গোলামুরের ডায়েরি

অলংকরণ: আরাফাত করিম
অলংকরণ: আরাফাত করিম

গত রাতে ইমতিকে কে বা কারা মেরেছে। আঘাত গুরুতর। তার আঘাত পাওয়া হাতের অবস্থা দেখে খুব দুঃখ পেলেন দাদাসাহেব। ডাক্তার আনতে লোক পাঠালেন। ইমতি বলল, ওষুধ খেয়েছে। দাদাসাহেব খুব বেশি জেরা করলেন না। ইমতি তেমন করে কিছুই বলতে পারত না তাঁকে। তবে দাদাসাহেব বেশ বিচক্ষণ। তাই কোনোমতে ওঁকে বুঝ দিয়ে এসে ইউসুফকে বলল ইমতি, কিরে, কী অবস্থা? কী খবর তোর?

ধড়ফড় করে উঠে বসল ইউসুফ। বলল, এলি? আমি তো চিন্তায় চিন্তায় শেষ!

কিসের এত চিন্তা?

রাতভর তোর খবর নেই...

কী আর খবর। জ্ঞান ফিরে দেখি সকাল হয়ে গেছে।

কী বলছিস?

আমরা মনে হয় আসল কাজের কাছেই চলে এসেছি।

তাই নাকি! হাতে কী হয়েছে?

জখম। হাতটা একটু সুস্থ হওয়ার সময় দিতে হবে।

ভালোই হলো তুই এসেছিস। এখন আমি চলে যাই। তোর জন্যই দেরি করছিলাম। তোর খবরটা না নিয়ে যেতে ইচ্ছা করছিল না।

একটি বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থার কর্মকর্তা ইমতি দাদাসাহেবের বাড়িতে এসেছে বেশ কয়েক দিন, আর ইউসুফ গতকাল। গত রাতে মর্জিয়াজান সম্পর্কে জানতে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছে তারা। ইউসুফ পালিয়ে আসতে পেরেছে। ইমতি পড়েছিল তোপের মুখে।

চলে যাবি?

হ্যাঁ। বাসায় চিন্তা করবে।

ইমতি একটা চেয়ারে বসতে বসতে বলল, আচ্ছা ইউসুফ, বল তো কে আমাদের ওপর হামলা করল? তোর মাথায় কি কিছু আসছে?

হুম, আসছে। এখানে আসার পর কেউ না কেউ তোর ওপর নজর রাখছে। তুই কী কাজে এসেছিস, তা নিশ্চয়ই ওরাও অনুমান করতে পেরেছে। তাই ভয় দেখিয়ে তোকে এখান থেকে ভাগাতে চায়। আর ওই কাজটা নিশ্চয়ই সে-ও উদ্ধার করতে চায়। না হয় হামলা হবে কেন?

হুম, সেটা আমি জানি। দাদাসাহেবের ভাইয়ের ছেলে জাহিদের দিকে চোখ রাখতে হবে। আর সুযোগ বুঝে ওর মারটা ফেরত দিতে হবে, তাই না?

দেখিস, নতুন কোনো ঝামেলায় যাস না। ভালো থাকিস।

ইউসুফ বেরিয়ে গেল। শুয়ে পড়ল ইমতি। হাতের ব্যথাটা টনটন করে উঠল। ডান হাতের বাহুতে ক্ষত।

দুই.

