চলতি পথের কিছু ঘটনা

১.
এক ভোরবেলায় শিকাগোর ফ্লাইটে, ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্টকে একটা কোম্পানি মাইনর (অপ্রাপ্ত বয়স্ক বাচ্চা) বুঝিয়ে দিয়ে কাগজে সই নিয়ে ফিরে আসছি। উড়োজাহাজের দরজার সামনে জটলা। একটা বাচ্চা পুশ চেয়ারে ঘুমিয়ে, বয়স্ক এক ভদ্রমহিলা তার পেটের কাছে বাঁধা বেল্ট খোলার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন, কিন্তু পারছেন না। পাশে দাঁড়ানো বাচ্চার গ্র্যান্ড পা বাচ্চাটাকে ডেকে ওঠাতে চেয়েছেন, সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রমহিলা মুখে ঝাপটা মারলেন, উঠলে সামলাবে কে? পাশে ৪/৫ বছরের আরেকটা ছেলে। জেট সেতুতে বাকি যাত্রীদের লাইন লেগে গেছে। আমি সাহায্য করার জন্য নিচু হয়ে বাটনটা খুলে দিলাম, কিন্তু বাচ্চা তাকিয়েই আমার শার্টের কলারে খপ করে ধরে ফেলেছে। কান্নার সুর করে আমার কোলে আসবে। মহিলা জোর করে ছাড়াতে চাচ্ছেন।
সময় মতো আমার গলার স্বর বদলে যায়, আমি তাকে কমান্ডিং স্টাইলে বললাম, ‘কাম ডাউন, লেট মি হ্যান্ডল’। উনি ছেড়ে দিলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে ভেতরে নিয়ে গেলাম। উনি আসনে বসলে বাচ্চাটিকে তাঁর কোলে দিয়ে আসলাম। ততক্ষণে সে আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। যাত্রীরা ভেতরে যাচ্ছেন। বেরিয়ে আসতেই এক ভদ্র মহিলা জিজ্ঞেস করলেন, is he your son?
আমি হাসি দিয়ে বললাম, ‘oh no no’ আর মনে মনে বললাম, ‘আহ এ রকম একটা ছেলে আমার থাকলে তো ভালোই ছিল।’ কী সুন্দর বাচ্চা! ফরসা টসটসা আপেলের মতো গাল, চুলগুলো সোনালি ফ্যাস ফ্যাসে মায়াবী। মনে হচ্ছিল আরও কিছুক্ষণ যদি থাকত!
ব্যাগেজ ক্লেমের কেউ চেয়ারটা তখনো নেয়নি। অনেকখানি জায়গা দখল করে আছে; যাত্রীদের চলতে সমস্যা হচ্ছে বলে আবারও এটা গুটিয়ে পাশে রাখার জন্য উদ্যত হলাম। কিন্তু কীভাবে গুটিয়ে রাখব বুঝতে পারছি না, এমন সময় লাইন থেকে এক ভদ্র মহিলা এসে সুন্দরভাবে চেয়ারটি গুটিয়ে দিলেন। চেনা হাতের কাজ। আমি বিস্মিত হয়ে বললাম,
-Are you with them?
-Yes
-Why you didn’t tell us before boarding, might be we can arranged together?
-I don’t wanna he see me. Thank you so much, I appreciate you.
