কলমি লতা

‘ভুল সবই ভুল
এ জীবনের পাতায় পাতায়
যা লেখা …’

শুক্রবার। সাপ্তাহিক ছুটির দিন। বাথরুম থেকে গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে বেরিয়ে এলেন কাসেম সাহেব। জায়া-পতি ও একটি মাত্র মেয়ে নিয়ে ছোট্ট সংসার কাসেম সাহেবের। মেয়ে লেখা একটি প্রাইভেট ব্যাংকের সেকেন্ড অফিসার । কিছুদিন হলো সে নিজ পছন্দে বিয়ে করেছে তারই এক সহকর্মীকে। এখন ঘরে-বাইরে শুধু দুই বুড়ো বুড়ি। স্ত্রী সালেহা বেগম সকালের নাশতা তৈরি করতে রান্নাঘরে ঢুকেছে। কাসেম সাহেবের গুনগুনানি শুনে তিনি সাড়া দিলেন, ও লেখার বাবা তুমি উঠেছ?
ঘুমের আলসেমি তখনো কাটেনি কাসেম সাহেবের। সেই অবস্থায় জবাব দিলেন, হ্যাঁ এই মাত্র।
কাল যে বললে ছুটির দিনে একটু বেশি ঘুমাবে?
‘না, তা আর হলো কই? অভ্যাস হয়ে গেছে। যে দিন অফিস না থাকে, ওই দিনও ঘুম ভেঙে যায় আর্লি। আবার অফিসের দিন একদম ভাঙতে চায় না।’ আসল ঘটনাটা যে তা নয়, তার আর স্ত্রীকে বুঝতে দিলেন না। সেদিনের ওই ঘটনার পর থেকে তার ঘুমেরও কেমন ব্যাঘাত ঘটছে।
এই নিয়ে দশ দিনের মধ্যে দুবার ঘটল একই ভুল। ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে মনে হলো ভেতরে এমন কিছু আছে, যেটা থাকার কথা নয়। শুধু তাই নয়, এবারের ভুলটা যেন একটু বেশি। প্রথমে মনে হয়েছিল জিনিসটা ঠান্ডা। আজ মনে হলো ঠান্ডার সঙ্গে শক্তও। সাধারণ শক্ত নয়, লোহা-লক্কড় যেমন শক্ত হয়, সে রকম শক্ত। বাজারের ব্যাগে লোহা-লক্কড় আসবে কোথা থেকে?
প্রথমবারের মতো ঝট করে হাত সরিয়ে নিলেন আবুল কাসেম। তার ভ্রু কুঁচকে গেল। তিনি আগামী মার্চে পঞ্চাশের কোঠায় পা রাখবেন। এই বয়সে একই ভুল প্রতিনিয়ত হতে থাকলে দুশ্চিন্তায় ভ্রু কুঁচকে যাওয়াটা স্বাভাবিক। আজ বাজারের ব্যাগে ভুল, কাল ভুল হবে অফিসের কাজে, পরশু আরেক দিকে। প্রাইভেট কোম্পানির কেরানি সাহেব। ছোট পদের চাকরি। সামান্য ভুল হলে বড় রকমের বিপদ হতে পারে। তার ওপর অফিসের অবস্থা ভালো নয়, নড়বড় করছে। গত এক বছর ধরে অর্ডার কমছে; ম্যানেজমেন্টও খরচ কমাচ্ছে। রোজার ঈদে বোনাস দিয়েছে অর্ধেক, কোরবানির সময় দেবে কিনা সন্দেহ। কিছুদিন আগেও অসুখ-বিসুখ, মেয়ের বিয়ে, ফ্ল্যাটের জন্য লোন চাইলে পাওয়া যেত। এখন হাজারটা ফ্যাকড়া তুলে আটকাচ্ছে। চাকরিতেও হাত পড়েছে কারও কারও। ইতিমধ্যে দুজন পিয়নকে ছাঁটাই করেছে।
কানাঘুষা শোনা যাচ্ছে এবার কেরানি-অফিসারদের পালা। কঠিন পরিস্থিতি। সবাই কাঁটা হয়ে আছে। এই অবস্থায় সামান্য ভুল মানে সর্বনাশ। এ বয়সে চাকরি হারালে ভিক্ষা করা ছাড়া আর কোনো গতি থাকবে না।
ভ্রু কোঁচকানো অবস্থাতেই কাসেম সাহেব ব্যাগের দিকে তাকালেন। না, কোন গোলমাল নেই। প্রতি দিনের মতো রান্নাঘরের দরজা ঠেলে নিঃসংকোচে ঢুকে পড়লেন। এরই মধ্যে স্ত্রী সালেহা বেগম দাঁত কটমট করতে করতে এসে জিজ্ঞেস করলেন বাজার থেকে যা যা আনতে বলেছিলাম সব এনেছ?
