বিশ্বের প্রবীণতম নরসুন্দর

সেলুনে এক ব্যক্তির চুল কাটছেন প্রবীণতম নরসুন্দর অ্যান্তোনিও ম্যানসিনেলি
সেলুনে এক ব্যক্তির চুল কাটছেন প্রবীণতম নরসুন্দর অ্যান্তোনিও ম্যানসিনেলি

পৃথিবীর প্রবীণতম নরসুন্দর ইতালিতে জন্মগ্রহণকারী নিউইয়র্কার অ্যান্তোনিও ম্যানসিনেলি। তিনি টানা ৯৬ বছর ধরে নিউইয়র্কের নিউ উইন্ডসরে নরসুন্দরের কাজ করে যাচ্ছেন। ১০৭ বছর বয়সী ম্যানসিনেলির জন্ম ১৯১১ সালে ইতালির নেপলসে। মাত্র ৮ বছর বয়সে আমেরিকার নিউইয়র্কে অভিবাসী হওয়া পুরো পরিবারের একমাত্র জীবিত সদস্য তিনি। ১১ বছর বয়সে শুরু করেন জীবনসংগ্রাম। প্রথমে খণ্ডকালীন কাজ শুরু হয় স্থানীয় এক সেলুনে। পরে বিদ্যালয়ে পড়াশোনা না করে ১২ বছর বয়সে সার্বক্ষণিক নরসুন্দরের পেশায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন। তখন চুল কাটানোর জন্য মূল্য ধার্য ছিল মাত্র ২৫ সেন্ট। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড বুকে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রবীণ নরসুন্দর হিসেবে ইতিমধ্যে সর্বসম্মত স্বীকৃতি পেয়েছেন বলে ম্যানসিনেলি। ১৯২৩ সালে আমেরিকার ২৯তম প্রেসিডেন্ট ওয়ারেন জি. হার্ডিঙের হোয়াইট হাউসের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ম্যানসিনেলি ১২ বছর বয়সে চুল কাটার সরঞ্জাম হাতে নেন। আজ অবধি তা চালু আছে। এ এক বিস্ময়কর ঘটনা বটে। সেলুন মালিক জেনি ডিনজা জানান, খরিদ্দাররা সেলুনে এসে প্রবীণ একজন নরসুন্দরকে পেয়ে আনন্দ সহকারে তাদের কাজ সারেন। সঙ্গে সঙ্গে এই আবিষ্কারে বিস্মিত হন।
ম্যানসিনেলি চিকিৎসাশাস্ত্র পাঠ না করেও পুরোনো নরসুন্দরদের কাছ থেকে কিছু কিছু ঐতিহ্যবাহী শারীরিক সেবা ও শুশ্রূষা সংক্রান্ত জ্ঞান লাভ করেছেন। এ ধরনের বিশেষ সেবার মধ্যে ছিল শরীর থেকে আঁচিল তোলা, কাঁধে গরম কাচের গ্লাস থেরাপি ও ঘাড়ে জীবন্ত জোঁক বসিয়ে উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা করা। বিশেষ করে জীবন্ত জোঁক ঘাড়ে স্থাপন করে সহজে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সোভিয়েত রাশিয়াসহ পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশে আজও বেশ জনপ্রিয় চিকিৎসা। চুল কাটানোর জন্য ম্যানসিনেলি পুরোনো সনাতন পদ্ধতির কাঁচি-চিরুনি ব্যবহারের পক্ষে। তবে কখনো খরিদ্দারের অনুরোধে চুল কাটার বৈদ্যুতিক সরঞ্জামও ব্যবহার করেন।
দীর্ঘজীবী হওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো গোপন সূত্র নাই বলে জানান ম্যানসিনেলি। তাঁর মুখের দুপাটি দাঁত এখনো পুরোপুরি অক্ষত এবং কর্মক্ষম। জীবনে কখনো কাজে অথবা অন্য কোনো কারণে চশমার কোনো প্রয়োজন পড়েনি। চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার মূল কারণ হলো পরিচিতি মানুষের বারবার তাগাদা। শারীরিক কোনো ব্যথা-বেদনা কিংবা অন্য কোনো অস্বস্তিকর উপসর্গের উপস্থিতি একেবারে নেই বললেই চলে। একটি অনিশ্চিত সিরিজ সমাপ্তির সময়ের দিকে এগোতে গিয়ে দীর্ঘজীবন লাভের আসল রহস্য জানতে আরেক জিজ্ঞাসার জবাবে ম্যানসিনেলি বলেন, নিজের কাজ নিজে করা ও সীমিত খাদ্য গ্রহণ করি। জীবনে কখনো ধূমপান বা অতিরিক্ত মদ্যপান করেননি। দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার পেছনে এসবের যোগ সূত্র থাকতেও পারে। প্রায় শত বছরের কর্মজীবনে কখনো অসুস্থাজনিত কারণে ছুটি চাননি। তবে আরও একটি বিস্ময়কর বিষয় হলো, তাঁর পরিবারে এমন দীর্ঘজীবন লাভকারী সদস্য সংখ্যা খুবই কম। ম্যানসিনেলি বর্তমানে একা বসবাস করলেও নিজ সংসারের যাবতীয় গৃহস্থালি কাজকর্ম এমনকি বাজার করাসহ সব কাজ নিজেই করে যাচ্ছেন। সেলুনে কাজ চালিয়ে যাওয়ার আরও একটি কারণ হচ্ছে, ১৪ বছর আগে ৭০ বছর বয়সে প্রিয়তমা স্ত্রী কারমিলার মৃত্যু। এরপর থেকে নিজেকে সব সময় কাজেই ব্যস্ত রাখতে চান তিনি। নিউ উইন্ডসরে তাঁর কর্মক্ষেত্র সেলুনের পাশেই বসবাসকারী ম্যানসিনেলি প্রতিদিন কর্মস্থলে আসেন নিজেই গাড়ি চালিয়ে। টেলিভিশনের সবচেয়ে প্রিয় রেসলিং শো উপভোগ করতে করতে নিজের খাবার নিজেই প্রস্তুত করেন। এমনকি ১০৭ বছর বয়সে নিজ বাড়ির আঙিনা নিজ হাতে ঝাড়ু দিয়ে নিয়মিত আবর্জনামুক্ত রাখেন। এর চেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, সেলুনে খরিদ্দারদের কাটা চুল পরিষ্কার করতে কারও সাহায্য নিতে মোটেও পছন্দ করেন না।