বুঝলাম, পেছন থেকে ওই ভদ্রমহিলা সব লক্ষ্য করেছেন। কয়েক সেকেন্ডে কথা বলে তিনি ভেতরে চলে গেলেন। কিন্তু আমার ভেতরে দিয়ে গেলেন এক অক্ষম মায়ের কষ্টের স্পর্শ। ভদ্রমহিলা পুরোদস্তুর অফিশিয়াল গেট আপে। সিম্পল স্মার্ট স্কার্ট পরা, সুন্দর ব্লন্ড চুল। বগল দাবা করা হাত ব্যাগে অ্যাপলের ছোট একটা ল্যাপটপ, বুকে ধরা ফাইলের মতো দু-তিনটা অফিস ফোল্ডার। কিছু না বললেও বুঝলাম, উনি শিকাগোতে কোনো চাকরিতে বা সভায় যোগ দেবেন। মা-বাবার কাছে সন্তানদের এখান থেকে বুঝিয়ে দিয়েছেন, হয়তো অন্য কোথাও সংযুক্ত ফ্লাইট আছে। তাদের জিনিসপত্র এ রকম আভাসই দিচ্ছিল। ভেতরে-ভেতরে বাচ্চাটার জন্য খচখচ করছিল এক সূক্ষ্ম কষ্ট। আমিও মেয়েকে রেখে চাকরি করছি সব সময়, অবস্থার অক্ষমতা বুঝতে পারি। আমার সঙ্গে মহিলার তেমন কোনো মিল নেই, চুল কিছুটা। হতে পারে পারফিউমের গন্ধ যা তার মায়ের সঙ্গে মেলে, নতুবা কেন এমন আঁকড়ে ধরল?
এ দেশে দাদি বা নানিরা গুরুদায়িত্ব পালন করেন না—এমনটি হতে পারে না।

২.
ভোরবেলা মেয়েদের রূপসজ্জার রুমে ঢুকে বেশ বিব্রত হলাম। অনেক ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট এখানে এসে ইউনিফর্ম পরেন, আবার কেউ কেউ টয়লেটের ভেতরেও চলে যান। কিন্তু এই মেয়ে দেখি বুকের চেইন খুলে দিব্যি বসে আছে। তার সুউন্নত বুক চোখে পড়তেই আমি লজ্জিত হয়ে পরে বেসিনের আয়নায় চলে গেলাম। প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে বুঝলাম, সে একজন নবজাতকের মা। বুকের দুধ পাম্প করে দুটো পাইপের মাধ্যমে একটা পাত্রে জমা করছেন। একজন মা হিসেবে আমি জানি এর কষ্ট। সুতরাং ব্যাপারটা স্বাভাবিকভাবেই নিলাম। দুধ জমে মহিলাদের স্তনে মারাত্মক ধরনের ব্যথা থেকে শুরু করে বড় ধরনের অসুখ পর্যন্ত হয়। মায়ের শরীরের অনেক খারাপ জিনিস বের হয়ে যায় এ দুধের মাধ্যমে। বুকের দুধ বাচ্চাদের না পান করিয়ে যখন শুকিয়ে ফেলা হয়, ওষুধের মাধ্যমে তখনই ব্রেস্ট ক্যানসারের সম্ভাবনাকে ত্বরান্বিত করা হয়। বুকের দুধ যে শুধু নবজাতকের জন্য ভালো তা নয়, মায়ের জন্যও অনেক উপকারী। যাই হোক, এসব ভাবতে ভাবতে আমি ভেতরে আমার কাজে চলে গেলাম।
তারপর, দুপুর দুটো বাজার একটু আগে আমি যখন আবার এই রুমে এলাম, দেখি সেই মেয়ে একই স্টাইলে বসে আছে, আমি আমার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া গোপন না করে, হাসি দিয়ে বললাম, Hi, how are you? I saw you in the morning, still here, are you okay?
