দাম্পত্য জীবনের ভিত্তি বিশ্বাস

মডেল: মাসুদ পারভেজ ও প্রজ্ঞা রওনক চৈতি
মডেল: মাসুদ পারভেজ ও প্রজ্ঞা রওনক চৈতি

সম্পর্ক হচ্ছে সমাজের আদি প্রতিষ্ঠান, পরিবারের হৃৎপিণ্ড সম। অন্যভাবে বলতে গেলে, পরিবার যদি একটি বৃক্ষ হয় তবে দাম্পত্য জীবনকে তার শেকড় বলা যায়। পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানটির মজবুত ভিত্তি হিসেবে কাজ করে দাম্পত্য জীবন। আর একটি সুখী ও মূল্যবোধ সম্পন্ন পরিবার সব সময় তার ভিত্তির প্রতিচ্ছবিই ধারণ বা প্রকাশ করে।
সম্পর্কের অটুট বুনন, গ্রন্থিহীন নির্মোহ বন্ধন, নিখাদ স্বার্থহীন আনুগত্য, আস্থা আর বিশ্বাসের যুগলবন্দী হচ্ছে দাম্পত্য জীবন। শুদ্ধ মানবিক সম্পর্ক চর্চার এক বলিষ্ঠ সংগঠন। ভালোবাসা নামক খুব সরল অনুভূতির আঁতুড়ঘর। যেখানে দুজন মানুষ কিছু স্বপ্ন পুঁজি করে থাকে আর বাজি রাখে সর্বস্ব। সেই সর্বস্ব বাজি রাখা সম্পর্কটা ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে আমাদের সম্পর্কের জিয়নকাঠি।
জীবনের এই অন্যতম আর গুরুত্ববহ সম্পর্কটি অনেক সময় জটিল হয়ে পড়ে, আমাদের মুষড়ে দেয়। আমরা খেই হারিয়ে ফেলি। আর পরিবার নামক সমাজের সেই আদি প্রতিষ্ঠানটি হয়ে ওঠে টালমাটাল। এমনকি সেই জটিলতা আমাদের জীবনবিমুখ পর্যন্ত করে তোলে।
অথচ কিছু পরিশীলিত আচরণ আর মূল্যবোধ চর্চার মাধ্যমেই আমরা পারি আমাদের জীবনের অন্যতম প্রধান, প্রয়োজনীয় এই সম্পর্ককে জটিলতামুক্ত রাখতে। দাম্পত্যজীবনে প্রথম যে জিনিসটি সবচেয়ে প্রয়োজন, তা হলো সম্মান। একে অন্যকে সম্মান করা। একে অন্যকে মানুষ হিসেবে ন্যূনতম সম্মান দিলেই, দাম্পত্যের এই চিরন্তন পাওনা বা চাহিদা মিটিয়ে দেওয়া যায়। তবে তা উভয় পক্ষ থেকে সমানভাবে হতে হবে। আর এ ক্ষেত্রে অবশ্যই ‘ইগো’ নামক ক্ষতিকর শব্দটিকে ধারেকাছে ঘেঁষতে দেওয়া যাবে না। বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ দুটি মানুষ নিজেদের একে অন্যের সম্পূরক ভাবলেই দাম্পত্য জীবনের ভারসাম্য সুন্দরভাবে বজায় থাকে।

দাম্পত্য জীবনের ভিত্তি বলা যায় বিশ্বাসকে। আর আস্থা হলো দাম্পত্য জীবনের সবচেয়ে সুন্দর অলংকার। স্বামী-স্ত্রী দুজন দুজনের প্রতি সৎ থাকলেই বিশ্বাসের ভিত্তিটি আস্তে আস্তে মজবুত হয়ে ওঠে। আর বিশ্বাস বা বিশ্বস্ততার খুব সুন্দর পরিণতি হলো আস্থা। বিশ্বাসকে ভিত্তি করেই আস্থা সযত্নে দাম্পত্য জীবনে আসন গাড়ে। নিজেদের অবস্থানে যদি শতভাগ সৎ থাকা যায়, তবে অন্য পক্ষ সততা চর্চার তাগিদ নিজে থেকেই অনুভব করবে। তবে এর ব্যতিক্রম যে হয় না, তা হলফ করে বলা যায় না। আর ঠিক এ কারণেই ‘সামাজিক মূল্যবোধ’ শব্দটি আজ এত চর্চিত একটি শব্দ। দাম্পত্য জীবনে তাই নিজে সৎ থেকে বিশ্বাস স্থাপন করতে হয়, যা একসময় আস্থার ইমারত গড়ে।