ইমতি বা ইমতিয়াজ ভেবেছিল ঘুমের ঘোরে হাতে বুঝি টান লেগেছে। কিন্তু না, দেখল একটা লোক ঝুঁকে পড়ে হাতের ক্ষত ধুচ্ছে। ধুয়ে ওষুধ লাগিয়ে ভালো করে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল। তারপর খসখস করে লিখল ব্যবস্থাপত্র এবং সেটা দাদাসাহেবের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বেরও হয়ে গেল ঘর থেকে।

একটু দূরে দাঁড়ানো ঘোমটাওয়ালীর চোখটা সরে গেল বিদ্যুৎ–গতিতে। গুলের মুখে কোনো হিজাব নেই। শুধু বড় একটা ঘোমটা দিয়ে মুখ আড়াল করে রেখেছে সে। তবু মাঝেমধ্যে তার রূপের যে ছিটেফোঁটা ইমতির চোখে এসে লেগেছে, তা অতুলনীয়। তার মনে হয়েছে, এ নিশ্চয় রাজা-বাদশাহদের অন্দরমহলের হুরপরি। তবে গুল চরিত্রটা ইমতির কাছে রহস্যজনক। কিছুতেই বাসার গৃহকর্মী হিসেবে ওকে মানায় না।

দুপুরের দিকে তার খাবারদাবার দিয়ে গেল। ডান হাতটা নাড়াতে পারছে না। তাই কী করে খাবে, বুঝতে পারল না সে। তবে গুলের বুদ্ধি আছে। প্লেটে একটা টেবিল চামচ দিয়ে রেখেছে। এর মধ্যে গুল বলে উঠল পেছন থেকে, আর কিছু লাগবে কি?

লাগবে না। ইমতির নিজের কাছেই তার গলাটা বেশ কর্কশ শোনাল।

বাম হাতে খেল। শরীরে কাঁপুনি দিচ্ছে। জ্বর আসছে। গুল এসে ওষুধ আর পানি দিয়ে গেল। সারা গায়ে অনাহূত ব্যথাটা ছড়িয়ে আছে। বিকেলের দিকে আরও বেড়ে গেল জ্বর। ইমতির শরীর রীতিমতো কাঁপছে।

খানিক বাদে এঁটো বাসনকোসন নিতে এল গুল। একটা শীতল ঠান্ডা হাত ইমতির কপাল স্পর্শ করল। শরীরের ওপর কাঁথা ছড়িয়ে দিল। কপালে ভেজা কাপড়ের জলপট্টি কেমন একটা ঝাঁকুনি দিল ইমতির শরীরে। আস্তে আস্তে কি শরীরের তাপ কমে আসছে! চোখজুড়ে রাজ্যের ঘুম। এক ফাঁকে কে যেন তার নাম ধরে ডাকল। আসলেই ডাকল কি?

রাতের দিকে ঘুম ছুটে গেল ইমতির। শরীরের ভেতরে তাপ আছে। মাথা টনটন করছে। তার এই এক সমস্যা, জ্বরজারি হলে মাথাটা ধরে আসে। গিন্নিকে নিয়ে দাদাসাহেব দেখে গেলেন তাকে। এরপর দীর্ঘক্ষণ জেগে থাকা। রাতের খাবার খেয়ে ওষুধ খেল। গড়িয়ে পড়ল বিছানায়। গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে আর সময় লাগল না।

ঘুমের ঘোরে নাচের শব্দ হয়, নূপুর বাজে...আরও কত কী! কিন্তু কে এই নাচনেওয়ালী? এমন সুন্দর মুখাবয়ব ইমতির দেখা কারও সঙ্গেই মেলে না। পাকা গমের মতো গায়ের রং। লম্বা চুলের বন্যা। দাঁতগুলো ছোট ছোট। হাত-পা শরীরের গড়ন আলাদা। এ তবে কি মর্জিয়াজানের পূর্বসূরি? যথার্থ রক্তের প্রতিদান?

