'বাংলাদেশে গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহের অবস্থা এখনো হয়নি'

মরিয়ম মারিয়া
মরিয়ম মারিয়া

বাংলাদেশে সংগীত শিল্পীদের মধ্যে ইউটিউব নির্ভরতা ক্রমাগত বাড়ছে। ইউটিউবে গান লোড করে শিল্পীরা দর্শক-শ্রোতাদের তা উপভোগ করার সুযোগ করে দেন, যা থেকে শিল্পীরাও পান গানের রয়্যালটি বাবদ অর্থ। প্রযুক্তির কল্যাণে দর্শক-শ্রোতারাও পাচ্ছে নতুন নতুন সংগীত শিল্পীকে, যাদের গান মুগ্ধ করছে সবাইকে। এমনই একজন মরিয়ম মারিয়া। গান গেয়ে সংগীতপিপাসুদের হৃদয় কাড়া এ শিল্পী বললে, ‘মাঝখানে বাংলাদেশে অডিও শিল্পের অবস্থা বেশ খারাপ ছিল। এখন সেই তুলনায় অনেক ভালো। ইউটিউবের কারণে শিল্পীরা উপকৃত হচ্ছেন। গানের রয়্যালটি পাচ্ছেন। তবে এখনো বাংলাদেশে গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহ করার মতো অবস্থা তৈরি হয়নি। হাতে গোনা কয়েকজন শিল্পী এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। জীবন ধারণের জন্য বেশির ভাগ শিল্পীকেই গানের পাশাপাশি অন্য কিছু করতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ থেকে সম্প্রতি নিউইয়র্কে বেড়াতে এসেছেন সংগীতশিল্পী মরিয়ম মারিয়া। কিন্তু ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। ফলে গানের মানুষ মরিয়ম মারিয়াকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গাইতে হচ্ছে। বেড়ানোর ফাঁকেই প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা কার্যালয়ে এসেছিলেন তিনি। সেখানেও সবাইকে গান গেয়ে শোনালেন তিনি।
মরিয়ম মারিয়াকে মিডিয়ার অনেকের মতো আমিও চিনতাম একজন টেলিভিশন প্রযোজক হিসেবে। তাঁর সংগীত প্রতিভার কথা জানা ছিল না। ২০১২ সালে একুশের দুপুর অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে অংশ নিতে গিয়ে মরিয়ম মারিয়ার সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয়। তখনো জানতাম না যে, তিনি একজন সংগীত শিল্পী!
২০১৬ সালে নিউইয়র্ক বইমেলায় অতিথি শিল্পী হিসেবে গান গাইতে আসেন মরিয়ম মারিয়া। সেখানে তাঁর সুললিত কণ্ঠের গান শুনে যুগপৎ মুগ্ধ ও বিস্মিত হই। এ নিয়ে মরিয়ম মারিয়া বলেন, ‘আগেই বলেছি, গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহ করার মতো অবস্থা এখনো বাংলাদেশে হয়নি। তাই জীবনের প্রয়োজনে একুশে টেলিভিশনসহ অনেক জায়গায় কাজ করেছি। তবে আমার প্রথম ও প্রধান ভালোবাসা হলো সংগীত।’
মারিয়া বেড়ে উঠেছেন সংগীতের আবহে। বাড়িতে ছোটবেলা থেকে দেখেছেন মা সংগীত চর্চা করছেন। শুধু মা নন, খালা ও খালাতো বোনেরাও গানের সঙ্গে যুক্ত। খালাতো বোন পাপিয়া আশরাফ এ নিউইয়র্ক শহরের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের পরিচিত মুখ। মারিয়ার জন্ম যেখানে, সেই যশোর শহরে বরাবরই সাংস্কৃতিক চর্চা ছিল অত্যন্ত বেগবান। মারিয়ার জন্ম যশোর জেলা শহরের ঘোপ সেন্ট্রাল রোডে। বাবা শেখ গোলাম পাঞ্জাতন ও মা রিজিয়া খাতুনের দুই মেয়ের মধ্যে মারিয়া বড়। মায়ের ইচ্ছা ছিল মেয়ে তাঁর মতো গান-বাজনা করুক। পরিবারের সবার অনুপ্রেরণায় মাত্র চার বছর বয়সে মারিয়া স্থানীয় শিশু একাডেমিতে সংগীত বিভাগে ভর্তি হন।
মারিয়ার সংগীতের হাতেখড়ি যশোর শিশু একাডেমির শিক্ষক লিয়াকত আলী খানের কাছে। পঞ্চম কি ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় চলে আসেন যশোর শিল্পকলা একাডেমিতে। ওখানে শাহ মোহাম্মদ মোর্শেদের কাছে নজরুলগীতি ও ওস্তাদ মোশাররফ হোসেনের কাছে ধ্রুপদি সংগীতের তালিম নেন মারিয়া। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় শিক্ষক শাহ মোহাম্মদ মোর্শেদের হাত ধরে যুক্ত হন যশোরের নামকরা সংগীত সংগঠন ‘সুরবিতান’-এর সঙ্গে। ওখান থেকেই খুলনা বেতারে সংগীত শিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন মারিয়া। বাংলাদেশের নামকরা সংগীত পরিচালক প্রণব ঘোষ একবার যশোর সুরবিতানের এক অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে আসেন। সে সময় কলেজ-ছাত্রী মারিয়ার গান শুনে মুগ্ধ হয়ে প্রণব ঘোষ বলেন, ‘তুমি ঢাকা আস। আমি তোমার একটি অ্যালবাম করে দেব।’
