সেই ভয়াল দিনের দুঃসহ স্মৃতি

দিনটি কেউ ভুলবে না। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর। ২০ হাজার গ্যালন জ্বালানি পেটে নিয়ে সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে আমেরিকান এয়ারলাইনসের একটি বোয়িং ৭৬৭ বিমান এসে আঘাত করল বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার উত্তর টাওয়ারে।
বিমানের আঘাতে ১১০ তলা এই ভবনটি ধূলিসাৎ হয়ে গেল। খবর পেয়েই টেলিভিশন ক্যামেরা এসে হাজির হলো, সরাসরি দেখানো শুরু হলো এই মর্মান্তিক ঘটনা। তখনো কেউ ভাবতে পারেনি আরও একটি আঘাত আসছে কিছুক্ষণ পরে। ১৮ মিনিট পর আরেকটি বোয়িং ৭৬৭ এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার দক্ষিণ ভবনে। বিস্ফোরণে ধসে পড়ল এই ভবনটিও। সবাই বুঝল, এটি আসলে আকস্মিক কোনো ঘটনা নয়, আমেরিকার বিরুদ্ধে এটা ছিল পরিকল্পিত আঘাত। আগুনের লেলিহান শিখা তখনো ছড়িয়ে যাচ্ছিল ভবন দুটো জুড়ে।

পরিকল্পিত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড
সন্ত্রাসীরা ছিল সৌদি আরবসহ আশপাশের কয়েকটি দেশের মানুষ। এদের অর্থায়ন করেছিল ইসলামি সন্ত্রাসবাদী দল আল-কায়েদা। সন্ত্রাসী দলের কয়েকজন এক বছরেরও বেশি সময় ধরে আমেরিকায় বসবাস করছিল এবং আমেরিকার বাণিজ্যিক বিমান চালনার স্কুলে উড়ানের কৌশল শিখছিল। অন্যরা নাইন-ইলেভেনের মাসখানেক আগে আমেরিকায় ঢুকেছিল।
সেদিন সকালে ইস্ট কোস্টের তিনটি বিমানবন্দর থেকে নিরাপত্তারক্ষীদের চোখে ধুলো দিয়ে ক্যালিফোর্নিয়াগামী চারটি উড়োজাহাজে উঠে পড়েছিল ১৯ জন সন্ত্রাসী। এসব উড়োজাহাজ বেছে নেওয়ার কারণ হলো, উড়োজাহাজগুলো দূরবর্তী উড়ানের জন্য জ্বালানিসহ প্রস্তুত ছিল। রানওয়ে ছেড়ে আকাশে উঠত‌েই উড়োজাহাজগুলোর কর্তৃত্ব নিয়ে নেয় সন্ত্রাসীরা। জ্বালানিসহ এগুলো তখন একেকটি মিসাইলে পরিণত হয়েছে।

পেন্টাগন আক্রমণ ও ধসে পড়া টুইন টাওয়ার
সবার দৃষ্টি যখন নিউইয়র্কের দিকে, তখন আরেকটি বিমান ওয়াশিংটনের আকাশে চক্রাকারে ঘুরছিল। কিছুক্ষণ পর সেটা পেন্টাগনে প্রতিরক্ষা সদর দপ্তরের পশ্চিম ভবনে এসে বিধ্বস্ত হয়। তখন ৯টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট।
পেন্টাগনে হামলার পনেরো মিনিটের মধ্যেই নিউইয়র্কের দক্ষিণ টুইন টাওয়ারে ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা। ধোঁয়া আর ধুলো ছড়িয়ে ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ল পুরো ভবন। ঘণ্টায় ২০০ মাইল গতির বাতাস কিংবা বড়সড় অগ্নিকাণ্ড যে ভবনের কোনো ক্ষতিই করতে পারত না, সে ভবন ধসে পড়ল জেট ফুয়েল বা বিমানের জ্বালানি থেকে সৃষ্ট উষ্ণতার কারণে। উত্তর ভবনটি ভেঙে পড়ল ১০টা ৩০ মিনিটে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ভবন থেকে অক্ষত বের হতে পেরেছিলেন মাত্র ছয়জন মানুষ। প্রায় ১০ হাজার মানুষ আহত হয়েছিলেন, যাদের মধ্যে অনেকেরই আঘাত ছিল গুরুতর।

