ট্রাম্পের 'প্যান্ট' খুলে দিল যে বই

সাংবাদিক বব উডওয়ার্ড ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: এএফপি
সাংবাদিক বব উডওয়ার্ড ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: এএফপি

ওয়াশিংটন পোস্টের বিখ্যাত সাংবাদিক বব উডওয়ার্ডের নতুন বই, ‘ফিয়ার, ট্রাম্প ইন দ্য হোয়াইট হাউস’, প্রকাশিত হওয়ার আগেই আলোড়ন তুলেছে। এই বই আরও একবার প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের যোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। 

এই পর্যন্ত যে আধা ডজনের মতো বই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সংক্ষিপ্ত শাসনকাল বিষয়ে প্রকাশিত হয়েছে, ট্রাম্প ও তাঁর সমর্থকেরা এগুলো ‘ভিত্তিহীন’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু ‘ভয়’ বইয়ের লেখক এমন একজন সাংবাদিক ও লেখক, যিনি তাঁর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জন্য দুই-দুবার পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছেন। সহযোগী লেখক কার্ল বার্নস্টাইনের সঙ্গে ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি বিষয়ে তাঁর ক্রমাগত প্রতিবেদনের কারণে অভিশংসনের মুখোমুখি হয়ে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট নিক্সন। একজন ভাষ্যকার মন্তব্য করেছেন, তাঁর এই নতুন বইয়ের এক-পঞ্চমাংশও যদি সত্যি হয়, তাহলে আরও একবার প্রমাণিত হবে, প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প শুধু অযোগ্যই নন, হোয়াইট হাউসে তাঁর অবস্থান আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক।

বইটি এখনো বাজারে আসেনি। বর্তমান প্রতিবেদক সে বই পাঠের সুযোগ পাননি। যাঁরা এই বইয়ের আগাম কপি পড়েছেন, তাঁরা জানিয়েছেন, ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহকর্মীরাই ট্রাম্পের যোগ্যতা ও মানসিক সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ৪৪৮ পাতার বইটি লিখতে গিয়ে উডওয়ার্ড ১০০ জনের বেশি বর্তমান ও সাবেক ট্রাম্প কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন, যার অধিকাংশ টেপে ধারণ করা হয়। এই বইয়ের সবচেয়ে বিতর্কিত তথ্যের মধ্যে রয়েছে—

১. ট্রাম্পের আইনজীবী জন ডাউড নিশ্চিত ছিলেন যে রাশিয়ার সঙ্গে আঁতাতের প্রশ্নে রবার্ট ম্যুলার যে তদন্ত পরিচালনা করছেন, তাতে ট্রাম্প প্রশ্নোত্তরের মুখোমুখি হলে তিনি মিথ্যা বলার অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হবেন। হোয়াইট হাউসে তাঁর আইনজীবীরা একটি ‘নকল প্রশ্নোত্তরে’ ট্রাম্পের উত্তর শোনার পর এতটা বিচলিত হয়ে পড়েন যে তাঁরা ম্যুলারের সামনে গিয়ে সেই ‘নকল প্রশ্নোত্তর’ পুনরাভিনয় করে দেখান। প্রশ্ন উঠেছে, বিচার বিভাগীয় তদন্তে প্রশ্নোত্তরের যোগ্যতা যাঁর নেই, দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর কী যোগ্যতা থাকতে পারে!

২. গত বছর জানুয়ারিতে এক বৈঠকে ট্রাম্প প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস ম্যাটিসকে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে খুন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ম্যাটিস সে পরামর্শ অগ্রাহ্য করেন। একই বৈঠকে ট্রাম্প দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিরক্ষায় বিপুল অর্থ ব্যয়ের বিরোধিতা করেন। সেই বৈঠকের পর ম্যাটিসের মন্তব্য ছিল, ট্রাম্পের বুদ্ধিশুদ্ধি পঞ্চম বা ষষ্ঠ শ্রেণির বালকের মতো।

৩. হোয়াইট হাউসের চিফ অব স্টাফ জন কেলি ট্রাম্পকে একজন ‘ইডিয়ট’ বা নির্বোধ বলে মনে করেন। ট্রাম্পের ব্যাপারে তাঁর মন্তব্য ছিল, এই লোকটাকে কিছু বোঝানোর চেষ্টা অর্থহীন। কেলির ভাষায়, ‘আমরা সবাই এক পাগলা শহরে রয়েছি।’

৪. তাঁর সাবেক চিফ অব স্টাফ রাইন্স প্রিবাস সম্বন্ধে ট্রাম্পের মন্তব্য, এই লোকটা একটা ধেড়ে ইঁদুর, সারাক্ষণ সে এখান থেকে সেখানে ছুটে বেড়াচ্ছে।

