষম্যের বিরুদ্ধে ১৯৪৬ সালে হ্যালিফ্যাক্সে সোচ্চার হয়েছিল এই প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর।
কানাডার পূর্ব প্রান্তে আটলান্টিকের তীরবর্তী নোভা স্কোশিয়ার রাজধানী হ্যালিফ্যাক্সে ১৯১৪ সালের ৬ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন এই মহীয়সী নারী। তিনি কানাডার তৎকালীন সামাজিক ইতিহাসে বিরাজমান বর্ণবাদের নির্মমতা ও বর্ণভিত্তিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক শক্তিমতীর প্রতীকরূপে অবস্থান করেছেন। মানুষের সমঅধিকার প্রত্যাশায় তাঁর আমরণ সংগ্রামের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁর মৃত্যুর দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর অতি সম্প্রতি রাষ্ট্রীয়ভাবে বিশেষ সম্মাননা দান করা হয়েছে। ২০১৬ সালের কানাডার কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক স্তরের এক রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তাঁর ছবি কানাডার দশ ডলার নোটে সংযুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ বছর (২০১৮) ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে হ্যালিফ্যাক্সে আনুষ্ঠানিক আয়োজনের মাধ্যমে তা কার্যকর করা হয়। কানাডার ইতিহাসে ডেসমন্ড হলেন প্রথম অরাজনৈতিক কৃষ্ণাঙ্গ নারী, যাঁর মুখাবয়বের ছবি কানাডার দশ ডলার নোটে সংযোজিত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় এই অনুষ্ঠানে তাঁর বোন ওয়ান্ডা রবসনসহ পরিবারের কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন।
এ ছাড়া ২০১৫ সালে তাঁর প্রতি ঘটে যাওয়া অবিচারের প্রতি বিশেষ ক্ষমাসূচক দুঃখপ্রকাশ করা হয়। সেই আয়োজনে কানাডার প্রাদেশিক সরকার পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে নোভা স্কোশিয়ার লেফটেন্যান্ট গভর্নরের মায়ান ফ্রন্সিসেসের (নোভা স্কোশিয়ার প্রথম কৃষ্ণাজ্ঞ নারী মেয়র) এক আয়োজনে নোভা স্কোশিয়ার প্রিমিয়ার ড্যারেল ডেক্সটারের এক বক্তব্যের মাধ্যমে দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চাওয়া হয়। আয়োজনে অন্যতম বক্তা আফ্রিকান নোভা স্কোশিয়ান অর্থনৈতিক উন্নয়নবিষয়ক মন্ত্রী পার্সি পারিস ‘বিভাজন আর বৈষম্যের বিপক্ষে’ কানাডার সরকারের সুদৃঢ় অবস্থানের দিকটা আলোচনা করেন।
কৃষ্ণাঙ্গদের বর্ণবাদের অভিশাপ রহিতকরণ ও সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই আত্মপ্রত্যয়ী সংগ্রামী নারীর পরিচালিত আন্দোলনের নেপথ্যে ঘটেছিল এক হৃদয়স্পর্শী ঘটনা। তাঁর আন্দোলন হ্যালিফ্যাক্সসহ পরবর্তীতে সমগ্র কানাডা জুড়ে মানবাধিকার স্থাপনে আফ্রিকান জনগোষ্ঠীর ঐক্যের চালিকা শক্তিরূপে উৎসাহ জুগিয়েছিল। দশ ভাইবোনের এক বিরাট মধ্যবিত্ত পারিবারিক কাঠামোয় ভায়োলা বেড়ে উঠেছিলেন। তাঁর মা জিওদলিন আইরিনের বাবা ছিলেন এক শ্বেতাঙ্গ চার্চের ধর্মীয় যাজক মিনিস্টার। তাঁদের আদি নিবাস ছিল যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাট অঞ্চলে। ভায়োলার বাবা ও মায়ের বিয়েটা ছিল অসবর্ণের।
তৎকালীন কানাডার বর্ণভিত্তিক বিভাজিত সামাজিক প্রেক্ষাপটে এটা বিরল ঘটনা ছিল। তাঁর বাবা জেমস আলবার্ট ডেভিস পেশায় একজন জাহাজের খালাসি ছিলেন। যিনি পরবর্তীকালে একজন ক্ষৌরকার হিসেবে পেশাজীবনে মোটামুটি সফলতা লাভ করেন। হ্যালিফ্যাক্সের আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী সামাজিক কর্মে তাঁদের বিভিন্ন সম্পৃক্ততা নিগৃহীত কৃষ্ণাঙ্গ কমিউনিটির মধ্যে বেশ ভালো মাত্রার গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি করেছিল। বাবা ও মায়ের সংগ্রামী জীবনের নানা টানাপোড়েন, সামাজিক জীবন, কর্মস্পৃহার মাধ্যমে ভায়োলা বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।
