সঙ্গকাতর মানুষের নিঃসঙ্গতার সংগীত

টি এস এলিয়ট, জীবনানন্দ দাশ ও বুদ্ধদেব বসু
টি এস এলিয়ট, জীবনানন্দ দাশ ও বুদ্ধদেব বসু

ভালোবাসার ময়দানে বুদ্ধদেব বসু ১৯৫৩ সালে যা বলতে পেরেছেন, টি এস এলিয়ট ১৯১৫ সালে তা পারেননি। জীবনানন্দ দাশ ১৯৪২ সালেই তা পেরেছেন। বুদ্ধদেব ও জীবনানন্দ দুজনই আবার এই এলিয়ট নক্ষত্রের উদ্ভাসনে প্রতিভাসিত।
রাস্তার এপারের ছেলেটি তাকিয়েছে ওপারের ‘কোনো মেয়ের প্রতি’। সদ্যঃস্নাত মেয়েটি কালো পাড়ের সাদা শাড়ির আড়ালে থাকলেও তার ভিজে কালো চুল ছড়িয়ে আছে সাদা শেমিজের পেছনে সারা পিঠে। বসে আছে সেলাই-কলের কাছে ছোট টুলে। একটু কাছে আসতে চায় ছেলেটি, তাতে যদি মেয়েটির ভেজা চুলের বাষ্পে শীতল হয় রাস্তার ওপারের ছেলেটির দেহখানি। ‘কোনো মেয়ের প্রতি’ কবিতায় নাম না জানা ছেলেটি বলছে -

একটু সময় হবে? পাশে গিয়ে বসিব তোমার। …
সেলাই-কলের কাছে ছোটো টুলে রয়েছো বসিয়া।
সুতো বুঝি ফুরায়েছে? বই খোলা কোলের উপরে,
ভিজে কালো চুলগুলি এলায়ে পড়েছে সারা পিঠে,
শাদা শেমিজের ঘিরি’ কালো পাড় উঠেছে জড়ায়ে,
শাড়ির চওড়া পাড়, শাদা শাড়ি, মিশকালো পাড়।
ঠিক তব পাশে নয় - তবু কাছে, বসিবো, চৌকাঠে-
একটু সময় হবে?
(‘কঙ্কাবতী ও অন্যান্য কবিতা’ কাব্যগ্রন্থ, ১৯৫৩)

‘এখন যুদ্ধ পৃথিবীর সঙ্গে’ কবিতায় মধ্যবিত্ত ঘরের এই ছেলেটি আরও এগিয়ে যায়। সহজ সরল মনে সাহস করে বলেই ফেলে—

‘আমার চোখের সামনে স্বর্গের স্বপ্নের মতো দোলে
তোমার দুই বুক; স্বপ্নের গ্রন্থির মতো খোলে
তোমার চুল আমার বুকের উপর; ঝড়ের পাখির মতো দোলে
আমার হৃৎপিণ্ড; ...
কূল ছাপিয়ে উঠে তোমার দুই বুক
আমার হাতের স্পর্শে...’

১৯১৫ সালে প্রকাশিত এলিয়টের ‘দ্য লাভ সং অব জে আলফ্রেড প্রুফ্রক’ কবিতাটি বহন করে অন্য এক করুণ চিত্র। এখানে আমরা সজল নয়নে প্রত্যক্ষ করি এক প্রেমাসক্ত পুরুষের প্রেম নিবেদনে ব্যর্থতার অন্তর্ভাষণ। ফরাসি আধুনিক কবি জুলে লাফর্গ যেভাবে পরিহাস ও ব্যঙ্গরস মিশিয়ে খুব গুরুতর বিষয় নিবেদন করতেন তাঁর কবিতায়, এলিয়টও কবিতাটি সাজিয়েছেন অনেকটা সেভাবেই। কবিতার শিরোনামে প্রেমসংগীতের কথা বলা হলেও শেষপর্যন্ত প্রেম কাতর এই মধ্যবয়সী প্রুফ্রক কোনো মেয়েকেই শোনাতে পারেনি তার পছন্দ বা ভালোবাসার সংগীত।
কবিতার শুরুতেই প্রুফ্রক পাঠককে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন কাব্যিক ভ্রমণে। যদিও এই ভ্রমণ পথে-প্রান্তরে নয়, বরং আমন্ত্রকের অবচেতন মনোজগতে। আকর্ষণ হিসেবে তুলে এনেছেন সান্ধ্যকালীন আকাশের একটি অসাধারণ উদ্বোধনী চিত্রকল্প।

