গোলাম সারওয়ার ও মোয়াজ্জেম হোসেনের মৃত্যু অপূরণীয় ক্ষতি

বরেণ্য সাংবাদিক গোলাম সারওয়ার ও মোয়াজ্জেম হোসেনের স্মরণে আলোচনা সভার আয়োজন করে নিউইয়র্ক বাংলাদেশ প্রেসক্লাব। ছবি: সংগৃহীত
বরেণ্য সাংবাদিক গোলাম সারওয়ার ও মোয়াজ্জেম হোসেনের স্মরণে আলোচনা সভার আয়োজন করে নিউইয়র্ক বাংলাদেশ প্রেসক্লাব। ছবি: সংগৃহীত

সাংবাদিক গোলাম সারওয়ার ও মোয়াজ্জেম হোসেন ছিলেন সাংবাদিক সমাজের অভিভাবক। দেশের সাংবাদিকতায় তাঁরা একেকজন ছিলেন একেকটি প্রতিষ্ঠান। তাঁদের মৃত্যুতে দেশের সাংবাদিকতায় অপূরণীয় ক্ষতি হলো। 

দেশবরেণ্য সাংবাদিক, বাংলাদেশ সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও দৈনিক সমকাল-এর সম্পাদক গোলাম সারওয়ার এবং ইংরেজি দৈনিক দি ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস-এর সম্পাদক এ এইচ এম মোয়াজ্জেম হোসেনের মৃত্যুতে আয়োজিত স্মরণসভায় বক্তারা এসব কথা বলেন।
নিউইয়র্ক বাংলাদেশ প্রেসক্লাবের এ সভায় বক্তারা তাঁদের মৃত্যুতে গভীর শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করেন। সাংবাদিকতায় তাঁদের পেশাদারীর আদর্শ অনুসরণের জন্য বক্তারা দেশ ও প্রবাসের সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বান জানান। সভায় জ্যেষ্ঠ সংবাদ উপস্থাপক দিমা নেফার তিতির মাতা মমতাজ শিরিনের ইন্তেকালে গভীর শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করা হয়।
সাংবাদিক গোলাম সারওয়ার ১৩ আগস্ট বাংলাদেশ সময় রাত ৯টা ২৫ মিনিটে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় মারা যান। অপর দিকে সাংবাদিক এ এইচ এম মোয়াজ্জেম হোসেন ১ আগস্ট সন্ধ্যা ৭টার দিকে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। দিমা নেফার তিতির মা মমতাজ শিরিন ১৭ আগস্ট বাদ মাগরিব রংপুরে নিজ বাসভবনে ইন্তেকাল করেন।

নিউইয়র্ক নগরের জ্যাকসন হাইটসে প্রেসক্লাবের অস্থায়ী কার্যালয়ে (দেশবাংলা/বাংলা টাইমস মিলনায়তন) ১৭ আগস্ট সন্ধ্যায় এই সভার আয়োজন করা হয়। প্রেসক্লাবের সভাপতি ডা. ওয়াজেদ এ খানের সভাপতিত্বে আয়োজিত সভা পরিচালনা করেন ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শিবলী চৌধুরী কায়েস। সভার শুরুতে মরহুম সাংবাদিকদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করে বিশেষ দোয়া পরিচালনা করেন ক্লাবের যুগ্ম সম্পাদক আলমগীর সরকার।