যেসব গুণ গুলের পরনানির মধ্যে ছিল, সে–ও হয়তো সেসব রপ্ত করেছে। ভেতরে ভেতরে নিজেকে গুটিয়ে রাখে গুল। শরীর খারাপ হলেও গুলের চিন্তায় মনটা অস্থির হয়ে উঠল ইমতির। মাথার ভেতরে গুল ছাড়া আর কিছুই নেই। কল্পনায় সে দেখতে পেল, গুল নাচছে। তার দেহাবয়ব সাপের মতো এঁকেবেঁকে ছড়িয়ে দিচ্ছে একেকটা নাচের মুদ্রা। বহু দূর থেকে ভেসে আসছে নূপুরের শব্দ। যেন আবার মনে হচ্ছে, কাছে-ধারেই নাচছে কেউ। উঠে যেতে পারছে না ইমতি। ঘুমের ঘোরে কী শুনতে কী শুনেছে, কে জানে! চোখটাও মেলতে পারছে না। আবার কি গায়ে জ্বর এল? তবে জ্বর উঠলেও চেতনা হারায়নি সে। স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে লাইব্রেরি রুমের ভেতর থেকে একটা আওয়াজ আসছে। বালিশে কান লাগালে বেড়ে যাচ্ছে শব্দটা।

সবটা ইচ্ছা এক করে উঠে দাঁড়াল ইমতি। তাকে দেখতে হবে লাইব্রেরি রুমের ভেতর কে নাচছে; নাকি এটা তার মনের ভুল? অদ্ভুত একটা ঘোরের ভেতরে সে। লাইব্রেরির দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। ছনছন আওয়াজ এল মনে হয়। আবার বন্ধও হয়ে যাচ্ছে। কেমন জানি একটা অদ্ভুতুড়ে কাণ্ড। দরজায় কান পাতল ইমতি। হ্যাঁ, এবার বেশ শুনতে পাচ্ছে। মিষ্টি শব্দটা জাদুমন্ত্রের মতো টেনে রেখেছে তাকে। হঠাৎ কী হলো, চক্কর দিয়ে উঠল মাথাটা। ধপাস করে একটা শব্দ হলো। তারপর কিছু মনে নেই আর।

শব্দটা ওপাশে ঠিকই পৌঁছাল। দরজা খুলে বের হলো এক নারী। তার গায়ে নাচের পোশাক। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। মুহূর্তেই সে বুঝে গেল কী ঘটেছে। ইমতির শরীরটাকে আগলে নিয়ে শুইয়ে দিল খাটে। এরপর বেরিয়ে গেল। কিছুক্ষণ বাদে আবার যখন এল, তখন আর সে নাচের পোশাকে নেই। সাধারণ একটা সেলোয়ার–কামিজ পরেছে। ওড়নাটা যথারীতি মাথায় টেনে দেওয়া। বারবার একটা পাত্র থেকে ভিজিয়ে ইমতির মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে সে।

বেশ পরে জ্ঞান ফিরল ইমতির। তবে চোখ খুলতেই নির্ঘুম দুটো চোখ তার দৃষ্টি কাড়ল। একটু সময় নিয়ে ভাবল সে, আসলে কী হয়েছিল? যখন মনে পড়ল, সেই সময় হঠাৎ নিজেই কথা বলে উঠল গুল।

আপনি দরজার পাশে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। এত রাতে বুঝি বই পড়তে লাইব্রেরিতে যাচ্ছিলেন?

ইমতি ধরা পড়া গলায় বলল, না।

ওড়নার আড়ালে মুখ টিপে হাসল গুল। অদ্ভুত হাসি। এমন হাসি সে কখনো দেখেনি।

তবে কেন গিয়েছিলেন?

নূপুরের শব্দে ঘুম আসছিল না। দেখতে গিয়েছিলাম।

দেখেছেন?

কী?

নূপুর।

না। তার আগেই জ্বরের ঘোরে মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল।

দুর্বল শরীরে হঠাৎ নাচ দেখার সাধ হলো কেন?

সবল হলে যদি খুঁজে না পাই।

তাই লোভ সামলাতে পারলেন না বুঝি?

লোভ নয়, কৌতূহল।

তো কৌতূহল মিটেছে?

