কানাডাকেও কি আমেরিকার রোগ পেয়ে বসেছে?

টরন্টোতে বন্দুক হামলায় নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সাধারণ মানুষ হামলার স্থানের পাশের একটি দেয়ালে বিভিন্ন বার্তা লেখেন; দেন ফুলেল শ্রদ্ধা
টরন্টোতে বন্দুক হামলায় নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সাধারণ মানুষ হামলার স্থানের পাশের একটি দেয়ালে বিভিন্ন বার্তা লেখেন; দেন ফুলেল শ্রদ্ধা

কানাডায় ফ্রেডেরিকটন শহরে গুলিতে চারজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন, যাদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
১০ আগস্ট হওয়া এই হামলায় জড়িত সন্দেহে এক ব্যক্তিকে এরই মধ্যে গ্রেপ্তার করেছে নিউ ব্রানসউইক পুলিশ। টরন্টো হামলার দুই সপ্তাহেরও কম ব্যবধানে হওয়া এই হামলা একটি জরুরি প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এসেছে। আর তা হলো, প্রতিবেশী আমেরিকার মতো কানাডাকেও কি একই রোগে পেয়ে বসেছে?
সর্বশেষ বন্দুক হামলাটি ঘটেছে কানাডার নিউই ব্রানসউইক প্রদেশের ফ্রেডেরিকটন শহরের উত্তর প্রান্তের ব্রুকসাইড ডক্টর এলাকায়। টরন্টো স্টার জানায়, ১০ আগস্ট স্থানীয় সময় সকালে ওই এলাকার মানুষদের ঘুম ভাঙে গুলির শব্দে। একটি দুটি নয়, পরপর ১৫-১৬টি গুলির শব্দ।
স্থানীয় বাসিন্দা ডেভিড ম্যাকাব্রের ভাষ্য, ‘সকালে এত গুলির শব্দ শুনেছি যে, প্রথমে ভেবেছিলাম শিশুরা হয়তো বাজি পোড়াচ্ছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই বুঝতে পারলাম এটি গুলির শব্দ। পুলিশকে জানালাম। পুলিশ জানালা বন্ধ করে ঘরেই থাকতে বলেছে।’
ডেভিড ম্যাকাব্রে যখন টরন্টো স্টারকে এ কথাগুলো বলছেন, তখন ঘড়িতে মাত্র ৮টা ১৫ মিনিট। ডেভিড ম্যাকাব্রেসহ ওই এলাকার বাসিন্দাদের সবাই অনেকটা হতচকিতভাবে ঘুম থেকে জেগে ওঠেন। ১০ আগস্ট দিনটি তাদের কাছে আর স্বাভাবিক থাকল না। একটা আতঙ্কে ভর করে দিন শুরু হলো তাদের। ঠিক যেমনটা ঘটেছিল গত ২২ জুলাই টরন্টোয়। টরন্টোর ড্যানফোর্থ অ্যাভিনিউতে ওই দিন বন্দুক হামলায় দুজন নিহত হয়েছিল। আহত হয়েছিল ১৩ জন।
এবার দৃষ্টি আরেকটু প্রসারিত করা যাক। বিবিসি বলছে, শুধু টরন্টোতেই গত মে মাস থেকে মোট ১০৯টি বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটেছে। এই তথ্য নিঃসন্দেহে উদ্বিগ্ন করার জন্য যথেষ্ট। টরন্টো শহরসহ কানাডার কর্তাব্যক্তিরা উদ্বিগ্ন হচ্ছেনও।
টরন্টো হামলার পর নগর কাউন্সিলের সদস্য জো ক্রেসি বিবিসিকে বলেছিলেন, ‘এই শহরে বন্দুক হামলার ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।’
বিষয়টি শনাক্ত করেছে কানাডার পরিসংখ্যান সংস্থাও। সংস্থাটির তথ্যমতে, ২০১৩ সালের পর থেকে কানাডায় বন্দুক হামলার ঘটনা বাড়ছে। বাড়ছে এসব ঘটনায় মৃতের সংখ্যাও। ২০১৬ সালে কানাডায় বন্দুক হামলায় ২২৩ জন নিহত হয়েছে, যা ২০০৫ সালের পর সর্বোচ্চ। বন্দুক হামলা বা গোলাগুলির ঘটনা সবচেয়ে বেশি হচ্ছে টরন্টো ও ভ্যাঙ্কুভার শহরে। ২০১৮ সালের প্রথম সাত মাসে টরন্টোয় ২২৮টি বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটেছে। অথচ ২০১৭ সালে এ সংখ্যা ছিল ২০৫ টি।
কানাডার বিভিন্ন শহরে বন্দুক হামলার ঘটনা এমন অহরহ ঘটছে যে, তা প্রতিবেশী আমেরিকার বাস্তবতা মনে করিয়ে দিচ্ছে। প্রতি বছর আমেরিকায় বন্দুক হামলায় নিহত মানুষের সংখ্যা আধুনিক সময়ের যেকোনো যুদ্ধ-দিনে ঘটা হতাহতের সংখ্যার চেয়ে বেশি। এ নিয়ে দেশটিতে অস্ত্রবিরোধী আন্দোলন হচ্ছে অনেক দিন ধরেই। কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি এখনো। এ ক্ষেত্রে আগ্নেয়াস্ত্র উৎপাদন ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকেই দায়ী করা হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বন্দুক হামলা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে কানাডায়ও অস্ত্র আইন কঠোর করার দাবি উঠেছে।