আলোচনায় অংশ নেন প্রেসক্লাবের অন্যতম উপদেষ্টা ও সাপ্তাহিক আজকাল সম্পাদক মনজুর আহমদ, প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি, সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকার সম্পাদক ও টাইম টেলিভিশনের সিইও আবু তাহের, ক্লাবের সাবেক সভাপতি ও সাপ্তাহিক বর্ণমালা-এর প্রধান সম্পাদক মাহফুজুর রহমান, সাপ্তাহিক পরিচয়-এর সম্পাদক নাজমুল আহসান, সাপ্তাহিক জন্মভূমি-এর সম্পাদক রতন তালুকদার, দৈনিক মানবজমিন-এর উপসম্পাদক মনির হায়দার, প্রেসক্লাবের সহসভাপতি ও ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মনোয়ারুল ইসলাম, প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এ বি এম সালাহউদ্দিন আহমেদ, সাপ্তাহিক আজকাল-এর সহযোগী সম্পাদক হাসানুজ্জামান সাকী ও নোয়াখালী প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ রুদ্র মাসুদ। ক্লাবের কার্যকরী পরিষদ সদস্য সৈয়দ ইলিয়াস খসরু ও রশীদ আহমদ ছাড়াও চ্যানেল আই অনলাইনের সাংবাদিক শাহ ফারুক রহমান এবং দেশবাংলা ও বাংলা টাইমস-এর মৌ সভায় উপস্থিত ছিলেন।

শোকসভায় বক্তাদের আলোচনায় সাংবাদিক গোলাম সারওয়ার ও মোয়াজ্জেম হোসেনের বর্ণাঢ্য জীবনের বিভিন্ন দিক উঠে আসে। পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বনামধন্য সাংবাদিক ও দেশের সাংবাদিকতা জগতের দিকপাল মরহুম মওলানা আকরাম খাঁ, তফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া), আবদুস সালাম, জহুর হোসেন চৌধুরী, মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লা কায়সার, আনোয়ার জাহিদ, গিয়াস কামাল চৌধুরী, তোয়াব খান, বিমান ভট্টাচার্য, রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ, হেদায়েত হোসেন মোর্শেদ, হাসান শাহরিয়ার প্রমুখের নাম উঠে আসে। এঁরা দেশে পেশাদারী সাংবাদিকতাকে আলোকিত করেছেন।

আলোচনায় অংশ নিয়ে মনজুর আহমদ বলেন, ‘আমাদের পূর্বপুরুষ সাংবাদিকেরা এক যুগ পেরিয়ে দেশের সাংবাদিকতায় নতুন যুগের সৃষ্টি করেছেন, আমরাও এক যুগ পেরিয়ে আরেক যুগের সূচনা করেছি। আমাদের পরবর্তী নতুন প্রজন্ম আরেক যুগের সৃষ্টি করবে। প্রবহমান সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যুগের সৃষ্টি হয়, এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যাঁরা আমাদের আলোর পথ দেখিয়েছেন, সেই আলো কতটুকু আমরা ধারণ করতে পারছি।’ তিনি বলেন, গোলাম সারওয়ার ও মোয়াজ্জেম হোসেন তেমনই সাংবাদিক; যাঁরা আমাদের আলোর পথ দেখিয়েছেন। তাঁরা মেধাসম্পন্ন সাংবাদিক ছিলেন বলেই, ইউনিয়ন বা প্রেসক্লাবের নেতৃত্বের চেয়ে পেশায় বেশি মনোযোগী ছিলেন। সাংবাদিকতা তাঁদের মিশন ছিল। তিনি বলেন, সাংবাদিক গোলাম সারওয়ার পেশাগত যেকোনো পরিস্থিতিতে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারদর্শী ছিলেন। অপর দিকে মোয়াজ্জেম হোসেন অর্থনৈতিক রিপোর্টিংয়ে খুব পারদর্শী ছিলেন, তাঁর লেখার হাত খুব ভালো ছিল। তাঁদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে দেশের সাংবাদিকতায় আরেকটি যুগের অবসান ঘটল।