মিটল কোথায়! তার আগেই বিধি বাম। পোড়া চোখে এত সুখ সইল না।

ইমতি একটা জলতরঙ্গের শব্দ পেল মনে হয়! গুল হাসছে। কী মিষ্টি ওই হাসির সুর! থেমে গেল কেন! তার আফসোস হচ্ছিল হাসির জন্য। তাই মনে হয় আফসোসসূচক একটা শব্দ করেই ফেলেছিল। সেটা বুঝেই হয়তো প্রশ্ন করে বসল গুল, কী ব্যাপার, আফসোস কেন?

নাচ দেখতে পেলাম না বলে!

সুস্থ হোন। তারপর দেখতে পাবেন।

কথা দিচ্ছেন তো!

কথা বলতে বলতে ইমতি চোখ বন্ধ করে কী যেন ভাবছে।

তাড়াতাড়ি সুস্থ হোন। যে কাজে এসেছেন, তা তো আপনাকে সম্পন্ন করতে হবে, তাই না?

তা ঠিক। আচ্ছা, পুরো ঘটনা তো বলা হয়নি আপনাকে। ঘটনাটা সম্ভবত আপনার জানাই। দাদাসাহেবের নাতি জিয়াদ। দশ বছর বয়স। ওকে সুস্থ করতে অনেক টাকা প্রয়োজন। খুব তাড়াতাড়ি ওর জীবনপ্রদীপ নিভে আসছে। দ্রুত চিকিৎসা দিতে পারলে ছেলেটা হয়তো বেঁচে যাবে।

আমি জানি।

ইমতি এবার খুব সাবলীলভাবেই বলল, আর কিছু জানেন নাকি?

না। আর কি জানব? কেমন যেন ধাতব কণ্ঠে বলে গেল গুল।

এক মুহূর্ত ইমতি ভাবল কিছু একটা।

দাদাসাহেবের দাদার ধনরত্নের হদিস করতে এখানে এসেছে ইমতি। এত দিনে সে একটা সূত্র আবিষ্কার করে ফেলেছে। দাদাসাহেবের দাদার দিনপঞ্জিতে আঁকা একটা নকশা তাকে গুপ্তধনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এই মুহূর্তে তা গোপনই থাকুক। তবে এ কদিনে গুলের প্রতি কেন যেন একটা মোহ তৈরি হয়ে তার। মেয়েটা জ্ঞান-গরিমায় অনেক এগিয়ে। সে তার নানির কাছে যথেষ্ট তালিম নিয়েছে। লেখাপড়াও জানে। অনায়াসে বাংলা-ইংরেজি পড়তে ও বুঝতে পারে। নাচতে জানে। আর কী কী জানে, কে জানে! তবে সেলাই জানে। বাড়িতে গ্রামের বউ-ঝিদের কাপড় তৈরি করে। নানা বর্ণের, নানা ডিজাইনের। এতেই নানি আর নাতনির চলে যায়। সকাল-বিকেল দাদাসাহেবের দেখাশোনা করে। দাদাসাহেবের ছেলে শহরবাসী। কাজেই বাড়িতে বুড়োবুড়ি ছাড়া কেউ নেই। গুল আর গুলের নানিও প্রায় দাদাসাহেবের এখানে রাত কাটায়। একেবারে চলে আসতে অনেক সাধাসাধি করেছেন দাদাসাহেব। কিন্তু মর্জিয়াজানের ভিটে ছাড়তে রাজি হয়নি ওরা।

সে রাতে পড়তে পড়তে টেবিলের ওপরই ঘুমিয়ে পড়েছিল ইমতি। হঠাৎ নাকের কাছে কী একটা ঘ্রাণ পেল। চোখ না খুলেই শব্দ পেল। ঘাগরার খসখসে আওয়াজ আর নূপুরের রিনিঝিনি। তার চোখ থেকে ঘুমের লেশটুকু উবে গেল একমুহূর্তে। মাথার চুলগুলো পরিপাটি হয়ে গেল নরম হাতের ছোঁয়ায়। না কামানো কয়েক দিনের খসখসে দাঁড়িতে নরম হাতের ছোঁয়া বুলিয়ে দিল। তার চারপাশে গজগামিনী ঘুরছে। ঘুমের ভান ধরে থাকায় নিজেকে চোর চোর মনে হলো ইমতির।

গুল পায়চারি করতে করতে বলেই বসল, কী জেগে জেগে ঘুমাবেন নাকি?

