আরশি নগরের পড়শি

আমার জীবনের পরম সৌভাগ্য যে, আমি হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য বাবুলের প্রতিবেশী হতে পেরেছি। তিনি ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে একাত্ম হয়ে জীবনের সুবর্ণ সময় পার করেছি। আমেরিকায় আসার পর থেকে তাঁদের খুব অভাব বোধ করি।
হেমচন্দ্র সিলেটের প্রখ্যাত নাট্য ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত, তাঁর জন্ম ১৯৪০ সালের ১৮ অক্টোবর। পৃথিবীর মায়া ছেড়ে গেছেন ২০১৫ সালের ২৭ জুন।
আমাদের বসতিকে পুষ্পিত করে রেখে ছিলেন দাদা-দিদি। তাঁদের বাড়ি ছিল আমাদের আড্ডার কেন্দ্রভূমি। সুচারু বিন্যাসে তাঁদের বাড়িকে করে তুলেছিলেন এক অনন্য ভূখণ্ড। যে ভূখণ্ডে জন্ম নিয়েছে অমিত, সুমী ও অয়নের মতো সুফলা বৃক্ষ। তাতে ‘ময়না পাখিরা’ এসে ঘর বেঁধেছে। ছোট্ট ছোট্ট প্রাণের কলতানে সারা বছর বিরাজমান বসন্ত। দাদার বিয়োগে সেখানে আসন গেঁথেছে অপূরণীয় শূন্যতা, সীমাহীন হাহাকার।
বাঙালির গড় আয়ুর বিবেচনায় হয়তো পরিণত বয়সে দাদা মারা গেছেন, তবুও কোনো মৃত্যুকেই আমরা সহজভাবে নিতে পারি না। অন্তত আপনজনদের মৃত্যু তো নয়ই। রক্তের সম্পর্ক কিংবা আত্মীয়তার বন্ধনই কেবল প্রিয়জনের সংজ্ঞা নয়।
২০১৬ সালে যখন দেশে গেলাম, আমার প্রিয় দিদির সিঁদুরহীন সিঁথি মেনে নিতে আমার বড় কষ্ট হচ্ছিল। প্রিয় মানুষ শুধু দাদা ছিলেন না, তাঁর পুরো পরিবারই আমার প্রিয়তর। কত গল্প, কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই পরিবারকে ঘিরে আমার ও আমার সন্তানদের।
‘সবারে বাস রে ভালো’ বাক্যটি দাদার সঙ্গে সদা সম্পর্কিত ছিল। সবার জন্য অবারিত ছিল তাঁর হৃদয়। তাঁর কাছে খুব সহজেই যে কেউ পৌঁছাতে পারত। শিক্ষার্থী শিশু, প্রতিবেশী শিশু, পথশিশু—সবাই তাঁর কাছে বৈষম্যহীন স্নেহ পেত। শিশুরা ছিল তাঁর সেরা বন্ধু। পিঁপড়াদের দাদা মারতে দিতেন না, বাড়ির পিঁপড়াদের প্রতিদিন চিনি খেতে দিতেন, বিড়ালকে দুধ দিতেন, শীত এলে বিড়ালের গা কাঁথায় জড়িয়ে দিতেন। আর প্রতিদিন সকালে বাড়ির ছাদে পাখিদের চাল খাওয়ানোর দৃশ্য দেখতে প্রতিবেশীরা যার যার ছাদে দাঁড়িয়ে থাকতাম। এমনি হাজার ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্মৃতি টিভি স্ক্রিনের মতো চোখের রেটিনায় ভাসছে।
জীবনযাপনে সাধারণ, পরিচ্ছন্ন, নিরহংকার, শিশুতোষ সারল্য জড়ানো, উদার, মহৎপ্রাণ মানুষটিকে কাছে থেকে যত দেখেছি, ততই তাঁর ব্যতিক্রমী সত্তার সামনে শ্রদ্ধায় আনত হয়েছি।
সংস্কৃতি যদি হয় সত্য ও সুন্দরের পাথেয়, তবে সংস্কৃতির মূল্যবোধকে ভক্তি ভরে দীর্ঘচর্চায়, সত্য ও সুন্দরের প্রসারে দাদা দিনাতিপাত করেছেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনে নতুন কুঁড়ি আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় দাদা বিচারকের আসনে, আর আমরা মুগ্ধ হয়ে দাদাকে দেখছি। তখন বিটিভি ছাড়া অন্য কোনো টিভি চ্যানেল ছিল না। ব্যক্তিগত জীবনে প্রচারবিমুখ, নির্লোভ, সদালাপী, মেধাসম্পন্ন, মননশীল