হাবীব ভাই: স্মৃতি ও কৃতজ্ঞতা

আ ন স হাবিবুর রহমান
আ ন স হাবিবুর রহমান

প্রায় আড়াই দশকের বেশি সময় আমি বাস করছি দেশের বাইরে। পরবাসে নানা দেশে আমাকে বিবিধ পেশায় থাকতে হয়। কখনো রুটি-রুজি, কখনো ভ্রমণ কিংবা দিন গুজরানের প্রয়োজনে। এক দেশ থেকে আরেক দেশে ক্রমাগত ভ্রমণে আমি হামেশা সংস্পর্শে আসি নানা কিসিমের মানুষজনের সঙ্গে। পথচলায় তাঁদের কেউ কেউ আমাকে বস্তুগতভাবে সাহায্য-সহায়তা করেন, কেউ-বা প্রেরণা জোগান, আবার কোন কোন মানুষ নৈতিক সমর্থন যুগিয়ে আমাকে ঋণগ্রস্ত করে তোলেন। যাঁদের কাছে আমি ঋণী তাঁদের তালিকা দীর্ঘ এবং এর শীর্ষে গেল প্রায় পাঁচ দশক ধরে যাঁর নাম জ্বলজ্বল করছে নাক্ষত্রিক বিভায়, তিনি হচ্ছেন আ ন স হাবীবুর রহমান বা আমাদের প্রিয় হাবীব ভাই। শৈশবে তাঁকে আমি জানতাম আত্মীয় হিসেবে, তখন দেখা-সাক্ষাৎ হতো কম। কিন্তু পারিবারিক পরিসরে তাঁর কথা শুনতাম প্রচুর। তারুণ্যে তাঁর সঙ্গে পেশাদার জীবনে মিথস্ক্রিয়ার শুরুয়াত হয় আশি দশকের মাঝামাঝি।

আশির দশকের পয়লা দিকটা আমার কেটেছে দারুণভাবে, নিষ্ফলা হালতে। সৃজনশীল ধারায় কিছুটা লেখালেখি করতাম, তবে আগ্রহ হারিয়েছিলাম প্রকাশে। গ্রামের বাড়িতে বসবাস করতাম একাকী নির্বান্ধব। সম্ভবত ডিপ্রেস্‌ড বা হতাশ ছিলাম, পারিবারিক লাইব্রেরির বই পড়ে আর ক্রমাগত ধূমপান করে সময় কাটতে চাইত না। তাই বিনা পারিশ্রমিকে এলাকার কোন কোন অসফল ছাত্রকে পড়াতাম। গ্রামের কয়েকজন উদ্যোগী মানুষকে অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন করারও চেষ্টা করেছি। কিন্তু কীভাবে বয়স্ক মানুষজনকে অক্ষরের ভুবনে এক্সপোজ করা যায়—এ বিষয়টি আমি জানতাম না। আমার বেকারি হালতের খবর কোন না কোনোভাবে হাবীব ভাইয়ের কানে গিয়েছিল। তিনি আমাকে চিঠি দিয়ে এফআইভিডিবির ব্যবহারিক শিক্ষা কার্যক্রমে চাকরির জন্য দরখাস্ত পাঠাতে অনুরোধ করেন। পরে তাঁর তত্ত্বাবধানে বছর চারেক আমি ব্যবহারিক শিক্ষা বিভাগের জুনিয়র সহকর্মী হিসেবে কাটিয়েছি। এ ঘটনা থেকে মূলত হাতেখড়ি হয় আমার পেশাদারি জীবনের। এ ক্ষেত্রে আমার মতো শৃঙ্খলারিক্ত মানুষকে পেশাদার কর্মী হিসেবে গড়ের তোলার পেছনে হাবীব ভাইয়ের অবদানকে স্বীকার করে নিয়ে তাঁর চরিত্রের চমৎকার দুটি প্রবণতার উল্লেখ করা আমি প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করি। কারও মধ্যে প্রচ্ছন্ন সম্ভাবনার বিষয়টা হাবীব ভাই খুব ভালো বুঝতেন এবং এর বিকাশের সুযোগ সৃষ্টিতে তিনি সব সময় সক্রিয়ভাবে উদ্যোগ নিতে ভালোবাসতেন।

১৯৬৬ কিংবা ৬৭ সালের কথা, আমার বয়স নয় কিংবা ১০ বছর। পড়াশোনা করছি লংলার আলী আমজাদ হাই স্কুলে, ক্লাস সিক্স বা সেভেনে। হাবীব ভাই কুলাউড়া থেকে আমাদের স্কুলে আসলেন। উদ্দেশ্য ছাত্রদের নিয়ে তৈরি করবেন খেলাঘরের আসর। তাঁর প্রণোদনামূলক কথাবার্তায় আমিও সদস্য হলাম খেলাঘরের। তিনি আসরের নামকরণ করলেন ‘পদ্মকলি’। পদ্ম বলে এক ধরনের ফুলের নাম আমি জানতাম, কলি কী বস্তু ঠিক বুঝতে পারিনি। পদ্মকলির সঙ্গে খেলাঘরের কী সম্পর্ক তাও ধরতে পারিনি। তাই দাঁড়িয়ে তাঁকে ব্যাখ্যার অনুরোধ করেছিলাম। তিনি আসরের নামের রূপকের আড়ালে প্রচ্ছন্ন সম্ভাবনা ও যথাসময়ে বিকশিত হাওয়ার বিষয়টি প্রাঞ্জলভাবে বুঝিয়ে বলেছিলেন। তারুণ্যে যখন খুব কাছাকাছিভাবে তাঁর সঙ্গে কাজ করেছি, তখনো বারবার দুরূহ ধারনাকে সহজে বুঝিয়ে বলার তাঁর যে বিরল ক্ষমতা, তা মুগ্ধ করেছে আমাকে এবং পেশাগত জীবনে উপকৃত হয়েছি বহুবার।