Let us go then, you and I,
When the evening is spread out against the sky
Like a patient etherized upon a table;

অপারেশনের টেবিলে অচেতন রোগী যেভাবে শুয়ে থাকে, ভ্রমণের শুরুতে সন্ধ্যাটাও সেভাবে শুয়ে আছে সারা আকাশজুড়ে। এমন উপমা ইংরেজি সাহিত্যে এর আগে কেউ দেখেনি কখনো। কমিক হ্যামলেটের মতো বিভক্ত দ্বিধাগ্রস্ত তথা মানসিকভাবে অস্থির এই পুরুষের অন্তর্জ্বালাকে উদ্ভাসন দিয়েছে পারিপার্শ্বিক পরিচিত্র। ভ্রমণ শুরু হয়েছে আধা নির্জন রাস্তা ধরে, যেখানে ঝিনুকের খোসা ছড়ানো নিম্নমানের রেস্তোরাঁ, কার্তিকের রাতের সেই প্যাঁচানো চিকন গলির জিজ্ঞাসু বদন’র দিকে চেয়ে এ ভ্রমণ। জানালার কাচে তখন হলুদ কুয়াশার পিঠ ঘষাঘষি। সন্ধ্যার কোণাকাঞ্চির মধ্যে হলুদ ধোঁয়ার জিহ্বা দিয়ে চাটাচাটি আর চিমনি থেকে বেরিয়ে আসা কালো ঝুলের নর্দমায় অবতরণ করে আয়াসে রাত্রি যাপন। এভাবে এগিয়ে চলেছে ভ্রমণের পথ।
অঢেল বিত্তের অধিকারী প্রুফ্রকের যাতায়াত ছিল নামীদামি হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও ক্লাবে, যেখানে দেখা হয়েছে অনেক সুন্দরী মার্জিত রুচির নারীদের সঙ্গে, মনেও ধরেছে কাউকে না কাউকে। সেরকম একটি আবহের বর্ণনা শুরু হচ্ছে—
“In the room the women come and go
Talking of Michelangelo.”