টরন্টো হামলার পর জো ক্রেসি নিজেই প্রাদেশিক ও কেন্দ্র সরকারের কাছে অস্ত্র আইন কঠোর করার একটি প্রস্তাব পাঠান। বিশেষত সহজে বহন করা যায় এমন হ্যান্ডগানসহ বিভিন্ন আগ্নেয়াস্ত্রের বিক্রি সীমিত করার প্রস্তাব করেন তিনি। এ ক্ষেত্রে তাঁর সোজাসাপ্টা যুক্তি, ‘সারা বিশ্বই এ বিষয়ে একমত যে, বন্দুক কম থাকলে বন্দুক হামলাও কম হবে। টরন্টোর মতো শহরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ছাড়া কারও কেন বন্দুক সঙ্গে রাখতে হবে, তা আমার বোধগম্য নয়।’
শেষ পর্যন্ত জো ক্রেসির প্রস্তাব নগর পরিষদে ৪১-৪ ভোটে পাস হয়। কিন্তু সংকট হচ্ছে প্রস্তাবের বিরুদ্ধে পড়া চার ভোট নিয়ে। কারণ ওই চার ভোটের একটি দিয়েছেন স্বয়ং শহরটির মেয়র স্টিফেন হলিডে। তাঁর যুক্তি, ‘পুলিশ বলছে বন্দুক সন্ত্রাসের জন্য বৈধ অস্ত্র কোনো সমস্যা নয়।’
ক্রেসির প্রস্তাবের আওতায় শুধু টরন্টো শহর পড়েছে। ফলে কানাডার অন্য অঞ্চল ও শহরগুলোর ঝুঁকি এতে হ্রাস হচ্ছে না। কেন্দ্র সরকারের সম্প্রতি পাস করা অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইনকে বিবেচনায় নিলেও ঝুঁকি কিন্তু কমছে না। আমেরিকার তুলনায় অনেক কঠোর অস্ত্র আইন রয়েছে কানাডায়। এ আইনে গোপনে অস্ত্র বহন একেবারে নিষিদ্ধ। অস্ত্র বহনের জন্য বিশেষ অনুমতির প্রয়োজন হয়। কিন্তু তারপরও বন্দুক হামলা যে কমছে না তার প্রমাণ ফ্রেডেরিকটন শহরে ১০ আগস্ট হওয়া বন্দুক হামলাই রেখে গেছে। এ সংকটের মূলে গেলে দেখা যাবে, আমেরিকার মতোই কানাডাতেও বন্দুক হামলার হ্রাসে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইনগুলো মূলত অ্যাসল্ট রাইফেল ও সেমি-অটোমেটিক রাইফেলের বিক্রয় সীমিত করতে মনোযোগী। যদিও দুই দেশেই অর্ধেকের বেশি বন্দুক হামলা হয় হ্যান্ডগান দিয়ে। আমেরিকার ক্ষেত্রে এ হার ৬৮ শতাংশ। আর কানাডার ক্ষেত্রে এ হার ৫৮ শতাংশ।
এটা সত্য যে, বন্দুক হামলার বিবেচনায় কানাডার সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ শহর টরন্টো আমেরিকার সবচেয়ে নিরাপদ শহরের সঙ্গে তুলনীয় এখনো। কিন্তু পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। চলতি বছরেই শহরটিতে বন্দুক হামলায় ২৮ জন নিহত হয়েছে। অথচ আগের বছরেই এ সংখ্যা ছিল ১৭। আমেরিকার শিকাগো শহরের সঙ্গে তুলনা করলে এ সংখ্যা অনেক কম। কানাডার অনেক আইনপ্রণেতা কঠোর অস্ত্র আইনের দাবির বিপরীতে এই তুলনাটিই উত্থাপন করছেন। এই প্রবণতা সংকটকে আরও ঘনীভূত করতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
কোয়ালিশন ফর গান কন্ট্রোলের প্রেসিডেন্ট ওয়েন্ডি কুকিয়ার বিবিসিকে বলেন, ‘কানাডায় সবচেয়ে বড় সংকট হয়ে দেখা দিয়েছে, প্রতিবেশী আমেরিকার সঙ্গে এ বিষয়ে তুলনা করার প্রবণতা। এই তুলনার মধ্য দিয়ে নিজেদের সংকটকে ছোট করে দেখা হচ্ছে, যা ভীষণ আশঙ্কাজনক। আমাদের বরং যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে নিজেদের তুলনা করা উচিত। দুটি দেশেই বন্দুক হামলার হার আমাদের চেয়ে কম।’
কঠোর অস্ত্র আইন সত্ত্বেও কানাডায় বন্দুক হামলা সময়ের বাড়ার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে উঠে এসেছে চোরাই অস্ত্রের তথ্য। এনবিসি নিউজ বলছে, টরন্টো হামলায় যে অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল, তা আমেরিকা থেকে চোরাই পথে এসেছিল বলে জানিয়েছে টরন্টো পুলিশ। কিন্তু শুধু আমেরিকার দিকে আঙুল ওঠালেই চলছে না। কারণ টরন্টো পুলিশ বলছে, কানাডায় এখন পর্যন্ত আটক করা অবৈধ অস্ত্রের অর্ধেকের বেশি দেশীয় উৎসের। এই তথ্য নিঃসন্দেহে আশঙ্কাজনক। এ তথ্য বলছে যে, অস্ত্র আইন কঠোর ও নিশ্ছিদ্র করার মধ্যেই দায়িত্ব সারছে না, অবৈধভাবে উৎপাদিত ও বাজারজাতকৃত এবং পাশের দেশ থেকে চোরাই পথে আনা অস্ত্রের বিস্তার রোধ করা না গেলে, কানাডায় বন্দুক হামলার ঘটনা বাড়বে বৈ কমবে না।