কুইবেকের ফরাসি সাহিত্যের একচ্ছত্র অনুবাদক

শীলা ফিচম্যান
শীলা ফিচম্যান

কানাডার কুইবেক প্রদেশে যে বাঙালিরা বাস করেন তাঁরা বাধ্যতামূলকভাবে ফরাসি ভাষা শেখেন এবং প্রয়োজন মতো ফরাসি সাহিত্য পড়তে সক্ষমতা অর্জন করতে পারেন। অন্য প্রদেশের বাসিন্দা আমাদের জন্য সেটি খুব বেশি স্বাভাবিক হয় না। আর তাই আরও অনেক বাঙালির মতো ফরাসি ভাষায় রচিত কানাডীয় সাহিত্য আমারও পড়তে দেরি হয়ে যায়। যেটুকু পড়া-জানা হয় সেটুকুও অনুবাদের মাধ্যমে। কম্বোডিয়ার বংশোদ্ভূত কুইবেকের ঔপন্যাসিক কিম টুই (জন্ম: ১৯৬৮) রচিত গভর্নর জেনারেল পুরস্কারপ্রাপ্ত উপন্যাস ‘রু’ পড়তে গিয়ে শীলা ফিচম্যানের (জন্ম: ১৯৩৭) নামের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। ২০০৯ সালে ফরাসি ভাষায় উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয়। ২০১০ সালে পুরস্কারটি আসে। শীলা সেটিকে অনুবাদ করেন ২০১২ সালে। বইয়ের ফ্ল্যাপে অনুবাদক শীলা সম্পর্কে লেখা ছিল যে তিনি ‘সমকালীন কুইবেকের এক শ পঞ্চাশটির মতো উপন্যাস ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন।’ সংখ্যাটি বর্তমানে দুই শ ছুঁই ছুঁই।
আমি ফরাসি জানি না। কিন্তু ফরাসি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করা ‘রু’ পড়তে পড়তে মুগ্ধ হতে থাকি। সেই মুগ্ধতা কিমের আরেক উপন্যাস ‘মান’ ছাড়িয়ে একসময় ‘ভি’ অতিক্রম করে। এরপর সে মুগ্ধতা অ্যান হিবার্টের (১৯১৬-২০০০) ‘অ্যাম আই ডিসটার্বিং ইউ?’ (মূল ফরাসিতে প্রকাশ ১৯৯৮। ইংরেজি অনুবাদ ১৯৯৯) পর্যন্ত গড়াতে শুরু করে। শুধুই মনে হতে থাকে অনুবাদের প্রতি কতটা প্রীতি থাকলে এমন মমতা দিয়ে ভাষাটি তৈরি করা যায়। কতটা ভালোবাসা থাকলে সংখ্যাটি দুই শ অতিক্রম করতে পারে।
২০১৭ সালের নভেম্বরে ‘ওয়ালরাস’ পত্রিকায় ডেরেক ওয়েবস্টারের একটি অসামান্য লেখা প্রকাশিত হয়েছে। শিরোনামটি হলো ‘হাউ ওয়ান ট্রান্সলেটর ব্রট কুইবেক’স গ্রেটেস্ট অথরস টু ইংলিশ কানাডা’। আমরা সেই প্রবন্ধ থেকে জানতে পারি ১৯৬৮ সালে পারিবারিক এক লেখক-আড্ডার ভেতর দিকে শীলা ইংরেজি-ফরাসি ভাষার দূরত্ব কাটানোর ব্যাপারে স্থিরচিত্ত হন। আর তারই পরিণতিতে আমরা দেখি, ১৯৯৮ সালে তিনি অনুবাদে গভর্নর জেনারেল পুরস্কার লাভ করেন। যদিও সত্যি কথা হলো, তাঁর নামটি পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হয়েছিল আরও ১৭ বার। এর বাইরে ১৯৭৪ ও ১৯৮৪ সালে তিনি অনুবাদের জন্য কানাডা কাউন্সিল পুরস্কার পেয়েছেন। এক লাখ ডলারের স্কোশিয়া ব্যাংক গিলার পুরস্কারের জন্যও তাঁর নাম ২০০০, ২০০৬ ও ২০১২ সালে সংক্ষিপ্ত তালিকায় উঠেছিল।