রং মাখা কারও ঠোঁট দেখে বুদ্ধদেবের ‘গান’ কবিতার মতো প্রুফ্রক একবারও বলতে পারেননি, ‘চারদিক ঠুকরিয়ে খাই দুটি ঠোঁট ফলের মতো’ কিংবা ‘শোনো ওই কইছে কথা হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয়/গড়িয়ে পায়ের নীচে বয়ে যায় অসীম সময়- মুখে মুখ রাখলে পড়ে।’
কিন্তু তিনি পারেন না বলতে। নিজের বয়স ও শারীরিক দৈন্য সম্পর্কে অতি সচেতনতার কারণে একজন শিক্ষিত ও ধনবান ব্যক্তি একটি হাস্যকর চরিত্রে রূপান্তরিত হয়েছে। তারপরও তার ব্যর্থতার বেদনায় পাঠকের মন কেঁদে ওঠে। তার মাথায় সদ্য গজিয়ে ওঠা টাকের সঙ্গে গলাবন্ধনী, আছে সাধারণ টাই পিন। এই অবস্থায় চুল পেছন দিক থেকে আঁচড়ালে তাকে ভালো দেখাবে কি না, মেয়েদের সামনে পিচ ফল খেতে গেলে পৃথিবী মুখ ফিরিয়ে নেবে কি না—এই সব সংশয় কাজ করে। নিজের কাছে নিজের এত প্রশ্ন থেকে বোঝা যায়, নিজ দেহের নান্দনিকতা সম্পর্কে তার আত্মবিশ্বাসের সূচক ক্রমশ নিম্নগামী হচ্ছে। একজন মেয়ের কাছে নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার বিষয়টি প্রশ্নবোধক হয়ে ওঠার কারণে প্রেয়সীর কাছে প্রেম নিবেদনের পর্বটি স্বপ্নেই যেন নির্বাসিত হচ্ছে। বলি বলি করে আর বলা হয়ে ওঠে না। মেয়েলি দেহের খুচরো অঙ্গ- প্রত্যঙ্গ সবই যেন তাকে তাড়া করে বেড়ায়। চোখ, ফর্সা নগ্ন বাহু, রাতের ফিকে আলোয় বাদামি চুল, পোশাকবাহিত সুবাস—সবই তো তার পছন্দের, তার চেনা। যেমন তার চেনা প্রতিদিনের সকাল, বিকেল, অপরাহ্ণ ও সন্ধ্যা।
পাঠক এখানে উপলব্ধি করতে পারছেন প্রুফকের লজ্জা কিংবা শালীনতাবোধের মাত্রা সম্পর্কে। তিনি মেয়েদের চোখ, চুল কিংবা নগ্ন বাহু ছাড়া আর কোনো প্রত্যঙ্গের কথা ভাবতেও পারছেন না। যদি পারতেন তাহলে দৃশ্যপট ভিন্নরকমও হতে পারত। ১৯৪২ সালে প্রকাশিত জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থের ‘শঙ্খমালা’ কবিতায় আমরা দেখি—

কান্তারের পথ ছেড়ে সন্ধ্যার আঁধারে
সে কে এক নারী এসে ডাকিল আমারে,
বলিল, তোমারে চাই:
বেতের ফলের মতো নীলাভ ব্যথিত তোমার দুই চোখ
খুঁজেছি নক্ষত্রে আমি- কুয়াশার পাখনায়-

সন্ধ্যার নদীর জলে নামে যে আলোক
জোনাকির দেহ হতে-খুঁজেছি তোমারে সেইখানে-
ধূসর পেঁচার মতো ডানা মেলে অঘ্রানের অন্ধকারে
ধানসিঁড়ি বেয়ে-বেয়ে
সোনার সিঁড়ির মতো ধানে আর ধানে
তোমারে খুঁজছি আমি নির্জন পেঁচার মতো প্রাণে।

… চোখে তার
যেন শত শতাব্দীর নীল অন্ধকার!
স্তন তার
করুণ শঙ্খের মতো- দুধে আর্দ্র-কবেকার শঙ্খিনীমালার!
এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর।