১৯৬৯ কিংবা ’৭০ সাল। আমি মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্র। সমর বাবু স্যারের অঙ্কের ক্লাসে পেছন দিকে ঘাপটি মেরে বসে পাঠ্য বইয়ের আড়ালে চুপচাপ পড়ছি জরাসন্ধের লৌহকপাট। ধূলি ধূসরিত পায়ে হাবীব ভাই এসে অনুমতি নিয়ে ঢুকলেন ক্লাসে। তাঁর মেট্রিক পরীক্ষার রেজাল্ট নিয়ে আমাদের উপস্থিতিতে স্যারের সঙ্গে কিছু কথাবার্তা বললেন। স্যারকে কী একটা কাগজও দেখালেন। একটু পর তিনি চলে গেলে সমর বাবু স্যার তাঁর বাংলা লেখনিশক্তির প্রশংসা করে আমাদের বলেছিলেন, হাবীব ভাই নাকি বাংলায় সারা কুমিল্লা বোর্ডে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছিলেন। খুব কড়া ধাঁচের শিক্ষক ছিলেন সমর বাবু, তাঁর ক্লাসে চড়-থাপ্পড় খাওয়া স্বাভাবিক ঘটনা ছিল, তাঁকে আমি জীবনে কেবল একজন ছাত্রের মেধা ও পড়াশোনার তারিফ করতে শুনেছি, তিনি হচ্ছেন আমাদের প্রিয় হাবীব ভাই। এ ঘটনার পর থেকে তিনি যে খুব ভালো মানের বাংলা লিখেন, এ বিষয়টা আমাকে দারুণভাবে কৌতূহলী করে তোলে। সেই আমলে হাবীব ভাই সৃজনশীল ধারায় লেখালেখি করতেন। লিটল ম্যাগাজিনে তাঁর লেখাজোকা ছাপা হলে আমি সংগ্রহ করে পড়তাম। তখনকার দিনে আমার জানাশোনা মানুষজন ও আত্মীয়-স্বজনদের পরিমণ্ডলে ছিলেন নানা রকমের পেশাদার মানুষ—যেমন ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, কাস্টমস কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদ। কিন্তু হাবীব ভাই ছাড়া অন্য কেউ লেখক ছিলেন না। ’৭০ সালের দিকে আমি একটি-দুটি পদ্য লেখার চেষ্টা করছি এবং যে তথ্যটি হাবীব ভাইয়ের অজানা থেকে গেছে, তা হচ্ছে আমি তাঁর লেখক-শোভন ইমেজ দ্বারা প্রভাবিত হই। এ বিষয়টি পরবর্তী জীবনে আমাকে প্রেরণা জোগায়।

আশির দশকের মাঝামাঝি আমি যখন এফআইভিডিবিতে হাবীব ভাইয়ের জুনিয়র সহকর্মী হিসেবে কাজ শুরু করি, তখন আমার কবিতা কিংবা ছোটগল্প লেখার অভিজ্ঞতা ছিল। কিন্তু প্রবন্ধ লেখার কলাকৌশল তেমন একটা জানতাম না। বলা যায়, তাঁর তত্ত্বাবধানে তথ্যভিত্তিক নিবন্ধ লেখার হাত পাকা করি। হাবীব ভাই লিখতেন দ্রুত, তাঁর লেখার ভঙ্গি পর্যবেক্ষণ করে যিনি তাঁকে তেমন করে চেনেন না, তার ধারণা হতে পারে যে, লেখক আদতে অগোছালো প্রকৃতির। প্রথম দিকে আমারও এই ভুল ধারণা হয়েছিল। কিন্তু খুব দ্রুত আমি পরিচিত হয়েছিলাম তাঁর জরুরি তথ্যকে সুসংগঠিতভাবে উপস্থাপনের অসামান্য ক্ষমতার সঙ্গে। যা আমার মতো তরুণ লেখককে দারুণভাবে মুগ্ধ করত, তা হচ্ছে তথ্যের সঙ্গে বক্তব্যের সমন্বয় করার দক্ষতা। আমার ধারণা, তাঁর নজরদারিতে কাজ করার সময় এ দক্ষতার যৎকিঞ্চিৎ আমার মধ্যে সংক্রামিত হয়েছিল। পরবর্তী জীবনে আমি যখন একাডেমিকভাবে প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা লিখি, তখন এই অভিজ্ঞতা শক্ত বুনিয়াদ হিসেবে কাজ করে।