শীলার স্বামী ছিলেন ডি জি জোনস (১৯২৯-২০১৬)। আধুনিক কানাডীয় কবিতার পুরোধা ব্যক্তিত্ব। ১৯৬৯ সালে তাঁরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। কুইবেকের ছোটো যে শহরে তাঁরা বাস করতেন সেখানে ইংরেজি ও ফরাসি উভয় ভাষাভাষী লেখক-কবি বন্ধুরাই সমবেত হতেন। দুই ভাষার বন্ধুদের মধ্যে সাহিত্য-সংযোগ বৃদ্ধির কল্পেই একদিন তিনি তাঁর প্রতিবেশী ফরাসিভাষী কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকার রচ ক্যারিয়ারের (জন্ম: ১৯৩৭) প্রথম উপন্যাস ‘লা গুয়ের, ইয়েস স্যার’ অনুবাদে হাত দেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন কুইবেকের প্রেক্ষাপটে রচিত এ উপন্যাসের অনুবাদটি ১৯৭০ সালে টরন্টোর খ্যাতনামা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান হাউস অব আনানসি থেকে প্রকাশিত হয়। পাঁচ দশক আগে শুরু সে যাত্রায় অনুবাদক হিসেবে শীলা এ পর্যন্ত করেছেন ১৫ লাখ শব্দের অনুবাদ। অনুবাদ ক্ষেত্রে তিনি এতই শক্তিধর এক ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন যে ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘লিটারারি ট্রান্সলেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব কানাডা’।
২০১৩ সালে ম্যাকগিল ও কুইন বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে প্রকাশিত ‘ইন ট্রান্সলেশন’ পত্রিকার একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। শেরি সাইমনের সম্পাদনায় সেই সংখ্যাটির প্রচ্ছদে লেখা ছিল ‘অনারিং শীলা ফিচম্যান’। ওই বছর শীলা তাঁর এক শ পঞ্চাশতম অনুবাদের কাজটি শেষ করেন এবং সে উপলক্ষেই ছিল এই আয়োজন। উল্লেখ করা যেতে পারে কানাডার দুটি বিশ্ববিদ্যালয় অটোয়া ও ওয়াটারলু শীলাকে তাঁর অনুবাদের জন্য সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দিয়েছে। এর আগে ২০০০ সালে তাঁকে অর্ডার অব কানাডীয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
শীলার করা যে অনুবাদ-উপন্যাসটি ফরাসি থেকে ইংরেজি অনুবাদের জন্য গভর্নর জেনারেল পুরস্কার লাভ করেছিল সেটির নাম ‘বামবি অ্যান্ড মি’। মিশেল ট্রেম্বলে (জন্ম: ১৯৪৭) রচিত এই উপন্যাসটি আসলে একটি আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ। মিশেলের অন্য যে সব গ্রন্থ শীলা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন সেগুলো হলো: অ্যা ক্রসিং অব হার্টস (২০০৭), ক্রসিং দ্য সিটি (২০০৮), ক্রসিং দ্য কন্টিনেন্ট (২০১১। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা যেতে পারে যে মিশেলের এই উপন্যাসগুলো ক্রসিং সিরিজ নামে পরিচিত। মিশেলের অন্য আরও যে উপন্যাসগুলো শীলা ইংরেজিতে এনেছেন তার মধ্যে রয়েছে দ্য ফ্যাট ওম্যান নেক্সট ডোর ইন প্রেগন্যান্ট (২০১০), অ্যা থিং অব বিউটি (২০১০), দ্য রেড নোটবুক (২০১০), দ্য ব্ল্যাক নোটবুক (২০১০), দ্য ব্লু নোটবুক (২০১০), বার্থ অব আ বুকওয়ার্ম (২০১০) ইত্যাদি।
অনুবাদের তালিকায় ফরাসিভাষী আরও একজন গুরুত্বপূর্ণ লেখক হলেন অ্যান হেবার্ট। তিনবার গভর্নর জেনারেল পুরস্কার পাওয়া এই বহুল নন্দিত ঔপন্যাসিকের পূর্বোল্লিখিত গ্রন্থটি ছাড়া অন্য যে উপন্যাসগুলো শীলা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন সেগুলোর ইংরেজি নাম হলো ইন দ্য শ্যাডো অব দ্য উইনডো (মূল ১৯৮২, অনুবাদ ১৯৮৩), দ্য ফাস্ট গার্ডেন (মূল ১৯৮৮, অনুবাদ ১৯৯১), দ্য বার্ডেন অব ড্রিমস (মূল ১৯৯২, অনুবাদ ১৯৯৪), অ্যা সুইট অব লাইট (মূল ১৯৯৯, অনুবাদ ২০০০) এবং কালেকটেড ল্যাটার নভেলস (২০০৩) প্রভৃতি।
২০০৪ সালে প্যাসকেল কুইভিগারের (জন্ম: ১৯৬৯) প্রথম উপন্যাস ফরাসি ভাষার ক্যাটাগরিতে গভর্নর জেনারেল পুরস্কার পেয়েছিল। দ্য পার্ফেক্ট সার্কেল নামে ওই উপন্যাসটি ২০০৬ সালে শীলা অনুবাদ করেন এবং সেটি স্কোশিয়ার ব্যাংক গিলার পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়।
কুইবেকের আরেক স্বনামখ্যাত সাহিত্যিক লিস বিসোনেটের (জন্ম: ১৯৪৫) অনেকগুলো বই অনুবাদ করেছেন শীলা। বলে রাখা প্রয়োজন সাংবাদিক ও ব্যবসায়ী হিসেবে খ্যাত এই বহুল পরিচিত লেখিকা কানাডা ও আমেরিকার মোট দশটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডিগ্রি লাভ করেছেন। লিসের উপন্যাস ফলোয়িং দ্য সামার (১৯৯৩), অ্যাফেয়ার্স অব আর্ট (১৯৯৬), অ্যান অ্যাপ্রোপ্রিয়েট প্লেস (২০০২) ও গল্পগ্রন্থ ক্রুয়েলটিজ (১৯৯৮) অনুবাদ করেছেন শীলা।
ফ্রাঙ্কোয়েস গ্রাভেলের (জন্ম: ১৯৫১) যে সব গ্রন্থ ফরাসি ভাষা থেকে শীলা ফিচম্যান ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন সেগুলোর মধ্যে রয়েছে মাই লাইফ অ্যাজ অ্যা ক্রো (১৯৯৩ ), ওসটেন্ড (১৯৯৬ ), দ্য এক্সট্রা অর্ডিনারি গার্ডেন (২০০৫)।
১৯৭৮ সালে গভর্নর জেনারেল পুরস্কার পাওয়া কুইবেকের আরেক লেখক জ্যাক পলিনের (জন্ম: ১৯৩৭) নন্দিত গ্রন্থ ২০০৭ সালে স্প্রিং টাইড নামে অনুবাদ করেন শীলা। এর আগে অটাম রাউন্ডস (২০০২), ওয়াইল্ড ক্যাট (২০০৩), মাই সিস্টারস ব্লু আইয়েজ (২০০৭), মিস্টার ব্লু (২০১১), ট্রান্সশ্লেন ইজ অ্যা লাভ অ্যাফেয়ার (২০০৯), ভক্সওয়াগন ব্লুজ (২০১৪), ইংলিশ ইজ নট অ্যা ম্যাজিক ল্যাঙ্গুয়েজ (২০১৬) ইংরেজি করেন অনন্য এই অনুবাদক।
