একটি গল্পের তলানি

‘ব্যস এখানেই শেষ? খেল খতম, পয়সা হজম ?’
‘খতম আর হলো কই? এটা রেকর্ডের এক পিঠ। এখন সংক্ষেপে উল্টো পিঠটা বলি। মেডিকেলে পড়ার সময় এক ব্যাটা বড় বিরক্ত করত। একেবারে চিনে জোঁকের মতো পিছু লেগে থাকত। আপনাকে নিউইয়র্কে খুঁজতে আসার সেই ট্রিপের শোচনীয় পরিণতি এবং একেবারে খালি হাতে ফিরে যাওয়া দেখে ব্যাটার সাহস বেড়ে গেল। মনে জোর পেয়ে একদিন ক্যানটিনে বলল, ‘যে ভোমরা উড়ে গেছে, তার পেছনে জীবনটা অযথা খুইয়ে লাভ কী? তার চেয়ে বরং কাছের মানুষের হাতটা একটু শক্ত করে ধর। ঠকবে না, কথা দিলাম। প্রমিজ।’
আমি আদৌ পাত্তা না দিলেও পাত্র হিসেবে সে মোটেও ফেলনা ছিল না। মৃণাল আমার দু’বছরের সিনিয়র ছিল, ক্লাসের থার্ড বয়। ওর একটাই ডার্ক স্পট ছিল। টিবলী, মানে আমার মেয়ের মেজাজটা দেখলেন তো? ওটা ওর বাবার কাছ থেকেই পেয়েছে। হঠাৎ হঠাৎ রেগে যাওয়া, আর তার পর নিজেই নিজের ভুল বুঝতে পেরে, অনেক দুঃখ পেয়ে মাফ চাইতে আসা। আমার জগৎটা অলরেডি ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। তাই সমুদ্রে কুটিকে আঁকড়ে ধরার মতো শেষপর্যন্ত তার গলাতেই মালা পরাই। নীলরতন মেডিকেলে পাঁচ বছর কাজ করে আমরা লন্ডনে গিয়ে উচ্চতর পড়াশোনাটা শেষ করি -ও এফআরসিএস আর আমি এমআরসিওজি। ভেবেছিলাম দু’ একবছর না হয় চাকরি করে কিছু বিদেশি অভিজ্ঞতা অর্জন করি। তারপর দেশে ফিরে যাব। তা সেই দু’ এক বছর বিদেশে কাটাতে বিশ বছরের বেশি সময় লেগে গেল। পরে অবশ্য আমরা দেশে ফিরে গিয়ে একটা ক্লিনিক দিয়েছিলাম। সেটা আছে এখনো। মালিক আমরাই আছি। তবে মূলত জুনিয়াররাই ওটা চালায়। আজকাল কমিউনিকেশন অনেক উন্নত হয়েছে বলে বিজনেসটা চালাতে আর একটু সুবিধা হয়েছে”।
‘টিবলী কি আপনাদের, সরি, তোমাদের সঙ্গে ইন্ডিয়া ফেরত গেল?’
‘না, টিবলী যায়নি। ও লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস আর পরে হার্ভার্ডে পড়ে এখন ওয়াল স্ট্রিটের একটা ফার্মে কাজ নিয়েছে। হাজব্যান্ড অরিজিনালি ব্রিটিশ, কী যেন একটা কোম্পানির ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটিং ডিরেক্টর। সারা দুনিয়াটা বনবন করে ঘুরছে, এখন দুবাইতে ক্রিসমাস করছে তাদের গ্রুপ আর মিডল ইস্টের মাথা মাথা ক্লায়েন্টদের নিয়ে”।
‘তা, চিনে জোঁকের মতো লেগে থাকা, ঘড়ি ঘড়ি রেগে যাওয়া মিস্টার মজনুকে তো দেখছি না। উনি কোথায়?’