সে যুগে আমি লিখতাম মূলত ‘স্ট্রিম অব কনসাসনেস’-এর হিল্লা ধরে, মূলত অন্তর্গত চেতনার ধারা প্রবাহে চিন্তাভাবনা না করে। হাবীব ভাইয়ের সঙ্গে বয়স্ক শিক্ষার উপকরণ উন্নয়নে শামিল হলে তিনি আমার সামনে খুলে ধরেন ধাপে-ধাপে ধারাবাহিকভাবে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে তথ্যকে সুসংগঠিতভাবে উপস্থাপন করার যৌক্তিক ভুবন। কীভাবে একটি চাবি শব্দকে কেন্দ্র করে, ছোট্ট একটি ইস্যুর সঙ্গে সমাজের বৃহত্তর প্রেক্ষাপটকে মিলিয়ে তৈরি করা যায় কারিকুলামের বিপুল ল্যান্ডস্কেপ—এই প্রক্রিয়াটিও আমি তাঁর সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে শিখি।

হাবীব ভাইয়ের মধ্যে সহকর্মী বা কাছের মানুষকে সহায়তা করার একটি সুন্দর প্রবণতা ছিল। এফআইভিডিবিতে আমার চাকরি জীবনের সপ্তম মাস চলছে, তখন আমাকে জাফলং-এ কনসার্নের একটি প্রজেক্ট মূল্যায়ন করার দায়িত্ব দেওয়া হলো। হাবীব ভাই আমাকে জাফলং যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে বললেন। মনে মনে আমি একটু নার্ভাসবোধ করলাম। বাসে সওয়ার হয়ে জাফলং অবধি পৌঁছানোর দক্ষতা আমার ছিল, কিন্তু সমস্যা দেখা দিল, ওখানে পৌঁছে করবটা কী? মূল্যায়নের কনসেপ্ট বা পদ্ধতি নিয়ে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। এ ক্ষেত্রে আমার কমলকুমার মজুমদার পাঠের অভিজ্ঞতা বা সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা বিশ্লেষণ করার প্রতিভা কিছুই কাজে আসল না। জাফলং গিয়ে কীভাবে মূল্যায়নের কাজ শুরু করব, তা ভেবে আমার নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম হচ্ছিল। মুশকিলে আসান হয়ে এগিয়ে আসলেন হাবীব ভাই। তাঁকে সমস্যাটি জানানো মাত্র আধপোড়া সিগারেটে আরেকটি টান দিয়ে রাইটিং প্যাড থেকে এক টুকরা কাগজ ছিঁড়ে বলপয়েন্টে তাতে মূল্যায়নের সহজ একটি নকশা এঁকে দিলেন। এই যে সরলভাবে কোন জটিল বিষয়কে মোকাবিলার করার অ্যাপ্রোচ তারুণ্যে তাঁর কাছ থেকে শিখেছিলাম, তা এখনো আমাকে সহায়তা জুগিয়ে যাচ্ছে। প্রৌঢ়ত্বের মাঝামাঝি আমি যখন আমেরিকার স্কুল অব হিউম্যান সার্ভিসে প্রকল্প মূল্যায়নের ওপর গ্র্যাজুয়েট লেভেলে কোর্স পড়াতাম, তখন কোন শিক্ষার্থীর করোটিতে মূল্যায়নের বেসিকস্ না ঢুকলে, আমি হাবীব ভাইয়ের কাছ থেকে শেখা পদ্ধতি একাধিকবার ব্যবহার করেছি এবং সুফলও পেয়েছি প্রভূতভাবে।

দৃষ্টান্তের পরিসর না বাড়িয়ে হাবীব ভাইয়ের সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের মিথস্ক্রিয়ার ওপর একটি ব্যক্তিগত প্রতিফলন শেয়ার করে এই স্মৃতিচারণের সমাপ্তি টানছি। তিনি সব সময় সহকর্মীদের সঙ্গে পেশাদারি সম্পর্কের বৃত্ত অতিক্রম করে তৈরি করে নিতেন সংবেদনশীল ভালোবাসাময় এক সম্পর্কের ভিত। এতে আমি উপকৃত হয়েছি বিপুলভাবে এবং এই মুহূর্তে লিখতে লিখতে প্রয়াত এই প্রিয় মানুষটির প্রতি জানাচ্ছি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা।
পরিশেষে, বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও এটি বাস্তব সত্য, হাবীবের জাগতিক জীবন সমাপ্ত হয়েছে। তিনি প্রয়াত, তবে তাঁর স্মৃতি অম্লান হয়ে দীপ্তি ছড়াচ্ছে আমার মন লোকে। আমি প্রার্থনা করছি, পরলোকে তাঁর অশেষ শান্তি ও আত্মার মাগফেরাতের। তিনি ‘ফিরে দেখা: উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার ৩ যুগ’ নামে অত্যন্ত তথ্যবহুল একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ লিখেছেন। আমি এ বইটিরও বহুল প্রচার কামনা করছি।