ভায়োলা সফল একজন নারী কর্মী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখতেন। ভায়োলা শিক্ষা গ্রহণে বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক অসহযোগিতার অভিজ্ঞতার লাভের পর শেষপর্যন্ত কানাডার মন্ট্রিয়েল শহরে কৃষ্ণাঙ্গ শিক্ষার্থীদের গ্রহণযোগ্যতা আছে সেরকম এক সৌন্দর্যচর্চার স্কুলে প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ লাভ করেন। ইতিপূর্বে ভায়োলা নিউইয়র্কে কয়েকজন সফল কৃষ্ণাঙ্গ উদ্যোক্তাদের সান্নিধ্যে প্রশিক্ষণের সুযোগ পেয়েছিলেন। তাদের সফলতার মন্ত্রে অনুপ্রাণিত হয়ে নানা প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে তিনি হালিফ্যাক্সে ভিআই স্টুডিও নামে নারীদের সৌন্দর্যচর্চার ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র চালু করেন। তার কর্মনিষ্ঠা, একাগ্রতা, জ্ঞান ও অমায়িক ব্যবহারের মাধ্যমে তিনি অতি অল্প সময়ে সাধারণ নাগরিকদরর প্রিয়পাত্রী হয়ে ওঠেন। এ সময় তিনি কয়েকটি প্রসাধনী সামগ্রী উৎপাদন শুরু করেন। অচিরেই তাঁর এই প্রতিষ্ঠান কৃষ্ণাঙ্গ কমিউনিটি ও সাধারণ নাগরিকদের একটি সামাজিক যোগাযোগের কেন্দ্র পরিণত হয়।
উল্লেখ্য, সেই সময়ে পুরুষতান্ত্রিক বিভাজিত কানাডার সমাজ কাঠামোয় অন্যান্য ক্ষেত্রের চাইতে সৌন্দর্যচর্চার ক্ষেত্রে কৃষ্ণাঙ্গ নারীরা তুলনামূলকভাবে অধিক হারে কর্মসংস্থানের সুযোগ পেতেন। ১৯৪৬ সালের নভেম্বরে মাসের এক বিকেলে ভায়োলা প্রসাধন সামগ্রীর প্রচার বৃদ্ধি ও ব্যবসায়িক কর্ম সম্প্রসারণের অভিপ্রায়ে নোভা স্কোশিয়ার কেপ ব্রিটেনের উদ্দেশে যাত্রা করেছিলেন। যাত্রাপথে নিউ গ্লাসগো অঞ্চলে তাঁর গাড়ি বিকল হয়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে একটি হোটেলে তিনি রাতযাপন করার সিদ্ধান্ত নেন।
বিকেলে হোটেলের নিকটবর্তী রোজল্যান্ড মুভি থিয়েটারে যান এবং সামনের সারির আসনে বসার জন্য তিনি একটি টিকিট চান। তাঁকে পেছনের অলিন্দের ঝুল বারান্দার একটি আসনের টিকিট দেওয়া হয়। সেই সময় সামনের সারির সিট অবশ্য শুধুমাত্র শ্বেতাঙ্গ গ্রাহকদের জন্য বরাদ্দ করা হতো। ভায়োলা উপলব্ধি করেন তিনি বর্ণবৈষম্যের শিকার হয়েছেন। তিনি তাঁর ইচ্ছানুসারে সামনের সারির আসন গ্রহণ করেন। তাঁর এহেন আচরণে ক্ষিপ্ত থিয়েটার কর্তৃপক্ষ কর্তব্যরত পুলিশের সহায়তায় টেনেহিঁচড়ে তাঁকে থিয়েটার হল বের করে আনেন। আসন গ্রহণসংক্রান্ত প্রচলিত রীতি আইন অমান্য করার অপরাধে তাঁকে তাৎক্ষণিকভাবে সেদিন কারাবরণ করতে হয়। ঘটনার আকস্মিকতায় ভীতসন্ত্রস্ত ভায়োলা কারাগারে প্রায় নির্ঘুম সময় অতিবাহিত করেন।
পরদিন সকালে তাঁকে কানাডার প্রাদেশিক সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন স্থানীয় আদালতে প্রেরণ করা হয়। বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে অনভিজ্ঞ ভায়োলাকে সমগ্র বিচার প্রক্রিয়ায় আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য আইনজীবী প্রাপ্তির অধিকারবিষয়ক কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। বিচারের শুনানিকালে সামনের সারির মূল আসন গ্রহণ করার জন্য অতিরিক্ত কর দিতে হয় সেই বিষয়টি প্রাধান্য দিয়ে আলোকপাত করা হয়। প্রকৃতপক্ষে মুভি থিয়েটারে সামনের আসনে তার ক্রয়কৃত টিকিটের জন্য অতিরিক্ত কর তিনি প্রদান করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু থিয়েটার কর্তৃপক্ষ তা গ্রহণ করেননি এবং এর পরিবর্তে তাঁকে জোরপূর্বক হল ত্যাগ করতে বাধ্য করেছিলেন। ভায়োলা বারবার বিষয়টি উত্থাপন করতে চাইলেও আইনের মারপ্যাঁচে তাঁর প্রতি বর্ণবৈষম্যের দিকটি উপেক্ষা করে সামান্য কর ফাঁকির অর্থ পরিশোধের জন্যই রায় দান হয়।