ফ্লাইট নম্বর ৯৩
ক্যালিফোর্নিয়াগামী চতুর্থ ফ্লাইটটির নম্বর ছিল ৯৩। নিউজার্সি থেকে উড্ডয়নের ৪০ মিনিট পর এই উড়োজাহাজটি ছিনতাই করা হয়। যাত্রীরা ততক্ষণে মুঠোফোনের মাধ্যমে জেনে গিয়েছিল, নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটনে বিমান-মিসাইল হামলার কথা। বিমানটি বিমানবন্দরে ফিরে আসবে না জেনে যাত্রী ও বিমান ক্রুয়েদের কয়েকজন ঠিক করেছিল, ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে লড়বে। টমাস বারকেট জুনিয়ার নামের এক যাত্রী ফোনে তাঁর স্ত্রীকে বলছিলেন, ‘আমি জানি, আমরা সবাই মারা যাব। আমাদের তিনজন কিছু একটা করার চেষ্টা করছে। আমি তোমাকে ভালোবাসি, প্রিয়তমা’। বিমানবালা স্যান্ডি ব্র্যাডশ একটি পাত্রে গরম পানি নিয়ে তৈরি হয়েছিলেন। তিনি তাঁর স্বামীকে ফোন করে বলেছিলেন, ‘সবাই প্রথম শ্রেণির দিকে যাচ্ছে। আমিও চললাম। বিদায়।’
চারজন ছিনতাইকারীর সঙ্গে লড়াই করেছিল যাত্রীরা। ভাবা হয়, তাঁরা ককপিটে ঢুকে পড়েছিল অগ্নিনির্বাপক গ্যাস নিয়ে। এরপর বিমানটি উল্টে-পাল্টে গিয়ে ঘণ্টায় ৫০০ মাইল গতিতে পশ্চিম পেনসিলভানিয়ার শাঙ্কসভিলের অদূরে একটি গ্রামে ১০টা ১০ মিনিটে বিধ্বস্ত হয়েছিল। প্লেনে থাকা ৪৪ জনই মারা গিয়েছিল। এই ছিনতাইকারীরা কোথায় আঘাত হানবে, সে কথা শুধু অনুমানই করা যায়। মনে করা হয়, সেটা হতে পারে হোয়াইট হাউস, ক্যাম্প ডেভিড কিংবা ইস্টার্ন সিবোর্ডের কাছে অবস্থিত পারমাণবিক কেন্দ্র।

কত মানুষ মারা গিয়েছিল?
নাইন-ইলেভেনের হত্যাযজ্ঞে মারা গিয়েছিল ২ হাজার ৯৯৬ জন মানুষ। এদের মধ্যে ছিল চারটি উড়োজাহাজে থাকা ১৯ জন সন্ত্রাসবাদী। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় মৃতের সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৭৬৩ জন। এদের মধ্যে ভবনে থাকা মানুষ, উড়োজাহাজের যাত্রী, সন্ত্রাসী ছাড়াও ছিল ৩৪৩ জন দমকলবাহিনীর সদস্য, ২৩ জন নিউইয়র্ক নগর পুলিশ কর্মকর্তা এবং ৩৭ জন পোর্ট অথোরিটি পুলিশ কর্মকর্তা। তাঁরা ঘটনার শিকার মানুষকে নিরাপদে বের করে আনার কাজে সচেষ্ট ছিলেন।
পেন্টাগনে মারা গিয়েছিলেন ১৮৯ জন। এদের মধ্যে ফ্লাইট ৭৭-এর ৬৪ জন ছিলেন। আর ফ্লাইট ৯৩, যেটি পেনসিলভানিয়া বিধ্বস্ত হয়েছিল, তাতে ছিল ৪৪ জন।

সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ
এই মর্মান্তিক ঘটনার পর আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দিয়ে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ শুরু করেন। এরপর আফগানিস্তান ও ইরাকে দুটি যুদ্ধে জড়িয়েছে আমেরিকা। সে যুদ্ধের রেশ এখনো চলছে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে এই দুই দেশের নিরীহ মানুষও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। যুদ্ধের কারণে পুরোনো ঐতিহ্য ধ্বংস হয়েছে। প্রচুর রক্তক্ষয় হয়েছে। নাটের গুরু ওসামা বিন লাদেনকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেছে মার্কিন গোয়েন্দারা। পরে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমলে ২০১১ সালের ২ মে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে মার্কিন সেনারা অভিযান চালিয়ে লাদেনকে হত্যা করে।

স্মৃতি নিয়ে থাকা
নিউইয়র্কের বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের যে দুটি ভবন ধসে পড়েছিল, সেখানে এখন নাইন-ইলেভেন স্মৃতি জাদুঘর। বাইরে জিরো পয়েন্টে বিশাল একটি জলাশয় তৈরি করে তার কালো দেয়ালে লিখে রাখা হয়েছে সে হামলায় নিহত ব্যক্তিদের নাম। তাদের স্মৃতির উদ্দেশে একটা বিপণিবিতান গড়ে তোলা হয়েছে। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এই জায়গায় আসেন ঘুরতে। পর্যটকেরা এখানে এসে কিছুটা সময় কাটান, সে দিনের দুর্বিষহ ঘটনার কথা মনে করেন, শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন নিহতদের।
দ্য ন্যাশনাল সেপ্টেম্বর ইলেভেন মেমোরিয়াল অ্যান্ড মিউজিয়ামটি মূলত নিউইয়র্কবাসীর কাছে নাইন-ইলেভেন মিউজিয়াম নামেই পরিচিত। নিউইয়র্কের ১৮০ গ্রিনউইচ স্ট্রিটে এর অবস্থান। মেমোরিয়ালটি ২০১১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ওই ঘটনার শিকার মানুষের স্বজনদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছিল। পরদিন তা সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়।
যেখানে লেখা আছে হামলায় নিহতদের নাম সেই মেমোরিয়ালে যেতে টিকিট কাটতে হয় না। জাদুঘরটি দেখতে টিকিট লাগে। অনলাইনে টিকিট কেনা যায়। মিউজিয়ামের সামনে লাইনে দাঁড়িয়েও টিকিট কেনা যায়।

‘৪০’ সংখ্যাটি কথা বলে
১৭ বছর পর শেষ হয়েছে আরেকটি কাজ। নাইন-ইলেভেন স্মরণে যে মেমোরিয়াল বা স্মৃতিস্তম্ভের পরিকল্পনা করা হয়েছিল, এটা তার শেষটি। এর নাম ‘দ্য টাওয়ার অব ভয়েজ’। এটি নির্মিত হচ্ছে পেনসিলভানিয়ার শ্যাঙ্কসভিলে বিধ্বস্ত বিমানটির নিহত যাত্রীদের স্মরণে। স্মৃতিস্তম্ভটি হবে ৯৩ ফুট উঁচু। এর কারণ, বিধ্বস্ত বিমানটির ফ্লাইট নম্বর ছিল ৯৩। এখানে থাকবে ৪০টি ঘণ্টি, যা বাতাসে আওয়াজ তুলবে। বিমানে ক্রু ও যাত্রীরা মিলে যে ৪০ জন ছিলেন, তাদের কথা স্মরণ করেই এটা ভাবা হয়েছে। এর উদ্বোধন হবে ১১ সেপ্টেম্বর।