হ্যাঁ-এনেছি।
ঠিক আছে যাও। বাথরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে এসো। তোমার জন্য চা নিয়ে আসছি। আর শোনো, কাল থেকে আর লুঙ্গি পরে ব্যাগ ঝুলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাজারে যাবে না। এ যুগে কেউ লুঙ্গি পরে বাড়ির বাইরে যায় নাকি?
কাসেম সাহেব প্রতিদিনই তো লুঙ্গি পরে ব্যাগ হাতে বাজরে যান। আজ হঠাৎ স্ত্রীর এমন আচরণে অবাক হয়ে বললেন, কেন যাবে না। অনেকই তো যায়। এ তো আমাদের বাঙালি কালচার।
সালেহা বেগম চাপা ধমক দিয়ে বললেন, যে যায় যাক; তুমি যাবে না। টোকাইয়ের মতো লাগে। কাল থেকে তুমি লুঙ্গি পরে ব্যাগ ঝোলাতে-ঝোলাতে হেঁটে বাজারে যাবে না। যাবে রিকশায়।
কাসেম সাহেবের মনে হলো স্ত্রীকেও পাল্টা একটা ধমক দেওয়া উচিত। বলা দরকার, না, আমি লুঙ্গি পরেই যাব। এত বছর ধরে যা করছি হঠাৎ পাল্টাব কেন? তা ছাড়া কাঁচাবাজারে কি কেউ স্যুট-টাই পরে যায় নাকি? মাছ-তরকারির কাদা পানিতে স্যুট-টাই নোংরা হয়ে যায় না?
ধমক দিতে পারতেন; কিন্তু দিলেন না। আজ থেকে দশ-পনেরো বছর আগে হলে হয়তো পারতেন, কিন্তু এখন পারেন না। ঘরে-বাইরে কোথাও পারেন না। এটা তার পক্ষে যেমন অসুবিধের হয়েছে, তেমন আবার সুবিধেরও হয়েছে। অসুবিধা হলো, এর ফলে কোথাও কোনো সময়েই আর উচিত কথা বলা হয় না। আর সুবিধা হলো, জীবনটা ক্রমশ ঝগড়া-ঝামেলাহীন শান্তিপূর্ণ হয়ে উঠছে। তিনি হিসেব করে দেখেছেন, একটা বয়সের পর জীবনে উচিত কথার কোনো দাম নেই; আছে শান্তির। শান্তির জন্য তিনি নিজেই এ পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন। ঘরে-বাইরে খানিকটা ধমকানি, দু-পাঁচটা অপমান, কিছুটা অবজ্ঞা চুপচাপ হজম করে নিলেই কাজ হচ্ছে। আজকাল বাসে-ট্রেনে কেউ পা মাড়িয়ে দিলে আর গায়ে লাগান না। অসহ্য গরমে রাতে টানা লোডশেডিং চললেও ঘামে ভিজে ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকেন। বাজারে ছোটখাটো ওজন ঠকানোর ঘটনায় চোখ ফিরিয়ে নেন। অল্প কিছু পয়সার জন্য ঝামেলা পাকাতে যান না।
সেদিন স্ত্রী সালেহাকে ধমকাতে গিয়েও থমকে গেলেন। কোমল কণ্ঠে বললেন, কী হয়েছে বলো তো? তুমি হঠাৎ লুঙ্গির মতো সামান্য ব্যাপারে যুদ্ধে নামলে কেন?