‘উনি আসলে এখন ওপরে। ক্যানসারের সঙ্গে তিন বছর টাগ অব ওয়ার করে শেষমেশ হার মেনে দড়ি ছেড়ে দিয়েছিলেন। তা প্রায় সাত আট বছর হতে চলল। ...... না, না, ঠিক আছে, কোনো সিম্প্যাথি লাগবে না। জানি, এখন বাবা, বিশেষ করে মা, মানে আপনাদের দিদির কথা জানতে চাইবেন। হ্যাঁ, ওনারাও এখন ওপর থেকে আশীর্বাদ পাঠাচ্ছেন। আর আমার দিদি, মানে বড় বোন জোনাকি? সেন্ট পলসে পড়ার সময় একটা খ্রিষ্টান ছেলের সঙ্গে তার ভাব হয়। আপনারা তো শুধু তার সঙ্গে ফস্টিনস্টিই মারলেন, কেউ সিরিয়াস হলেন না। তাই শেষমেশ দিদি ফিলিপকে বিয়ে করে গোয়াতে স্থায়ী হয়েছে। ভালোই করছে ওরা। চার চারটে হোটেলের মালিক। দুই ছেলে, এক মেয়ে, নাতি নাতনি নিয়ে ওরা সুখেই আছে।... আর কখনো সময় সুযোগ হবে কিনা জানি না। তাই এক নিঃশ্বাসে সব বলে ফেললাম।’
এতক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো একদৃষ্টে মোনালীর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে অমিত যেন গত কয়েক সেঞ্চুরির রোমাঞ্চকর ইতিহাস শুনে যাচ্ছিল। শিয়ালদার সেই ভিজে মুরগির মতো প্রায় নিস্তেজ, শুঁটকি, নিচুস্বর, মিতভাষী ছাত্রীর সঙ্গে আজকের মনোরম চেহারার, স্মার্ট, খলবল করে কথা বলা ডা. মোনালী সেনগুপ্তকে মনে মনে মেলাবার অসাধ্য চেষ্টা করছিল। ওর কথা আচমকা শেষ হতে যেন একটা ধাক্কা খেয়ে সে চেষ্টা থেমে গেল। ওদের ডিনার শেষ হয়ে গিয়েছে, ডেজার্টও। কফির কাপে শেষ চুমুকটা দিয়ে একটু নড়েচড়ে বসে অমিত বলল, ‘তারপর?’
‘আরে? পাগল নাকি? একটা মহাভারত নামিয়ে ফেললাম, তবু বলে তারপর? তারপর আবার কি, আঁ? এখন তোমারটা শোনাও, মানে সরি..., আপনারটা বলুন।’ ‘মেয়ে, জামাই, নাতি তো দেখলাম। উনি কোথায়?’
‘ওই যে বললে, ওপরে। তাও বেশ কয়েক বছর হতে চলল। অসুখ–বিসুখে নয়, অপঘাতে। আর সেটা রোড অ্যাক্সিডেন্টে নয়। নদীতে, জলে ডুবে। তা এত দিনে বোধ হয় ওপরে তোমার বাবা–মায়ের সঙ্গে ওর আলাপ হয়ে গেছে। হয়তো সকালে তারা একসঙ্গে মর্নিং ওয়াকে বের হয়। কিংবা কে জানে, হয়তো ঠিক আমাদের মতো, এই মুহূর্তে, সে তোমার সেই চিনে জোঁক দেবতার সঙ্গে এক টেবিলে বসে কফি খাচ্ছে আর এভাবেই তোমার আমার গল্প একে অপরকে শোনাচ্ছে। যাই বল, দু’পক্ষ মিলে ওদের চলে যাওয়ার টাইমিংটার অদ্ভুত মিল। তাই না?’
‘মশাইয়ের এত রস তখন কোথায় ছিল, জানতে পারি? এত সুন্দর হাসি অথচ কী প্যাঁচার মতো মুখ করে যে থাকতে। সরি, থাকতেন! তখন এর এক কণারও আভাস পেলে, লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে, চোখ বুজিয়ে একেবারে সোজা ঝাঁপিয়ে......যাকগে, তারপর?’
‘কী তারপর? বললাম তো সবকিছু।’
‘স্যার, ইহা নিতান্তই সামান্য, মানে অতি সংক্ষিপ্ত সমাচার, বিশেষ করে আমার হাজার বছরের ইতিহাসের পর। আমি সবকিছু শুনতে চাই ইন ডিটেল্‌স। নাহলে এখান থেকে উঠতে দেব না।’
‘বাস্তবিকই, আরও ডিটেল্‌স-এর কিছু নেই। আমার ব্যাপার–স্যাপার বেশ সংক্ষিপ্তই, ছিমছাম। নিউইয়র্কের ম্যানহাটন কলেজে হায়ার স্টাডিজ শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে তখনকার মোবিল অয়েল কোম্পানি আমাকে হায়ার করে। আমার ইমিগ্রেশনের ব্যাপারে তারা স্পনসর করে। তাদের রিফাইনারিতে তিন বছর কাজ করার পর তারা আমাকে পাঠিয়ে দিল মিডলইস্টে। সেখানে কয়েক বছর কাটানোর পর কোম্পানি আমাকে তাদের হিউস্টন অফিসে নিয়ে আসে। সেখানেই বর্তমান নিবাস। প্রতিবছর ক্রিসমাসে নিউইয়র্কে আসি মেয়েকে দেখতে