লজ্জা পেল ইমতি। ভান করল যেন এই মুহূর্তেই জেগে উঠেছে। টেবিল সরিয়ে তাকে মেঝেতে আসন পেতে দিল গুল। গুল নাচের প্রস্তুতি নিচ্ছে। হালকা একটা সুর ছেড়ে দিল। তার নাচের অদ্ভুত মুদ্রা ছায়াছবির মতো ভাসতে লাগল চারপাশে। একটা শরীর যেন হাওয়ায় ভাসছে। অথচ মেঝেতে কোনো শব্দ হচ্ছে না। আহা, ও কি মোমের পুতুল!

সে কি জেগে আছে? ইমতির মনে হলো, ঘুমের ভেতর স্বপ্ন দেখছে সে। এত সুন্দর নাচে গুল!

গুলের পরনানি এ দেশে এসেছিলেন মুর্শিদাবাদ থেকে। নানির কাছ থেকে পাওয়া নাচের মুদ্রা অন্তরে লালন করে আসছে তার পরের প্রজন্ম, গুলও। ওই নাচের মুদ্রাই এখন পরিবেশন করছে গুল। হয়তো রক্তের ধারাই মেয়েটাকে পাল্টে দিয়েছে—এক রক্ত থেকে আরেক রক্তে বাহিত; শিল্প প্রসারিত হয়েছে উত্তরাধিকারীর সূত্রে।

তিন.

যতই দেখছে ততই অবাক হচ্ছে ইমতি। নিজেকে মেটুয়াবুরুজের নবাব বলে মনে হচ্ছে তার। গুল অপরূপ নৃত্যপটীয়সী। ওর নৃত্যের হিল্লোলে বিকশিত হয়েছে দেহের অপূর্ব যৌবন। রাতের নির্জনতায় এক অচেনা খুশবু ইমতিকে কেমন বিহ্বলতাড়িত করে তুলল। অনেক কিছুই কল্পনা করতে লাগল সে। ওর মাথায় গুনগুন করে উঠল প্রণয়ের মৌমাছি: ‘যখন নিদ আসে, তুমি আসো/ যখন চোখ খোঁজে, তুমি আড়ালে হাসো।’

ইমতির হাতে হাত রেখে গুল অতীতের গল্প বলছে যেন। সে গল্পে আছে তার পরনানি কীভাবে সৈয়দ গোলামুর রশীদের সঙ্গে এখানে এলেন। গোলামুর রশীদের বজরা মুর্শিদাবাদে প্রায় যেত। সেবারও ভিড়েছিল। লক্ষ্ণৌ থেকে বিতাড়িত মর্জিয়াজানদের অবস্থাও তখন অতটা ভালো ছিল না। তো এক রাতের জলসায় তাঁর পরিচয় ঘটল গোলামুর রশীদের সঙ্গে। তাঁর কথাবার্তা আর ব্যক্তিত্বে বেশ মুগ্ধ হলেন মর্জিয়াজান। ভাবলেন, এমন পুরুষের কাছে আর যা-ই হোক, আশ্রয় ও খাবারের কমতি হবে না। এমনিতেই তখন তাঁদের বাইজিদের খুব খারাপ অবস্থা। কোনো দিকেই কোনো আশার খবর নেই। যে যেদিকে পারছে, ছুটছে। একটু আশ্রয়ের জন্য হা-পিত্যেশ করছে সবাই। আশ্রয় পেলে সমঝদার এমনিতেই জুটবে। তবে গোলামুর রশীদের চোখে একটু মানবিকতাবোধ আর ভালোবাসার রঙের ছটাও দেখতে পেয়েছিলেন মর্জিয়াজান। আর গোলামুর রশীদও ডুবে গিয়েছিলেন মর্জিয়াজানের চোখে। দুজন দুজনার হতে সময় লাগল না। গোলামুর রশীদ তাঁকে সঙ্গে নেওয়ার প্রস্তাব করলেন। মর্জিয়াজানের না–রাজি হওয়ার কোনো কারণ ছিল না।