আবু তাহের বলেন, সাংবাদিক গোলাম সারওয়ার ও মোয়াজ্জেম হোসেন বাংলাদেশের কিংবদন্তি সাংবাদিক। তাঁরা সাংবাদিকদের শিক্ষক ছিলেন। তিনি বলেন, সাংবাদিক গোলাম সারওয়ারের লেখায় মুনশিয়ানা ছিল। তিনি ‘সবমেহেরের ছুটি’ শীর্ষক ছোট্ট শিরোনাম করে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন এবং তাঁর এই প্রতিবেদনের কারণে একদিনেই দেশের সব পতিতালয় বন্ধ করে দিয়েছিল সরকার। তিনি দেশ ও প্রবাসের সাংবাদিকদের দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে সাংবাদিকতায় পেশাদারী বজায় রাখার আহ্বান জানান।

মাহফুজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতে তাঁরা পেশাদার সাংবাদিক ছিলেন, সাংবাদিকতায় প্রতিষ্ঠান ছিলেন। উভয়কে জানাই গভীর শ্রদ্ধা।
নাজমুল আহসান বলেন, সাংবাদিক গোলাম সারওয়ার ও মোয়াজ্জেম হোসেন তাঁদের কর্মের মাধ্যমে সাংবাদিকতা পেশাকে মর্যাদাশীল করেছেন। তাঁরা কিংবদন্তি সাংবাদিক। তিনি বলেন, গোলাম সারওয়ার শিরোনামে চমক দিতে পারতেন। তবে তিনি দৈনিক ইত্তেফাক ছেড়ে দেওয়ায় কষ্ট পেয়েছি, বিস্মিত হয়েছি। অপর দিকে মোয়াজ্জেম হোসেন ব্যক্তিগত জীবনে খুব সজ্জন মানুষ ছিলেন, ইন্টারেস্টিং পার্সন ছিলেন। তাঁদের নিয়ে নিউইয়র্কেই অনেক স্মৃতি রয়েছে। নতুন সাংবাদিকদের তাঁদের জীবনী পড়া উচিত।
মনির হায়দার বলেন, সাংবাদিক গোলাম সারওয়ার ও মোয়াজ্জেম হোসেনেরা দেশের সাংবাদিকতায় নির্ভরযোগ্য অভিভাবক ছিলেন। তাঁরা স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানের সবাইকে আসমানের মতো ছায়া দিতেন। তাঁদের মধ্যে কোনো অহংকার ছিল না, সিনিয়রিটি ভাব ছিল না। সিনিয়রদের মতো নবীন সাংবাদিকদেরও গুরুত্ব দেওয়ার অসাধারণ গুণ তাঁদের ছিল। নতুনদের কাজ শেখানোর ব্যাপারে তাঁরা অতুলনীয়। যত দিন বেঁচে থাকব, তত দিন তাঁদের কথা মনে থাকবে।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশ ও প্রবাসের সাংবাদিকেরা মরহুম গোলাম সারওয়ার ও মোয়াজ্জেম হোসেনের পেশাদারীর আদর্শ অনুসরণ করতে পারলেই তাঁদের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা জানানো হবে।
হাসানুজ্জামান সাকী বলেন, ‘সাংবাদিক গোলাম সারওয়ার আমার কাছে পিতৃতুল্য মানুষ। তিনি ছিলেন বার্তা সম্পাদকদের সম্পাদক।’
দিদার চৌধুরী বলেন, সাংবাদিক গোলাম সারওয়ার শিক্ষকের মতো ছিলেন। কোনো রিপোর্টারকে অ্যাসাইনমেন্টে পাঠানোর আগে তাঁকে ব্রিফ করে দিতেন।
সভাপতির বক্তব্যে ডা. ওয়াজেদ এ খান বলেন, সাংবাদিকতার প্রতিকূলতা মোকাবিলা করেই সাংবাদিক গোলাম সারওয়ার ও মোয়াজ্জেম হোসেনেরা উঁচু মানের সাংবাদিক হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তাঁরা সৎ, সাহসী আর দেশপ্রেমিক ছিলেন। তাঁদের পেশাদারীর আদর্শ ধরে রাখতে হবে। তাতে প্রবাস ও দেশের মানুষ উপকৃত হওয়ার পাশাপাশি সাংবাদিকতা পেশাও উপকৃত হবে।