সালেহা বেগম ঝাঁঝের সাথে বললেন, আমি নামিনি; নেমেছে তোমার মেয়ে।
কাসেম সাহেব তাচ্ছিল্যের সাথে জিজ্ঞেস করলেন, মেয়ে ?
হ্যাঁ তোমার মেয়ে। সেদিন মোবাইলে জানাল, তার শ্বশুর নাকি গাড়ি থেকে তোমায় দেখেছেন।
একমাত্র মেয়ের শ্বশুর মানুষটি অতিরিক্ত রকমের বড়লোক। তার প্রসঙ্গ উঠলেই কাসেম সাহেবের নার্ভাস লাগে। সেদিনও লাগল। কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, লেখার শ্বশুর আমায় দেখেছেন? সালেহা বেগম বললেন, তোমায় দেখবেন কেন? তুমি এমন কিছু রাজা, বাদশা নও যে তোমায় দেখতে হবে। দেখেছে এক কাগজ কুড়ানোওয়ালাকে। ভদ্রলোক সিঙ্গাপুর না ব্যাংককের ফ্লাইট ধরবেন বলে ওই পথে শাহজালালে যাচ্ছিলেন, তুমি লুঙ্গি পরে ব্যাগ একটা হাতে ঝুলিয়ে হনহন করে কাগজ কুড়ানোওয়ালার মতো বাজারে যাচ্ছ।
শাহজালালে? তা আবার কোথায়? কাসেম সাহেব জিজ্ঞেস করলেন।
সালেহা বেগম এবার গলার ঝাঁজটা বাড়িয়ে বললেন, তুমি তো এ সংসারের কোনো খবরই রাখ না। সরকার জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম বদল করে নতুন নাম রেখেছে, হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।
ও তাই বলো, সরকার ক্ষমতাবলে দিন বদলের নামে নাম বদল করে চলেছে। ক্ষমতা তো কারও চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নয় বাবা! ক্ষমতা চলে গেলে পরবর্তী সরকার এই শাহজালালের নাম বদলে যে তৈয়্যেবা মজুমদার বিমানবন্দর হতে পারে তা কি তাদের জানা আছে? সে যাক, ওসব রাজনৈতিক প্যাঁচালে আমাদের দরকার নাই। লেখার শ্বশুর কি বলেছেন তাই বলো।
আজকাল সকালে ব্যাগ নিয়ে কাগজ কুড়াতে বেরোচ্ছ। তিনি ফিরে এসে এ নিয়ে লেখার সাথে হাসাহাসি করেছেন।
কাসেম সাহেব হাঁ হাঁ আওয়াজে বোকা ধরনের হেসে বললেন, কথাটা তিনি ভুল বলেননি। জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে কয়েক দিন পরে ব্যাগ নিয়ে কাগজ কুড়োতে বেরোলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। বেঁচে থাকতে হলে আয়-রোজগারের একটা বিকল্প রাস্তা থাকা দরকার। সে দিক থেকে কাগজ কুড়ানেওয়ালা সব থেকে ভালো। মূলধন লাগবে না।
সালেহা বেগম এবার গলা তুলে ধমকে উঠলেন, চুপ করো। আমার সাথে বাজে রসিকতা করবে না। মেয়ের একটা প্রেস্টিজ আছে। আগে ছিল না না; বিয়ের পরে হয়েছে। তোমার মতো দুপয়সার কেরানির ঘরে তার বিয়ে হয়নি। তুমি সম্বন্ধ দেখলে অবশ্য তাই হতো। মেয়ে নিজের পছন্দে বিয়ে করেছে বলে হয়নি। লেখার শ্বশুরবাড়ির টাকা-পয়সা সম্পর্কে কি তোমার এখনো ধারণা হয়নি?