সেই যে মর্জিয়াজান নামের এক বাইজি মুর্শিদাবাদ ছাড়লেন, আর ওমুখো হননি। ভরা বর্ষা তখন। চারদিকে থই থই পানি। রাতের অন্ধকারে গোলামুর রশীদের বজরা এসে ভিড়ল আমবাগানের বাড়িতে। মর্জিয়াজানের কথা কেউ জানল না কয়েকজন ছাড়া। দিনের রোদ তাঁর শরীরে লাগল না।

কোনো কিছুরই অভাব নেই মর্জিয়াজানের। চাওয়ার আগেই গোলামুর রশীদ সবকিছু হাজির করতেন। মাসান্তে একবার জলসা বসত আমাবাগানের বাড়িতে। দর্শক কিংবা সমঝদার বলতে একজনই। বিশাল আমাবাগানের বাড়ির সীমানা ছাড়িয়ে মর্জিয়াজানের নূপুরের শব্দ বাইরে কোথাও যায়নি কখনো। অথবা গেলেও কেউ জানতে চায়নি মর্জিয়াজানের কথা। এর পেছনে কারণ ছিল ভয়—গোলামুর রশীদের দাপটের ভয়। দশ গ্রামের মানুষ মান্য করত গোলামুর রশীদকে। তাঁর হাঁকডাকে বাঘে-মহিষে একঘাটে পানি খেত। তাই কেউ যদি মর্জিয়াজানের কথা শুনেও ফেলে, তবু তা গোলামুর রশীদকে বলার সাহস পায়নি। এই মর্জিয়াজানের ঘরেই এক মেয়ে হয়েছিল, যার নাম লামিয়াজান। সেই লামিয়াজানের পিতা কে ছিল?

সবাই বলত, লামিয়াজানের পিতা গোলামুর রশীদ। কেননা, গোলামুর রশীদ তাঁকে কন্যাস্নেহে মানুষ করেছেন। শুধু তা–ই নয়, মর্জিয়াজানের সঙ্গে দ্বিতীয় কারও সম্পর্ক হয়নি। আর কোনো পুরুষের সংস্পর্শ পায়নি মুর্শিদাবাদ থেকে আসা মর্জিয়াজান। গোলামুর রশীদেরই বাঁধা মেয়েমানুষ ছিলেন তিনি।

গোলামুর রশীদের আগেই মারা গেছেন মর্জিয়াজান। এই বাইজির কবরের ব্যাপারটি বেশ রহস্যাবৃত করে রেখেছিলেন গোলামুর রশীদ। সোনাদানাভর্তি হাঁড়ি-কলস দিয়ে কবর দিয়েছিলেন প্রেয়সী মর্জিয়াজানকে। সেই কথা মৃত্যুর আগে গোলামুর রশীদ বলে গেছেন কেবল একজনকে। গোলামুর রশীদের ধারণা ছিল, একদিন তাঁর বংশধরদের সহায়-সম্পত্তি কমে যাবে। তখন কারও না কারও দারুণ উপকারে আসবে এই সোনাদানা। নিজের ডায়েরিতে তাই তিনি গোপন নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। সেই ডায়েরির সন্ধানই পেয়েছে ইমতি।