যশোরের এম এম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে স্নাতক করে ১৯৯৭ সালে ঢাকায় আসেন মারিয়া। সেখানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন মাস্টার্সে। সুরকার প্রণব ঘোষের সুরে সংগীতার ব্যানারে মারিয়ার প্রথম গানের অ্যালবাম বের হয়। ওই অ্যালবামে শিল্পী দিলরুবা খানের একটা গান রিমেক করা হয়েছিল। গানের কথা ছিল দেখা আরিচার ঘাটে/ শাহজালাল ফেরিতে— গানটি তখন ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। ২০০১ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে আধুনিক ও লোক সংগীত শিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন মারিয়া। এই পুরো অভিযাত্রায় সংগীত শিক্ষা থামেনি। ঢাকায় এসে ওস্তাদ সঞ্জীব দের কাছে গানের তালিম নেওয়া শুরু করেন মারিয়া। সঙ্গে নিয়মিত অনুশীলন তো রয়েছেই। মারিয়ার দৃষ্টিতে, ‘ভালো গান করার অপরিহার্য অনুষঙ্গ হলো নিয়মিত অনুশীলন। অনুশীলন করলেই একজন শিল্পী দীর্ঘদিন গান গাইতে পারেন।’
গানের পাশাপাশি মারিয়া চাকরি নেন বিটিআই ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে সংগীত শিক্ষক হিসেবে। পরে এসটিভি ইউএসএর প্রযোজক হিসেবে যোগ দেন। পড়াশোনা চলাকালেই ১৯৯৯ সালে বিয়ে হয় তাঁর। ২০০১ সালে যোগ দেন একুশে টেলিভিশনে।
চাকরির পাশাপাশি সংগীত চর্চা, স্টেজ শো, অ্যালবাম প্রকাশ কোনো কিছুই থেমে থাকেনি। এর মধ্যেই দুই ছেলের মা হন তিনি। চাকরি ও সংসার দুই সামলে দেশে ও দেশের বাইরে প্রচুর অনুষ্ঠানে অংশ নেন নিয়মিত। শুধু নিউইয়র্কেই গান করতে আসছেন টানা পাঁচ বছর ধরে।
মরিয়ম মারিয়া গাওয়া একটি গান সম্প্রতি খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ইমপ্রেস টেলিফিল্মের ব্যানারে শাহরিয়ার নাজিম জয় পরিচালিত সিনেমা ‘ও রাধা’য় থাকা একমাত্র গানটি গেয়েছেন মারিয়া। শাহরিয়ার নাজিম জয়ের লেখা গানটির সুর করেছেন শান।
মারিয়া বলেন, ‘আমরা যারা সৎভাবে গান গাওয়ার চেষ্টা করি, তাদের জন্য ইন্ডাস্ট্রিতে টিকে থাকা বিরাট একটা চ্যালেঞ্জ। কাকা-মামার জোর নেই বলে সুযোগ খুব কম পাই। একটা লাইভ প্রোগ্রাম পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়।’
অনেকে বলেন, সংগীত এখন যত না শোনার, তার চেয়ে বেশি দেখার। এই নিয়ে মারিয়ার বক্তব্য, ‘বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের শিল্পীদেরও মিউজিক ভিডিও বানানোর একটা প্রবণতা দেখা দিয়েছে। তবে গান যদি শ্রুতিমধুর না হলে ভিডিও বেশি দিন দেখে না মানুষ।’
স্টেজ শো নিয়েও তাঁর রয়েছে স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি। স্টেজে গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন নিয়ে মারিয়ার মত, ‘বিভিন্ন খোলা মঞ্চের অনুষ্ঠানে কিছু লোক আসে গানের সঙ্গে নাচতে। তাদের সংখ্যা কম। বেশির ভাগ মানুষ গান শুনতেই আসে।’
মারিয়ার গানের শুরুটা ছিল নজরুল সংগীত দিয়ে। ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির এক প্রতিযোগিতায় তৃতীয় হয়েছিলেন তিনি। ওই প্রতিযোগিতায় সারা বাংলাদেশ থেকে আসা শিল্পীরা অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু পরে উন্মুক্ত মঞ্চে গাওয়ার জন্য লোকসংগীতকে বেছে নেন। পাশাপাশি আধুনিক গানও করেন। এ পর্যন্ত দুটি একক অ্যালবাম আর বহু ‘মিক্সড’ অ্যালবাম প্রকাশ হয়েছে তাঁর। নার্গিস আক্তারসহ বহু নামকরা পরিচালকের সিনেমাতে গান করেছেন তিনি। তাঁর প্রিয় সংগীত শিল্পীর তালিকায় দেশে-বিদেশি একাকার। এর মধ্যে সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লা, আশা ভোঁসলে, লতা মঙ্গেশকর, মান্না দে, সামিনা চৌধুরী উল্লেখযোগ্য।