স্ত্রীর ধমকে দ্রুত হাসি মুছে কাসেম সাহেব বিড়বিড় করে বললেন, অবশ্যই হয়েছে, মেয়ের বিয়ের দু বছর গেল, এখনো ধাক্কা সামলাতে পারিনি; মাথার ওপর বিরাট ধার। রাতে ভালো ঘুম হয় না।
সালেহা বেগম মুখে তাচ্ছিল্যের আওয়াজ করে বললেন, তোমার টাকা নেই, তাই ঘুম হয় না। সেটা তো আমার মেয়ের শ্বশুর বাড়ির অপরাধ নয়। তারা তো আর এসে তোমায় ঘুম পাড়ানি গান শোনাতে পারবে না। যা হোক কাল থেকে তোমার ওই লুঙ্গি বাতিল। তোমার মেয়ে বলে দিয়েছে ,আর একদিনও যদি তার শ্বশুর বাড়ির কেউ তোমাকে ওই অবস্থায় দেখে, তা হলে সে বিষ খাবে।
কাসেম সাহেব নরম গলায় বললেন, লুঙ্গির বদলে আমি যদি বাজার বদল করি?
বাজার বদল মানে ?
মানে, এমন কোনো বাজারে গেলাম, যে দিকটায় বিমানবন্দর যাওয়ার পথ পড়ে না। লেখার শ্বশুর তো প্লেন ছাড়া যাতায়াত করেন না।
সালেহা বেগম এবারও স্বামীর দিকে আগুন চোখে তাকালেন। কাসেম সাহেব বুঝলেন আর কথা বাড়ালে যুদ্ধ বেঁধে যাবে। চোখ নামিয়ে তাড়াতাড়ি বললেন, ঠিক আছে লুঙ্গির পরিবর্তে প্যান্ট-শার্ট অথবা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে যাব। তাতে কাদা পানি লাগলে তুমি নিত্য ধুয়ে দেবে।
সালেহা বেগম ঝামটি মেরে বললেন, দিতে হয়, দেব।
বাজার করার পোশাক বদলেছে কিন্তু ব্যাগ বদলায়নি। একদিন নয়, পরপর দুদিন ঘটল। হাত ঢুকিয়ে মনে হলো, ভেতরে এমন কিছু আছে যা বাজারের ব্যাগে থাকার কথা নয়। বিচ্ছিরি ধরনের মনের ভুল। এমন কেন হচ্ছে? প্রথম ঘটনাটা এক সোমবারের। বাজার থেকে ফিরে প্রতি দিনের মতো তরিতরকারি বের করছিলেন কাসেম সাহেব। টানাটানির সংসারে বাজার করা তরিতরকারি এমন কিছু সোনাচান্দি নয় যে, একটা একটা করে বের করতে হবে। সালেহা বেগম স্বামীর এই একটা একটা করে আলু-পটল বের করা সহ্য করতে পারেন না। এই কারণেই স্বামী বাজার নিয়ে ফেরার সময় তিনি রান্নাঘরে আসেন না। খানিক পরে আসেন। সে দিনও আসেননি। কচি লাউটা বের করার সময়ে মুহূর্তের জন্য ব্যাগের ভেতরে অজানা জিনিসের স্পর্শ পেয়েছিলেন কাসেম সাহেব। একা একাই চমকে উঠেছিলেন তিনি। তিনি মন শক্ত করে ব্যাগের মুখটা বড় করে খুলে ধরলেন। না, কেঁচো-ব্যাঙ, লোহা-লক্কড়, অজানা-অচেনা কিছুই দেখা যাচ্ছে না ব্যাগের মধ্যে। উঁকি-ঝুঁকি মারছে আলু-পটল, উচ্ছে, বেগুন আর এক হালি কাঁচকলা।