৮১ বছর বয়সী আপন ছেলে বব ম্যানসিনেলি কথা প্রসঙ্গে জানালেন, নিজের চুল কাটার সরঞ্জাম আপন হাতে পরিষ্কার করা ছাড়াও নিজের চুল নিয়মিত নিজেই কেটে রাখেন। লন্ড্রি করা, নিজের বিল পরিশোধসহ যাবতীয় দৈনন্দিন কাজে প্রবীণ এই নরসুন্দর নিজেই করেন। এর মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করলেন, বয়স কখনো কোনো সিদ্ধান্তে বাধা হতে পারে না। কোনো কোনো ব্যক্তি নিরবচ্ছিন্নভাবে ৫০ বছর ধরে ম্যানসিনেলির কাছে চুল কাটাতে আসছেন। ম্যানসিনেলি বলেন, কোনো কোনো মানুষের চার পুরুষের চুল কাটছেন তিনি। এমনও আছে, কোনো কোনো ব্যক্তির প্রপৌত্ররা এখন তাঁর কাছে চুল কাটান। তাঁরাও এখন পূর্ণ বয়স্ক। মজার বিষয় হলো, তার চেয়ে কম বয়সী খরিদ্দারকে কখনো কখনো সেলুনের ভেতরে চলাফেরায় তাঁকেই সাহায্য করতে হয়।
৮০ বছর বয়সী জেন জুলিয়ান বলেন, আমি ম্যানসিনেলির পাশে এলে আরও কম বয়সী হয়ে যাই। প্রায় এক শ বছর নরসুন্দরের কাজ করতে গিয়ে কালের সাক্ষী হয়ে আছেন অ্যান্তোনি। তার এই কর্মকালে কত জাতের চুলে ডিজাইন দেখেছেন, তার কোনো হিসাব নেই। জিজ্ঞাসার জবাবে হাত ওপরে তুলে শুধু বললেন, অনেক অনেক দেখেছি।
নিউ উইন্ডসর শহরে বিশেষ শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার মানুষ ইতালিয়ান বংশোদ্ভূত অ্যান্তোনি ম্যানসিনেলি। শহরে অনুষ্ঠিত মেমোরিয়াল দিবসের প্যারেডে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে প্যারেড মার্শালের দায়িত্ব পালন করেন সবার প্রিয় ম্যানসিনেলি। ১৭৯৬ সালে স্থাপিত লোকাল আমেরিকান আর্মি লিজিয়ন অফিসের একজন সম্মানিত ও গর্বিত সদস্য হিসাবে তাকে একজন ভেটারেনের মর্যাদা দেওয়া হয়ে থাকে।
ম্যানসিনেলির প্রতি জন্মদিবসে শহরের সব সেলুন বন্ধ থাকে যাতে সবাই জন্মদিনের পার্টিতে অংশ নিতে পারে। সেই ঐতিহ্য চালু আছে অনেক বছর ধরে। সে পার্টি স্থানীয় টেলিভিশন চ্যানেল ছাড়াও নিউইয়র্কের প্রথম সারির টিভিতে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়ে থাকে।
দুনিয়ার নানা প্রান্ত থেকে অগণিত উৎসাহী দর্শনার্থী ভিড় জমান স্থানীয় এই সেলুনে যেখানে কর্মরত আছেন শতবর্ষী নরসুন্দর অ্যান্তোনি ম্যানসিনেলি। সেলুনের মালিক ডিনেজা তাঁকে কাজে নিয়েছিলেন শুনে, তিনি আগে যে সেলুনে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন, তারা তাঁর বয়স বিবেচনায় কার্যঘণ্টা কমিয়ে ফেলে, যা তাঁকে ব্যথিত করে। এমনকি বর্তমান কাজের জায়গায়ও সেলুনের অভ্যর্থনাকারী তাঁকে বয়সের কারণে বিদায় করে দিতে চেয়েছিলেন। অথচ বিস্ময়কর হলেও সত্য, আজ ১০৭ বছর বয়সে অ্যান্তোনি ম্যানসিনেলি সপ্তাহে পুরো ৪০ ঘণ্টা কাজ করতে সক্ষম।
নিউইয়র্কসহ আমেরিকার অনেক তারকা কখনো কখনো ছোট্ট এই শহরের সুন্দর পরিপাটি সেলুনে এসে ভিড় জমান অ্যান্তোনি ম্যানসিনেলিকে দেখতে। এই তালিকায় অভিনেতা বেন গাজারাসহ আরও অনেক তারকা রয়েছেন।
অভূতপূর্ব প্রাণশক্তি নিয়ে শান্ত ও নিরিবিলি জীবনযাপনকারী অ্যান্তোনির শেষ কথাটি ছিল, আমি আরও অনেক দিন বাঁচতে চাই। কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বললেন, এই বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা এ জন্য যে, প্রতিদিন যেন আমি আমার প্রিয়তমা স্ত্রী কারমেলার সমাধিতে একটি লাল টকটকে তাজা গোলাপ রেখে দিন শুরু করতে পারি।