চার

রাতের শেষ প্রহর। ঘুম এসে আবার ফিরেও গেছে, আর ঘুম হবে না। নাচ শেষে ফিরে গেছে গুলবদন। থেকে থেকে বাতাসে তার খুশবু আসছে। কিন্তু ইমতির হাতে সময় নেই। কেন যেন তার মনে হচ্ছে, গোলামুর রশীদের ডায়েরির আসল রহস্য এখন সে পুরোপুরি জানতে পেরেছে। এই জানার পেছনে গুলবদনের অবদান আছে কি? গুলবদন তাকে জাদু করেছে। কী অপরূপ চোখ। চোখে এমন কাজল দিঘি সে আর কখনো দেখেনি। সে কি বেশি কিছু ভেবে ফেলল? চারপাশটা ভালো করে দেখে নিল ইমতি। আরেকটু পরই ভোরের আজান হবে। ডায়েরিটা বের করল সে। কালো চামড়ায় মোড়ানো। এই ডায়েরির আসল রহস্য আসলেই কি জানতে পেরেছে ইমতি? গুলবদন মর্জিয়াজানের কবরটা চেনে। আদতেই কি চেনে? না চিনলেও তো ক্ষতি নেই। গোলামুরের ডায়েরিই তাকে শেষ সন্ধান দেবে।

ডায়েরির পাতা ওল্টাতেই বের হলো নকশাটা—তিনটে আমের ত্রিভুজ। একটা কবর। পায়ের কদম। একটা বাড়ি। অনেকগুলো নূপুর। এই নূপুরই ছিল মর্জিয়াজানের জীবন। আর এটাকেই গোলামুর রশীদ সাহেব এঁকেছেন এমনভাবে।

অনেকক্ষণ পর স্বস্তির একটা নিশ্বাস নিল ইমতি। পাতলা একটা কাগজে কী যেন আঁকল। সাবধানের মার নেই। কাগজটা ভাঁজ করে ঢুকিয়ে রাখল পকেটে। এখন আবার চোখ ভেঙে আসছে ঘুমে। কালই সে খুঁজে বের করবে মর্জিয়াজানের কবর। তারপর যথাস্থান থেকে উদ্ধার করবে গুপ্তধনগুলো। খুশিতে চোখ দুটো নির্ভার হয়ে এল তার। পিঠটা একটু বিছনায় লাগানোর লোভ আর সামলাতে পারল না। শুয়ে পড়ল শরীর টান করে। চোখ বন্ধ করে ভাবল, একটু পরই উঠে যাবে।

পাঁচ

ঘুম ভাঙল। তবে গুলের নয়, দাদাসাহেবের ডাকে। ঘুম ভাঙা চোখে বিস্তর বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল ইমতি। লাফ দিয়ে এল টেবিলে কাছে। ডায়েরির পাতা এলোমেলো, বিধ্বস্ত। মর্জিয়াজানের কবরের নকশা আঁকা সেই পাতা নেই। শুধু ওই পাতাটাই ছেঁড়া। যা ভেবেছিল তা–ই। ইমতি দাদাসাহেবকে নিয়ে গুলের বাড়িতে এল। কেউ নেই, শূন্য বাড়ি। আশপাশেই আছে কবরটা। খুঁজে বের করতে হবে। পকেট থেকে মানিব্যাগটা বের করল ইমতি। ব্যাগের গোপন কুঠরিতে থাকা পাতলা কাগজটা দেখে নিল, যেখানে সে গোলামুরের ডায়েরি থেকে এঁকে রেখেছিল আসল নকশাটা। আর ডায়েরিতে থাকা যে নকশাটা গুল নিয়ে গেছে, বুদ্ধি করে তাতে কারিকুরি করে রেখেছিল ইমতি। ওর কাছে আসল নকশা আছে ভেবে জাহিদ গুলকে অপহরণ করতে পারে। হয়তো গুলের নানিকে সে আগেই তুলে নিয়ে গেছে। যেদিন রাতে সে আক্রান্ত হলো, সেদিনই ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিল ইমতি। তবু মেয়েটার জন্য এখন তার কষ্টই হলো। জাহিদ ওকে কোথায় নিয়ে গেছে, কে জানে! না জানি কী বিপদ হয়েছে মেয়েটার!