ভুল বুঝতে পেরে লজ্জা পেয়েছিলেন তিনি। কেন এমন হলো? গোসল করতে করতে ঘটনাটা মনে পড়ল। বছরখানেক আগে অফিসের হালিম সাহেব একটা গল্প বলেছিলেন, নতুন শালা বউয়ের উপলক্ষে বেড়াতে গিয়েছেন শ্বশুরবাড়ি। বাজার থেকে সওদা নিয়ে বাড়ি ফিরেছে শ্যালক। নতুন বউ ব্যাগ থেকে তরিতরকারি বের করতে গিয়ে ঠান্ডা তেলতেলে কিছু একটা ধরে ফেলে। বের করতে দেখা গেল ইঞ্চি তিন-চার লম্বা একটা কেঁচো লালশাকের তোড়ায় জড়িয়ে আছে। লাফ দিয়েই বেচারি রান্নাঘরে বেহুঁস। মনে আছে গল্প বলতে বলতে হালিম সাহেব হেসে খুন। নিশ্চয় সেই গল্প এখনো মাথায় রয়ে গিয়েছে, আর তাতেই ভুল।
মাথা খুবই আশ্চর্য জিনিস। কম্পিউটারের ফাইল-ফোল্ডারের মতো সব সেভ হয়ে থাকে। হঠাৎ সে ফোল্ডারে টিপ দিলে যেমন খুলে যায়। মাথাও তেমনি; কখন কোন পুরোনো ঘটনা কখন উঁকি মেরে ফিরে আসে, কেউ বলতে পারে না। কিন্তু সে তো বেশ কিছুদিন আগের ঘটনা । আজ আবার একই ভুল হবে কেন? তিনি ভেবেছিলেন, বেলা গড়ালে ব্যাগের ঘটনাটা মন থেকে হারিয়ে যাবে। হারাল না; আবছা ভাবে রয়ে গেল অস্বস্তির মতো। অস্বস্তি মানেই অশান্তি। কাসেম সাহেব বিরক্ত হলেন। তিনি অশান্তি পছন্দ করেন না।
খাওয়ার সময় সালেহা বেগম পাতে লাউয়ের তরকারি দিতে দিতে বললেন সামনের শুক্রবারে লেখা আসছে। ক’টা দিন থাকবে বলেছে। জামাই দিতে আসবে। আমি জামাইকে দুপুরে খেতে বলেছি। প্রথমে রাজি হচ্ছিল না; আমি জোর করেছি।
কাসেম সাহেব অন্যমনস্ক গলায় বললেন, জোর করতে গেলে কেন?
সালেহা বেগম পরিবেশন থামিয়ে বললেন, মানে!
ছেলেটাকে কত দিন খাওয়ানো হয়নি বলো তো?
কাসেম সাহেব মুখ নামিয়ে ভাতের গ্রাস মুখে তুললেন। আমি তা বলিনি, হয়তো ওর জরুরি কোনো কাজ ছিল।
কাজ ছিল তো কী হয়েছে? তাই বলে দাওয়াত করব না? মেয়েটা বা কী ভাববে? এখন কিছু বলবে না, পরে কথা শোনাবে।
কাসেম সাহেব বিড়বিড় করে বললেন, তা হলে ঠিকই করেছ।
সালেহা বেগম মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন, তোমার কাছে ঠিক-ভুলের সার্টিফিকেট চাওয়া হয়নি। ওই দিন ঠিকমতো বাজার করবে। লেখা বলেছে জামাই ভেটকি মাছ পছন্দ করে। বড়টা পারবে না, সে মুরদ তোমার নেই। মাঝারিটা আনবে। ডিমপাড়া একটি মুরগি আনবে; দেশি মুরগি।
সবকিছুতেই তোমার বিদেশি। মুরগির বেলায় দেশি কেন?