প্রথা ভাঙার বা প্রচলিত রীতির বিরোধিতার দিকটিকে মুখ্য করে তার বিরুদ্ধে রায় দেওয়া হয়। যদিও বিষয়টি স্পষ্ট ডেসমন্ডের মূল অপরাধ ছিল তিনি কৃষ্ণাঙ্গ। কিন্তু সুকৌশলে তা এড়িয়ে যাওয়া হয়। হ্যালিফ্যাক্স প্রত্যাবর্তনের পর ভায়োলা আইনি বিভাজন ও অনিয়ম নিয়ে স্বপক্ষে বিভিন্ন প্রচারণা চালান। তার জীবনে অন্যায়, বর্ণবৈষম্যের এই ঘটনা বিশেষভাবে কানাডা, হ্যালিফ্যাক্স ও নোভাস্কোশিয়ার সমাজে আলোড়ন তুলে। কানাডার সেই সময়ের জনপ্রিয় সংবাদপত্রের এই বিষয়ে কয়েকটি প্রশ্নের জবাবে রোজল্যান্ড থিয়েটার কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি ম্যাকলেইল জানিয়েছিলেন, প্রথাগত রীতি ভাঙা হয়েছে। বাস্তবে তৎকালীন (শিক্ষাঙ্গন, হাসপাতাল, রেস্টুরেন্ট, অফিস ও গণশৌচাগার) হ্যালিফ্যাক্সসহ কানাডার সর্বত্রই প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক স্তরে বর্ণভিত্তিক বৈষম্যের মাত্রা পরিলক্ষিত হতো। ভিন্ন বর্ণের মানুষেরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হলেও হেয় ও অসম্মানিত হতেন। ভায়োলার বিচারকার্য পরিচালনার জন্য নোভা স্কোশিয়া অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অব ব্ল্যাক পিপল বা NSAACP বিশেষ সহায়তা করে এবং কৃষ্ণাজ্ঞ মালিকানাধীন সংবাদপত্র ‘দ্য ক্লারিওন’-এর সম্পাদক কারি বেস্ট নিয়মিতভাবে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করে তার স্বপক্ষে জনমত গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন।
ভায়োলা নিজ উদ্যোগে ফ্রেডেরিক বিসেট নামক একজন আইনজীবীর পরামর্শ নেন। এই আইনজীবী তাঁকে শারীরিকভাবে হেনস্তা করার বিষয়টি পুনরায় উত্থাপন করে পূর্বোক্ত রায় উচ্চআদালতে প্রেরণ করেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও তার প্রতি বর্ণবাদের নির্মমতার দিকটি উপেক্ষা করে বিচার প্রক্রিয়া ইচ্ছাপূর্বক দীর্ঘতর করা হয়। এ মামলা সঠিকভাবে পরিচালিত না করে এক সময় স্থগিত করা হয়। তবে বিভিন্ন সংবাদ ও প্রচারমাধ্যমগুলো বর্ণভিত্তিক এই বিচ্ছিন্নতা নিয়ে বিভাজনের বিরুদ্ধে দাবি তোলেন। ভায়োলাও সমঅধিকার প্রশ্নে অটল থাকেন ও জনমত সৃষ্টি হয়। ভায়োলার মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, বিচারকার্য ক্রমান্বয়ে সচেতন নাগরিক ও সংবাদমাধ্যম ব্যাপকভাবে সাড়া জাগায়। এর ধারাবাহিকতায় দীর্ঘ সময় পর ১৯৫৪ সালের নোভা স্কোশিয়ার সরকার কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকদের অবস্থান উন্নীত করার প্রয়াসে রাষ্ট্র পরিচালিত সকল সংগঠন থেকে কৃষ্ণবর্ণের মানুষদের প্রতি প্রচলিত বিচ্ছিন্নতা ও পৃথক্‌করণের আইনের অবসান ঘটান। তবে এই দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় ভায়োলার মানসিক ও দাম্পত্য জীবনে অনেকাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একসময় ভায়োলা হালিফ্যাক্সে তাঁর ব্যবসার পাট চুকিয়ে মন্ট্রিয়েল চলে যান। ১৯৬৫ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
২০১৩ সালে তাঁর বোন ওয়ান্ডা রবসনের (৭৩) বিশেষ প্রচেষ্টায় ভায়োলার সমঅধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রতিবাদী অনবদ্য ভূমিকা, আন্দোলন ও অবিচারের দিকটা নতুনভাবে জনগণের দৃষ্টি কাড়ে।