কাম বেড়াতে। জ্যাকসন হাইট্‌সে বাঙালি পাড়ায় ঘুরে ঘুরে দেশি রেস্টুরেন্টগুলোতে দেশি কায়দায় লুচি, তরকারি, জিলিপি দিয়ে ব্রেকফাস্ট করি, সিঙ্গাড়া, নিমকি-বিস্কুট দিয়ে চা খাই। লাঞ্চ ডিনারে ইলিশ পোলাও বা মোরগ পোলাও, কাবাব আর গলদা চিংড়ি, রুপচাঁদা মাছ খাই। মেয়েকে লুকিয়ে, খাবার পর নানা ধরনের মনভোলানো মিষ্টিও খাই। তারপর বাংলা বই দোকানে গিয়ে বই, পত্র–পত্রিকা, সিডি, ডিভিডি—এসব কিনি। মেয়ের সুখের সংসারটা দেখে যাওয়া আর সেই সঙ্গে বেড়ানোর বেড়ানো। মানে দোল দেখার দোল দেখা আর কলা বেচার, কলা বেচা।’
‘নো ওয়ান্ডার, আমার নিউইয়র্কের ট্রিপটা তখন কেন বেকার গিয়েছিল। আমি খুঁজতে এসে ঘুরে ঘুরে মরছি আর আমার পাখি তখন মিডলইস্টে ডানা মেলে ফুর ফুর করে উড়ে বেড়াচ্ছে। আসলে আমার টাইমিংটাই তখন অফ্‌ ছিল। অথচ এখন তো আবার দিব্যি মিল খুঁজে পাচ্ছি। মানে আমিও তো এখানে ক্রিসমাস করতে আসি মেয়েকে দেখে যাওয়ার জন্য। আর ওই সঙ্গে ঘোরাফেরা, ভালো–মন্দ খাওয়া–দাওয়াটাও হয়। আমার মেয়ের আবার আমার মতো থিয়েটার দেখারও বাতিক আছে। তাই প্রতিবার এসে একবার ব্রডওয়ে থিয়েটারে যাওয়া হয়।’
‘থিয়েটারের শখ? আমারও তো। এত মিল? ওয়াও।’ এরপর দুজনেই চুপচাপ। কেউ কোনো কথা খুঁজে পায় না। নিস্তব্ধতা ভাঙে মোনালী।
‘একটা অনুরোধ কি করতে পারি? রাখতে পারলে খুশি হব, আই মিন অনেক ভালো লাগবে।’
‘বাহ, রাখব না কেন? তুমি আমার ছাত্রী না? শুধু ছাত্রী নয়। ভালো ছাত্রী, প্রিয় ছাত্রী। তোমার যে বর খুশি, নির্দ্বিধায় চাইতে পার।’
‘বেশি ছাত্রী ছাত্রী করলে এক্ষুনি বায়োলজির কথা আবার জিজ্ঞেস করব। না পারলে আসমান জুড়ে শর্ত দেব। সব মানতে হবে।’
‘ওরে বাপরে! বায়োলজি আমার যম। উপরন্তু তুমি তো এখন ডাক্তার। আচ্ছা কর অনুরোধ। ফোয়ারার মতো হলেও আপত্তি নেই, কেবল বায়োলজিটা বাদে। শর্ত যত খুশি তত। আমি রাজি।’
‘তাহলে এক এক করে বলি। এক, মুখ ফসকে যেটা বেরিয়ে গেছে, মানে তুমি বলে সম্বোধন করাতে কি আপনি চটেছেন?’
‘পাগল নাকি? নদী তো তার আপন গতিতেই বয়ে চলে। আমি বাধা দেওয়ার কে?’
‘দুই, প্রতি বছর এই সময়, মানে ক্রিসমাসের ছুটিতে নিউইয়র্কে দেখা করার প্রতিজ্ঞা কি পেতে পারি?’
‘অবশ্যই পার, এটা রাখাই মনে হয় আমার জন্য সবচেয়ে সহজ। নিজেরও একটা লেজুড় আছে না এখানে?’
‘তিন, আমি আর কলকাতায় না, এখন দিল্লিতে থাকি। একবার কি দিল্লিতে এসে আমার অতিথি হওয়ার অনুরোধ করতে পারি?’
‘অবশ্যই। যারপরনাই নাই চেষ্টা করব, দিল্লি যাওয়ার ইচ্ছে আমার সব সময়ের। এখন তা ডবল হয়ে গেল। ... কথা দিলাম।’
‘চার এবং শেষ অনুরোধ। চমকে যাবে না তো?’
‘আহা, বলেই দেখ না।’
‘একবার কি তোমার বুকের মধ্যে মাথা রেখে কিছুক্ষণ থাকতে পারি?’
‘বিলক্ষণ পার, বৎসে। এসো চলে।’

অমিত অধীর আগ্রহে হাত দুটো প্রসারিত করে, দু’চোখ বুজিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। দেরি লাগছে যেন। একটু পর অমিত চোখ বোজা অবস্থাতেই আওয়াজ পেল, ‘ও মাই গড, ভাগ্যে নেই। শালা আমার টাইমিংটা অলওয়েজ অফ্‌। মেয়ের ক্লোজ ফ্রেন্ড আর তার বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে ওয়েটারটা আমাদের পাশের খালি টেবিলের দিকে এগিয়ে আসছে। পলা দেখে ফেললে বিড়ম্বনার আর শেষ থাকবে না। উহ্‌, কী দুধে বিড়েলটা যে মুখ দিয়ে ফেলল! হার্ড লাক। আমি চলি। ...শোন সোনা, তুমি আমার ফোন নম্বর আর ঠিকানাটা হারিয়ে ফেলো না কিন্তু।’

( শিকাগো )