মডেল: মাসুদ পারভেজ ও প্রজ্ঞা রওনক চৈতি
মডেল: মাসুদ পারভেজ ও প্রজ্ঞা রওনক চৈতি

প্রতিটি সম্পর্কে ‘মূল্যায়ন’ শব্দটির স্বমহিমা সত্যিই নজর কাড়ে। যেকোনো সম্পর্ক চায় নিবিড় মূল্যায়ন। তাই দাম্পত্য জীবনে একে অন্যকে মূল্যায়ন করা খুব জরুরি। আপনার সাথিকে মূল্যায়ন করুন দ্বিধাহীন চিত্তে। দেখবেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে সেও আপনাকে মূল্যায়ন করছে উদারভাবে। মূল্যায়ন সব সময় যে কাউকে নিজের সক্ষমতার প্রতি বিশ্বাসী করে তোলে। তবে দাম্পত্য জীবনে মূল্যায়ন করা বলতে জীবনে একে অন্যের গুরুত্বের অকপট স্বীকারোক্তিই বোঝানো হয়। এভাবে দাম্পত্য জীবনকে আমরা প্রতিনিয়ত সজীব রাখতে পারি। রাখতে পারি নির্ভরতার মখমলি আচ্ছাদনে আবিষ্ট করে।
ভালোবাসা নামক মিষ্টি শব্দটি অনেক সময় ‘আঁকড়ে ধরা’ নামক এক অদ্ভুত শব্দে লীন হয়ে যায়। আমরা ভালোবাসা আর আঁকড়ে ধরাকে গুলিয়ে ফেলি। ভালোবাসা আর আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলাকে গুলিয়ে ফেলি। ভালোবাসলে অধিকারবোধ আসবেই, তবে তা যেন কোনোভাবেই অন্য পক্ষের কাছে ‘আবদ্ধ’ অনুভূত না হয়। সম্পর্কে অতিরিক্ত নির্ভরশীলতাও দমবন্ধ করা একটি অনুভূতি নিয়ে হাজির হয়। তাই কিছুটা ছাড় দেওয়ার মানসিকতা খুব সহায়ক সুন্দর দাম্পত্যে। এমনকি থাকতে হবে দুজনের মাঝখানে খানিক ফাঁকা জায়গা বা স্পেস রাখার মানসিকতাও। সব সময় মনে রাখতে হবে, এই ফাঁকা জায়গাই কিন্তু ঘুলঘুলি বা ভেন্টিলেটর হয়ে দাম্পত্য সম্পর্কে পরিশুদ্ধ বাতাস পরিবাহিত করে।
অনেক সময় দাম্পত্য জীবনকে আমরা প্রতিবেশী অভ্যাসে পরিণত করে ফেলি যে, এই সম্পর্কের মূল সুরটা হারিয়ে যায়। জায়া ও পতি নিজেদের স্বকীয়তায় প্রতিটি দিন নতুনভাবে শুরু না করে একঘেয়েমির জাবর কাটে অনেক সময়। আর যেকোনো সম্পর্কে একঘেয়েমির সুর বেজে উঠলেই সেখানে উঁকি দেয় ‘অবহেলা’ নামক ঘুণপোকা। এই ঘুণপোকা নিঃশব্দে ক্ষয় করে চলে দাম্পত্য জীবনের ভিত্তি। কোনো একদিন পলকা বাতাসেই ধসে পড়ে সেই ক্ষয়ে যাওয়া দাম্পত্য। তাই ভালোবাসা নামক মিষ্টি শব্দটা অভ্যাসে লীন হতে দিতে নেই। দাম্পত্য জীবনে যত্ন করে এই শব্দটা জিইয়ে রাখা খুব দরকার। দিন শেষে একবার একটা খুদে বার্তায় বা মুখে বলা ‘ভালোবাসি’ কিন্তু জাদুর মতো কাজ করে। তাই ভালোবাসার চর্চা আর যত্ন নেওয়া উচিত সব সময়।
আর এই প্রতিটি জিনিস কিন্তু খুব সচেতনভাবে এবং সযত্নে করতে হয়। অস্থির এই সময়ে সেই যত্নটা আরও বেশি দরকার। খুব বেশি সহজলভ্য ভেবে, অভ্যাসে পরিণত করে আমরা দাম্পত্য জীবনকে জটিলতার দিকে এগিয়ে দিই। যত্নহীন করে, তুচ্ছ করে হুমকির মুখে ফেলি স্বর্গীয়, মূল্যবান আত্মিক এই সম্পর্ককে। দাম্পত্য সম্পর্কে একটু যত্ন আর কিছু অনুষঙ্গের পরিশীলিত চর্চা কিন্তু স্বর্গকেই পৃথিবীতে নামিয়ে আনে আমাদের অগোচরে। জীবনকে পরিপূর্ণ করে। স্বপ্ন পুঁজি করা সেই প্রথম ক্ষণ সব সময় একই আবেদনে বিরাজ করে আমাদের জীবনে।
আমাদের জীবনের পদাবলি আবর্তিত হয় অসংখ্য সম্পর্কের ছন্দোবদ্ধ কাব্যে। সেই অসংখ্যের মধ্যে সবচেয়ে সুরেলা আর মাধুর্যময় কাব্য দাম্পত্য জীবনের। সেই সুর আর সেই মাধুর্য আমাদের জীবনকে সদা মাধুর্যময় করে রাখুক।