তোমাকে যা আনতে বলছি, তাই আনবে কেমন। ফার্মের মুরগিতে কেমন একটা বিশ্রী গন্ধ থাকে।
কাসেম সাহেব স্ত্রীর কথার সঙ্গে আর কথা না বাড়িয়ে অফিসের দিকে রওনা দিলেন। যাওয়ার পথে রিকশায় বসেই কাসেম সাহেব হিসেব কষতে লাগলেন ভেটকির কেজি আজকাল কত যাচ্ছে? কার কাছে টাকা ধার চাওয়া যায়? অফিসে একমাত্র হালিম সাহেবের সঙ্গে তার আন্তরিক সম্পর্ক। সংসারের অভাব-অভিযোগ সব ব্যাপারেই তিনি তার সঙ্গে আলোচনা করেন। টাকা-পয়সা ধার-দেনা দরকার হলে তিনি তার কাছেই চেয়ে থাকেন। হালিম সাহেবও মাঝে-মধ্যে তার কাছ থেকে ধার-দেনা নিয়ে থাকেন। এবারও ভাবছেন তাকে একবার বলে দেখা যেতে পারে। নইলে অন্য চেষ্টা করতে হবে। হাতে তো কয়েক দিন সময় আছে।
ধার চাওয়া আর হলো না। হালিম সাহেব অফিসে আসেননি; পরের দিনও না। পরপর তিন দিনই তিনি অনুপস্থিত। তার সম্পর্কে মারাত্মক একটা খবর পাওয়া গিয়েছে। সেই খবর সত্য না মিথ্যা, বোঝা যাচ্ছে না। তবে অফিসে সবাই বলাবলি করছে, হালিম সাহেবের শ্যালক নাকি কালাচাঁদপুরে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। তার বাজারের ব্যাগে রিভলবার পাওয়া গিয়েছে। কলমিলতার মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। পুলিশ তাকে হাতেনাতে ধরেছে। তল্লাশির সময় তারা ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে প্রথমে ঠান্ডা,শক্ত জিনিসের ছোঁয়া পায়। এমনি তেমনি শক্ত নয়, লোহা পিতলের মতো শক্ত। এরপরই পুলিশ আস্ত একটা রিভলবার টেনে বের করে ব্যাগ থেকে। দেশি না, মেড ইন আমেরিকা? তখনো নলের সাথে নাকি কলমি লতার কয়েকটা ভেজা ভেজা পাতা ঝুলছিল। হালিম সাহেব তাকে ছাড়াতে থানা-পুলিশ করে বেড়াচ্ছেন। খবর শুনে অনেকক্ষণ ঝিম মেরে বসে রইলেন কাসেম সাহেব। যার বউ লালশাকে কেঁচো দেখে অজ্ঞান হয়েছিল, তার কিনা এই কাণ্ড? পরে শুনলেন বেচারা নাকি একটি রাজনৈতিক দলের ছোট-খাট নেতা। পুলিশ তাকে ধরতে নিজেরাই তার ব্যাগে অস্ত্রটা ঢুকিয়ে নাটক সাজিয়েছে।
শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সকাল সকাল বাজারে গিয়ে জামাইয়ের জন্য বাজার করলেন কাসেম সাহেব। মাঝারি সাইজের ভেটকির সাথে বড় পাবদাও নিয়েছেন। দেশি ডিমপাড়া মুরগি একটি। যেমন সালেহা বেগম বলে দিয়েছেন।
আনাজপাতির লিস্টের বাইরে দুম করে এক কেজি কলমিলতা কিনে ফেলেছেন যার কোন দরকার ছিল না, তবুও কিনেছেন। কলমিলতা নজরে পড়তেই মনে পড়ে গেল কিশোর বেলার সেই স্মৃতি, বাবা তখন কৃষি কাজ করতেন। চার-পাঁচ জন মজুর খাটত বাবার কৃষিকাজে। আষাঢ়- শ্রাবণ মাসে মাঠ থেকে ফেরার পথে ইছাহাক নামের এক বালক প্রায় প্রতিদিন কলমিলতা তুলে নিয়ে আসত মায়ের জন্য। মা সেখান থেকে কচি কচি শাকগুলো খুব যত্ন করে চিংড়ি মাছ দিয়ে চচ্চড়ি রাঁধতেন। মায়ের হাতের রান্না ছিল দারুণ। সে দিনের সেই কলমিলতা ঢাকার বাজারে আজকাল চড়া দামে বিক্রি হয়। সচরাচর পাওয়াও যায় না। অনেক দিন পর চোখের সামনে পড়ায় এক কেজি কিনে ফেলেছেন। ঠিক করেছেন বাড়িতে ফিরেই সালেহা বেগমের অগোচরে গোপনে ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে দেখবেন হাতে রিভলবারের ঠান্ডা ছোঁয়া লাগে কিনা।
দু’বার ভুল হয়েছে বলেই যে বারবার ভুল হবে, তার কি মানে আছে?