৫. ট্রাম্প অনেক সময় সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ম্যাকমাস্টারের ব্যবহার নকল করে দেখাতে ভালোবাসতেন। তাঁর ভাষায়, এই লোকটা সস্তা স্যুট পরেন, আর কথাবার্তায় একজন মদ বিক্রেতার মতো।

৬. ট্রাম্পের একটি প্রিয় অভ্যাস হলো আইনমন্ত্রী জেফ সেশন্সকে অনবরত অপমান করা। তাঁকে ট্রাম্প বিশ্বাসঘাতক এবং স্বল্প বুদ্ধিসম্পন্ন বলে অভিহিত করেছিলেন।

৭. ট্রাম্প একবার বাণিজ্যমন্ত্রী উলবার রসকে বলেছিলেন, ‘আপনি এখন বুড়ো হয়ে গেছেন, বাণিজ্য চুক্তি বিষয়ে আলোচনায় আপনার অংশ নেওয়ার আর কোনো প্রয়োজন নেই।

৮. ট্রাম্প দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। যাতে এমন কিছু তিনি না করতে পারেন, সে জন্য হোয়াইট হাউসের স্টাফ সেক্রেটারি রব পোর্টার ও অর্থনৈতিক উপদেষ্টা গ্যারি কোহন তাঁর অফিসের টেবিল থেকে একটি নথি সরিয়ে রাখেন। কোহন উডওয়ার্ডকে জানান, জাতীয় নিরাপত্তা বিবেচনা করেই তিনি কাজটা করেছিলেন। বলাই বাহুল্য, সে চিঠি চুরি গেছে, ট্রাম্প তা ধরতেই পারেননি। নাফটা চুক্তি প্রত্যাহারের যে নির্দেশ ট্রাম্প দিয়েছিলেন, সেটিও হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারা টেবিল থেকে সরিয়ে ফেলেন।

৯. গত বছর শার্লটসভিলে এক বর্ণবাদী মিছিলের পর ট্রাম্প যেভাবে তাদের পক্ষ সমর্থন করে বক্তব্য রাখেন, তার প্রতিবাদে হোয়াইট হাউসের অনেক কর্মকর্তা পদত্যাগে প্রস্তুত ছিলেন। উডওয়ার্ড জানিয়েছেন, তাঁর সহকর্মীদের অনুরোধে ট্রাম্প একটি লিখিত বক্তব্যে বর্ণবাদীদের নিন্দা করেন, তবে পরে হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তাদের জানান বর্ণবাদের এমন নিন্দা করা মস্ত ভুল ছিল। ‘এমন ভুল আর আমি কখনো করব না,’ ট্রাম্প বলেন।

বলাই বাহুল্য, হোয়াইট হাউস থেকে উডয়ার্ডের এই বইকে সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বর্তমান প্রশাসনের সাবেক কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত রোষের ফসল বলে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। ট্রাম্প নিজেও বইটি প্রতারণামূলক বলে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। এক টুইটে তিনি জানান, উডওয়ার্ড একজন ডেমোক্র্যাট, মধ্যবর্তী নির্বাচনের আগে তাঁর বই প্রকাশের একটাই উদ্দেশ্য, আর তা হলো ডেমোক্র্যাটদের সাহায্য করা।

উডওয়ার্ড অবশ্য বলেছেন বইয়ের প্রতিটি কথা সত্যি। তাঁর কাছে বিভিন্ন নথি ছাড়াও সাক্ষাৎকারের রেকর্ড রয়েছে। তিনি ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁর কথোপকথনের একটি রেকর্ডিংও প্রকাশ করেছেন। সেখানে ট্রাম্প তাঁকে দীর্ঘদিন থেকে চেনেন বলে জানিয়েছেন। ‘আপনি বরাবরই আমার ব্যাপারে ভারসাম্যপূর্ণ ছিলেন,’ ট্রাম্প সেখানে উডওয়ার্ডকে বলেন।

কার্ল বার্নস্টাইন, যিনি ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির তথ্য উদ্‌ঘাটনের জন্য উডওয়ার্ডের সঙ্গে যৌথভাবে পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছিলেন, মন্তব্য করেছেন, এই বই থেকে প্রমাণিত হয়, ট্রাম্প এখন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। হোয়াইট হাউসের একদল কর্মকর্তা যুক্তরাষ্ট্রকে ট্রাম্পের হাত থেকে বাঁচানোর দায়িত্ব নিজেদের ঘাড়ে তুলে নিয়েছেন। বার্নস্টাইন সিএনএনকে জানান, এই বই পড়ার পর একটা জিনিস স্পষ্ট, আর তা হলো ট্রাম্পের শরীরে আর কোনো কাপড় নেই।