সন্তানের গেজেট আসক্তি কমাবেন যেভাবে

গেজেট আসক্তি কাটাতে সন্তানের সঙ্গে গল্প করুন, ছবি আঁকুন। মডেল: মা সাজরীর সঙ্গে মেয়ে সুমাইসা
গেজেট আসক্তি কাটাতে সন্তানের সঙ্গে গল্প করুন, ছবি আঁকুন। মডেল: মা সাজরীর সঙ্গে মেয়ে সুমাইসা

অপত্যস্নেহ আর নির্মোহ ভালোবাসার এক চিরন্তন সম্পর্ক মা আর সন্তানের। মায়েরা সন্তানদের জড়িয়ে রাখে স্নেহের ওমে; আগলে রাখে ভালোবাসার নির্ভরতা দিয়ে। পাখির ছানার মতো ওরা একটু একটু করে বেড়ে ওঠে মায়েদের নির্মোহ ভালোবাসার ডানার তলায়।
সন্তানের ভালো লাগা, ভালো থাকাতেই মায়েদের সর্বোচ্চ তৃপ্তি। তবে সন্তানদের শুধু স্নেহ-ভালোবাসা দেওয়াতেই মায়ের দায়িত্ব শেষ হয় না। তাকে ভালো-মন্দের ফারাক বুঝিয়ে মানবিকতার চর্চায় উৎসাহিত করে নৈতিকতার মূল সুরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে হয়। এর মধ্য দিয়েই মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষ হিসেবে সন্তানকে গড়ে তোলে একজন মা। একটি শিশুর বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হলেও মায়ের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। মা সত্তাটি মূলত ত্যাগেরই সমার্থক।
নিজের জঠরে ধারণ করা সন্তানের হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানি শুরু হওয়ার আগেই শুরু হয়ে যায় মায়ের ত্যাগ। পরিবর্তিত অচেনা হরমোনের প্রভাবে মায়ের খাওয়া থেকে ঘুম, শরীর থেকে মন; বলতে গেলে স্বাভাবিক জীবনযাত্রার প্রতি পদেই আসে অভাবনীয় পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতেই শুরু হয় বদলে যাওয়ার এক নতুন আখ্যান। নিজেকে আমূল বদলে ফেলার লড়াইয়ে ‘মা’ ত্যাগ করে দীর্ঘদিনের লালন করা ‘নিজেকেই’। আর এরপর নিজের দেহের সবটুকু দিয়ে গড়া সন্তান যেদিন ভূমিষ্ঠ হয়, সেদিন পৃথিবীর ঠিক কতটা নড়চড় হয়, তা জানা না গেলেও নাড়ি ছেঁড়ার প্রাক্কালে প্রতিটি মায়ের জীবন যে আমূল বদলে যায়, তা হলফ করে বলা যায়। সে বদল আসে একটি লড়াইয়ের রূপ ধরে। সে লড়াই কখনো হয় পৃথিবীতে আসা সদ্যোজাতকে সুস্থ রাখার। আবার কখনো সন্তানকে জীবনের এক-একটি ধাপ অতিক্রম করানোর। এসবের মধ্যেই মা ত্যাগ করে নিজের জন্য বরাদ্দকৃত সময় থেকে ক্যারিয়ার পর্যন্ত!