বন্ধুসুলভ শিক্ষাগুরু এই মানুষটি অতি সাধারণ জীবনাচারে ছিলেন অভ্যস্ত। স্ত্রীর ওপর সংসারের ও তিন সন্তানের দায়িত্ব দিয়ে তিনি পরম নিশ্চিন্তে শিশু একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমিতে শিক্ষাদানে ব্যস্ত থাকতেন। সুদূর প্রবাসী শিক্ষার্থীকে খরচের চিন্তা না করে টেলিফোনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আবৃত্তি বা উপস্থাপনার কলাকৌশল শিক্ষা দিতেন। আত্মভোলা দাদা নিজের শরীরের প্রতিও ছিলেন অমনোযোগী। হৃদ্‌যন্ত্রের অস্ত্রোপচারের পর পরিবারের সদস্যরা তাঁকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। অথচ তাদের ফাঁকি দিয়ে তিনি রাস্তায় হাঁটার নাম করে ধূমপান করে আসতেন।
ঘরে কিংবা বাইরে আমি হেমচন্দ্র কখনোই উচ্চকণ্ঠ হতে দেখিনি। স্নেহময় বাবার ভূমিকায় দেখেছি, শাসনে দেখিনি। কর্তৃত্ব দেখাতে দেখিনি। অসহায় মানুষের প্রতি তাঁর দয়ালু স্বভাবের প্রতিফলন দেখেছি। তবে সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তিনি ছিলেন সব সময়ই সরব। উচ্চ স্বর, মেধাহীন স্বার্থান্ধদের কোলাহল থেকে নিজেকে সব সময় নিরাপদ দূরত্বে রাখতে পেরেছিলেন তিনি। তেল মারা জনপ্রিয়তা তাঁর কাম্য ছিল না। নিজের কাজ নিয়ে নিজেকে জাহির করা নয়, নিরাসক্ত বিচারে বিষয়কে সমগ্রতায় ফুটিয়ে তোলাই ছিল তাঁর লক্ষ্য।
খ্যাতনামা আবৃত্তিকার, নাট্যজন প্রশিক্ষক, সম্মিলিত নাট্য পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা, প্রধান পরিচালক ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি, বাবুলদার সংস্কৃতির সব ক্ষেত্রেই ছিল বিচরণ। দীর্ঘ ২৫ বছর বিনা পারিশ্রমিকে শিশু একাডেমি ও শিল্পকলা একাডেমিতে প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করেছেন অসংখ্য আবৃত্তি শিল্পী ও নাট্যশিল্পী। সিলেটের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিকাশ ও বিস্তারে হেমচন্দ্র ভট্টাচার্যের অবদান গুরুত্বপূর্ণ। এমন একনিষ্ঠ, নিবেদিত প্রাণ মানুষের বড়ই অভাব। তাঁর গঠিত সম্মিলিত নাট্য পরিষদ তাঁর অখণ্ডতা নিয়ে তিন দশকের বেশি সময় ধরে সিলেটের নাট্যাঙ্গনকে উজ্জ্বল করে রেখেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর নেতৃত্বে ‘কলম-তুলি, কণ্ঠ সংগ্রাম পরিষদ’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার স্থাপনে তাঁর নাম স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

শত ফুল ফুটতে দাও
হেমচন্দ্রের মতো জ্ঞানী, গুণী, ভদ্র, সজ্জন, আদর্শনিষ্ঠ সৎ ও সৃষ্টিশীল মানুষ যত বেশি দিন বেঁচে থাকবেন, পৃথিবী ততই উপকৃত হবে। যতটা না তাঁর নিজ বা পরিবারের জন্য তাঁকে প্রয়োজন ছিল, তার চেয়ে বেশি আমাদের জন্য। দাদা আমার কাছে, চেনা মানুষদের কাছে প্রিয়জন হয়ে থাকবেন তাঁর ব্যক্তিত্ব, শিশুসুলভ সরলতা, অকপটতা আর সর্বোপরি তাঁর সৃজনশীল বিকিরণের জন্য।
দাদা, আপনার প্রতি অসীম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক, নিউইয়র্ক