সে সুন্দর করে হাসি দিয়ে বলল, যে সে আবার এসেছে। তখন লক্ষ্য করলাম, দুধ সুন্দর একটা বক্সে জমা হচ্ছে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ফেলে দেবে কি না? বলল না? এ বক্সে দুধ ১২-১৫ ঘণ্টা ভালো থাকে। নিচে আইসবার আছে। ফিডারে নিয়ে বাচ্চাকে খাওয়াবে। দশ মাসের ছেলে বাসায়। তরুণীর মা তাকে দেখাশোনা করেন। এখন দেখুন, পশ্চিমা হলেও তিনি কি একজন মা না? তিনি চাইলেই শিশু সন্তানকে দুধ খাওয়া বন্ধ করিয়ে দিতে পারতেন, খাওয়াতে পারতেন টিনের দুধ। বাচ্চাকে দুধ পান করায় বলেই দুধ উৎপাদন হয়। যাই হোক, পরে জানলাম, এই তরুণী কোনো ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট নন, কোনো প্রশাসনিক কর্মকর্তা। ভেতরে অফিসে কাজ করেন। বিদায় নিয়ে চলে এলাম আর হারিয়ে গেলাম দেশের আরেক মায়ের কাছে।
আমি এক মাকে চিনতাম, যিনি সন্তানকে রেখে কাজ করতেন। কিন্তু পুরোদস্তুর বুকের দুধ পান করাতেন। তিনিও সকাল দশটা-এগারোটায় এভাবে দুধ নিয়ে একটা ফিডারে করে বাসায় পাঠাতেন। কাজের ছেলে এসে নিয়ে যেত। তিনি একদিন অফিসে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন অল্প বয়সী এক সহকর্মীর সঙ্গে। সে ছেলে হঠাৎ দেখে সাদা টাইলসের মেঝেতে কিছু একটা টপ টপ করে পড়ছে। সে সহজভাবেই জিজ্ঞেস করে, আপা কী পড়ছে এ সব? উনি বুঝতে পেরে সে দিন দ্রুত অফিস ছাড়েন। খাওয়ানো ছাড়াও এ জমে থাকা দুধ একজন মাকে যেমন কষ্ট দেয়, তেমন অনেক সময় জামাকাপড় পর্যন্ত নষ্ট হয়ে যায়। এমনকি মাঝেমধ্যে বিব্রত হতে হয়। কিন্তু সন্তানের জন্য একজন কর্মজীবী মায়ের অনেক বড় অবদান। নবজাতকের মা যখন খাওয়া-দাওয়া করেন, প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই দুধ তখন উৎপাদিত হয় বেশি । তাই যে মা বাচ্চাকে বুকের দুধ পান করান, তাকে ডায়েটিং বা ফিগার রক্ষার চিন্তা করলে হবে না। পশ্চিমা বা আমাদের বাংলাদেশি মায়ের মধ্যে কোনো তফাত নেই, মা তো মা-ই। এই দুই নবজাতকের মায়ের মধ্যে তো কোনো পার্থক্য নেই। একজন মায়ের ইচ্ছেটাই আসল। কাজ করেও সন্তানকে বুকের দুধ পান করানো যায়।
বিশাল এক পরিসরে কাজ করতে গিয়ে প্রতিদিন এ রকম হাজার হাজার মানুষ দেখি। কিন্তু সে তুলনায় তাদের শব্দ কম, চুপচাপ। তারপরও অনেক কিছু চোখে পড়ে। বিস্ময়ে কখনো থমকে যাই। কখনো চেষ্টা করি নিজেকে দিয়ে মানুষকে বোঝার। দূর থেকে আমরা অতি সহজেই মানুষকে বিচার করে ফেলি। আমি যদি আমেরিকায় না আসতাম, অনেক ভুল ধারণা নিয়ে যেমন বড় হয়েছি, তেমনটা হয়তো সারা জীবন থাকতাম। আমাদের বেশির ভাগ বইয়ে গল্পে লেখকেরা আমাদের দেশিদের লন্ডন-আমেরিকায় বিশাল কিছু একটা দেখিয়ে এসেছেন। আর বিদেশি মানেই খারাপ কিছু মানুষ। সত্য হলো আপেক্ষিকতা সব স্থানেই আছে। কোথাও কেউ ধ্রুব নয়। কাছ থেকে যখন মানুষগুলোকে দেখি, তখন মনে হয়—এরা বিদেশি হলেও এদেরও আমাদের মতো একটা মন আছে, এরাও ভালোবাসে গভীরভাবে, দীর্ঘ জীবন কাটিয়ে দেয় এক স্বামী বা স্ত্রীর সঙ্গে। এরাও মাকে যথাসম্ভব মাথায় তুলে রাখে। নাতি-নাতনিকে শুধু ভালোই বাসে না, লালন-পালনের দায়িত্বটুকুও মাথায় তুলে নেয়। তেমনি অনেক নাতনিও বলে, ‘I could handle my grandma।’