যে সন্তানদের ঘিরে মায়ের এত ত্যাগ, তাদেরকে জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের ধাপ অতিক্রম করতে সাহায্য করাটা শুধু কর্তব্যই নয়, অনিবার্যও বটে। ছোট্ট শিশু একতাল কাদামাটি। সেই মাটি নিয়ে যেমন গড়া যায় মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষ; আবার একটু অযত্নে হয়ে উঠতে পারে মানবিকতা বিবর্জিত এক মানুষের কাঠামো। এ ক্ষেত্রে একজন মায়ের প্রত্যক্ষ ভূমিকা খুবই গুরুত্ববহ।
আজকাল অনেক মা-ই নিজের অজান্তেই সন্তানদের মানসিক বিকাশের জায়গা অবরুদ্ধ করে ফেলছে। সন্তানদের করে তুলছে যান্ত্রিক। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের ডিভাইস মূল ভূমিকা পালন করছে। সবুজ মাঠে, কাদা-বালি-জলে যে শৈশব অতিবাহিত হওয়ার কথা, তা এখন অতিবাহিত হয় আট শ বর্গফুটের বদ্ধ ঘরে। আর প্রবাস বা শীতপ্রধান দেশে বেড়ে ওঠা বাচ্চাদের অবস্থা তো আরও বাজে। ছেলেবেলা থেকেই ওদের হাতে আইপ্যাড, ট্যাব তুলে দিয়ে ওদেরকে মানসিকভাবে অথর্ব করে তোলা হচ্ছে একটু একটু করে। আইপ্যাড বা ট্যাবে বাচ্চারা শুধু ভিডিও দেখে; বড়জোর গেম খেলে। এ ক্ষেত্রে বাচ্চাদের মননশীলতার চর্চা প্রায় হয় না বলতে গেলে। আর মননশীল চর্চা ব্যতীত একটি শিশু কখনোই মানবিক হয়ে উঠতে পারে না। এই ভিডিও দেখা বা গেম খেলতে গিয়ে ওদের কল্পনাশক্তিটুকু অব্যবহৃত থেকে যায় পুরোপুরি। শারীরিক আর মানসিক শ্রমহীন এসব কাজে আস্তে আস্তে ওরা আসক্ত হয়ে পড়ে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওরা হারিয়ে ফেলে ওদের সৃজনশীলতা।
কিন্তু এখনকার শিশুদের প্রযুক্তির এ বিস্ময় থেকে কতটা দূরে রাখা সম্ভব! এ থেকে উত্তরণের পথটাইবা কী? এটা সত্য যে, আইপ্যাড বা ট্যাবে আসক্ত বাচ্চাকে সেসব থেকে নিরাসক্ত করা খুব কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। একজন মা চাইলে সব পারেন। তাই মাকেই এ ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা নিতে হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না সৃজনশীল চর্চাই এ ক্ষেত্রে মুক্তি দিতে পারে। ছবি আঁকা, গল্প বানানো—এমন নতুন কিছু করা, শুধু দেখতে হবে শিশুটির আগ্রহ কোনটাতে বেশি। সেদিকে খেয়াল রেখে নিয়ম করে প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ে বসতে হবে সন্তানকে নিয়ে। ছবির প্রতি আগ্রহ থাকলে তার হাতে তুলে দিন অনেক কাগজ আর রং-তুলি। আঁকতে বলুন ওর যা ভালো লাগে। প্রতিদিন একটা সময়ে আপনার সন্তানের হাতে তুলে দিন একটি গল্পের বই। বই পড়া শেষ হলে কাগজ আর রং-পেনসিল এগিয়ে দিয়ে বলতে পারেন, ‘যা পড়লে এতক্ষণ, এবার তা এঁকে দেখাও’। গল্পের চরিত্র আর ঘটনা সব উঠে আসবে কাগজে, আর রঙের স্পর্শে তা হয়ে উঠবে জীবন্ত। আঁকতে দিন তার নিজের মতো করেই।
ওদেরকে সঙ্গে নিয়ে খেলা যেতে পারে গল্প বানানো খেলা। গল্প-দাদুর আসনে নিজে একা না বসে, সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে বসুন। সবাই মিলে গল্প বানান। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে গল্পের বায়নাটি আপনিই করতে পারেন। অথবা প্রথমে নিজে শুরু করে পরে সন্তানকে বলুন, যাতে সে পরের অংশটি তৈরি করে। এভাবে একটা পুরো গল্প বানিয়ে ফেলুন যৌথভাবে। প্রতিদিন এমন খেলায় মাতিয়ে রাখুন সন্তানকে। দেখবেন গেজেট নয় সৃষ্টিশীল এসব খেলার দিকেই আগ্রহী হবে সন্তানটি। সৃষ্টিশীল এসব চর্চার মাধ্যমে হয়ে উঠবে আত্মবিশ্বাসী।