প্রুফ্রক হঠাৎ নিজেকে লাজারাস মনে করলেন, যে সেন্ট লাজারাসকে মৃত্যুর চার দিন পর যিশু আবার জীবন ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। প্রুফ্রক তখন ভাবেন আজ এক সাথে মেয়েটির সঙ্গে চা খাবেন; তারপর বলেই ফেললেন, ‘আমি লাজারাস, মৃতের দেশ থেকে ফিরে এসেছি। তোমাকে সব বলব।’ পরক্ষণে মনে হয়, তার কথা শুনে মেয়েটি বালিশে মাথা রেখে হয়তো বলবে, ‘আমি তো এভাবে ভাবিনি কখনো।’
তবে, এই অচেতন অবস্থায়ও নিজের অবস্থান সম্পর্কে তার নিজের মূল্যায়ন পাঠককে আরও বেশি সচেতন করে তোলে। তার ধারণা, নাটকে তিনি প্রিন্স হ্যামলেট চরিত্রে অভিনয় করছেন না। তার চরিত্রটি খুবই ছোটো। দু-একটি দৃশ্যে তার অভিনয়। ভাঁড়ের চরিত্রের মতো রাজার কানে কানে কিছু বলা। তারপর, হলভর্তি দর্শকের হাসির পাত্র হয়ে আনন্দ দান করা। অতঃপর, মঞ্চ থেকে চির বিদায়। ঠিক এখানেই পাঠকের কষ্ট। হ্যামলেট চরিত্রে অভিনয় করার সব যোগ্যতাই প্রুফ্রকের রয়েছে। হ্যামলেট চরিত্রে অভিনয় করে যিনি দর্শককে কাঁদাতে পারতেন, তিনি ভ্রমণ শেষ করলেন হাসির পাত্র হয়ে। এই যেন সেই হলুদ কুয়াশায় জড়ানো নোংরা জানালায় হেলান দিয়ে দাঁড়ানো ধোঁয়া ওঠা চিমনির মতো নিঃসঙ্গ এক সঙ্গকাতর মানুষ। পুরোনো ঢাকার ঘিঞ্জি গলির ভেতরের কোনো প্রাচীন হেলে পড়া দালানের ভেতর থেকে ভেসে আসা কষ্ট-কণ্ঠের ঝাপসা সংগীত। এ তো প্রেমসংগীত নয়। এ তো এক তামাশা মাত্র।
কবিতার শেষের দিকে দেখা যায়, সাদা পায়জামা পড়ে প্রুফ্রক সৈকতে হেঁটে বেড়াচ্ছেন, শুনতে পাচ্ছেন সমুদ্রের তলদেশে জলপরীরা সংগীত পরিবেশন করছে। ঢেউয়ের আগায় চড়ে তিনি তাদের সমুদ্রে নেচে বেড়াতে দেখেছেন। উল্টো দিক থেকে বাতাস যখন নাচতে নাচতে এগিয়ে আসে, জলপরিরা তখন সমুদ্রের সাদা চুল পেছন দিক থেকে আঁচড়িয়ে দেয়। শৈবালের চত্বর যেন তাদের বাগানবাড়ি। তার বিশ্বাস, তাকে দেখলে জলপরিরা গান শোনাবে না। চারপাশের জীবনের মতো তিনি তাদেরকেও চেনেন। কারণ, জীবনকে তিনি মেপেছেন কফির চামচ দিয়ে, একদিন নয়, বহুদিন, প্রতিদিন।
প্রয়াত অধ্যাপক খোন্দকার আশরাফ হোসেনের ভাষায়—
‘খাতিরজমা বয়া রইছি সমন্দরের বাসরঘরের মাইদ্দে
জলপরি মাইয়ারা গাইবার লইছে লীলাবালি লীলাবালি
আওর গলাত পরায়া দিতাছে ছৈবালের মালা
মাইনষের গলার আওয়াজ হুইন্যা টাস্কি ভাইঙা উঠি,
আওর আঁতকা ডুইব্যা যাই পানির আন্দরে।’
তার মানে প্রুফ্রক এতক্ষণ দিবাস্বপ্নে মগ্ন ছিলেন। পাঠককে যে ভ্রমণের আমন্ত্রণের কথা বলা হয়েছে কবিতার শুরুতে, সেই সংলাপটিও এই ব্যর্থ নায়কের একেবারেই অন্তর্গত। ‘বস্তুত, প্রুফ্রক আধুনিক মানুষ নামের এক হাস্যকর অথচ করুণ অস্তিত্বের প্রতিনিধি। কবিতাটির এবং বিশেষত এর নায়ক প্রুফ্রকের ছায়াপাত ঘটেছিল তিরিশের দশকের বাংলা কবিতায়; এমনকি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের হরিপদ কেরানির (‘বাঁশি’) মধ্যেও। প্রকৃত পক্ষে, প্রুফ্রক হচ্ছে অন্তঃসারশূন্য, দেউলিয়াত্বে পরিপূর্ণ তথাকথিত নগরজীবনের এক মনো-নরকের বাসিন্দা। দান্তের ‘ডিভাইন কমেডি’র ‘ইনফার্নো’ পর্বেও আমরা এই ধরনের একটি নরকের চিত্রের সন্ধান পেয়েছি।