ফরাসি ভাষায় রচিত কথাসাহিত্যের জন্য গভর্নর জেনারেল পুরস্কার পাওয়া এলিজ টারকটের (জন্ম: ১৯৫৭) দ্য বডি’জ প্লেস (২০০৩), দ্য এলিয়েন হাউজ (২০০৪); গেতান সুচির (১৯৫৮-২০১৩) দ্য লিটল গার্ল হু ওয়াজ টু ফন্ড অব ম্যাচেস (১৯৭৭); আরেক পুরস্কারজয়ী লেখক মনিক ডুরান্ডের (জন্ম: ১৯৫৩) দ্য পেইন্টারস ওয়াইফ (২০১০); ল্যারি ট্রেমলি (জন্ম. ১৯৫৪) রচিত টকিং বডিজ (২০০১), দ্য বাইসাইকেল ইটার (২০০৫), দ্য ওবিজ ক্রাইস্ট (২০১৪), দ্য অরেঞ্জ গ্রোভ (২০১৫) প্রভৃতি উপন্যাসকে শীলা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। এ ছাড়া গভর্নর জেনারেল পুরস্কার পাওয়া লেখক ক্রিস্টিন ফ্রেনেটের (জন্ম: ১৯৫৪) টেরা ফারমা (১৯৯৯), দ্য হোল নাইট থ্রু (২০০৩), দ্য ওম্যান হু ওয়াকস অন গ্লাস’ (২০০৭) শীলার অনুবাদের কারণে ইংরেজিভাষী পাঠকের কাছে পরিচিত।
২০১২ সালের মার্চে বিবলিওসিস ইন্টারন্যাশনাল ট্রান্সলেশন ব্লগে শীলা ফিচম্যানের একটি অসামান্য লেখা আছে। সে লেখায় তিনি জানিয়েছেন, কানাডায় বর্তমান ইংরেজি থেকে ফরাসি বা ফরাসি থেকে ইংরেজি অনুবাদে যেসব সুযোগ-সুবিধা আছে সেগুলোর কথা। প্রতিতুলনায় বলেছেন পাঁচ দশক আগের পরিপ্রেক্ষিত। এই লেখা থেকে জানতে পারা যায় প্রথম বই অনুবাদের জন্য সদ্য প্রতিষ্ঠিত প্রকাশনা সংস্থা আনানসি তাঁকে আড়াই শ ডলার সম্মানী দিয়েছিল। অনুবাদ প্রকাশ এবং আর্থিক সম্মানীর ব্যাপারে মুগ্ধ শীলা প্রকাশক ও কবি ডেনিস লি সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘I wanted to kiss the feet of Dennis Lee....’ এরপর ধীরে ধীরে শীলা এমন একটি জায়গায় পৌঁছালেন যে প্রতিবছর তিনি তিন-চারটি করে উপন্যাস অনুবাদের সিদ্ধান্ত নেন এবং সেভাবেই সংসারের খরচ নির্বাহের ব্যবস্থা করেন। সেই সিদ্ধান্তই তাঁকে ক্রমে নিয়ে আসে অনুবাদক হিসেবে খ্যাতির বর্তমান উচ্চতায়। আর সে কারণেই ২০০৭ সালে ২৬ নভেম্বর টরন্টো স্টার পত্রিকায় একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘অ্যা লিভিং ব্রিজ বিটুইন সলিটিউডস’। শীলা ফিচম্যানকে নিয়ে সে প্রতিবেদনে জানা যায়, এই শীলারাই অনুবাদক জীবনের শুরুতে যুদ্ধ করেছেন যাতে বইয়ের প্রচ্ছদে অনুবাদকের নাম মুদ্রিত থাকে এবং সে যুদ্ধের পরিণতিতে শীলা আজ পুরো কানাডাতে ফরাসি সাহিত্যকে ইংরেজিভাষী পাঠকের কাছে উপস্থাপনের ব্যাপারে অগ্রগণ্য যোদ্ধা হিসেবেই প্রশংসিত।