ফ্রিডম ইজ নট ফ্রি

ফ্রি? মুক্ত? আজ থেকে আমি মুক্ত! স্বাধীন! মুক্তির ডানা মেলে উড়ব আকাশে! নিশ্বাস নেব নির্মল বায়ুর। অবগাহন করব ঝরনা বা সমুদ্রের জলে। আহা কি আনন্দ! এই মুক্তি কি এই পৃথিবীতে আছে?
মুক্ত বিশ্বের নেতা আমেরিকা। অঢেল স্বাধীনতা। এ মাটিতে পা দিয়েই আনন্দে নেচে উঠি। স্বপ্নের চাবি এই এল হাতে। আহা কি আনন্দ। কিন্তু হায়! হানিমুন সময়টা বড়ই ছোট। বাস্তবতার নির্মম আর বেদনাভরা কশাঘাতে সকালে-বিকেলে জর্জরিত হয় স্বপ্ন। ‘মুক্তি–স্বাধীনতা’ বন্দী হয় ঘড়ির কাটায়। কোথায় তুমি? কাজে। এখন কোথায়? কাজে। রাতেও কি কাজ? স্বপ্নের পাখিরা পালিয়ে বেড়ায়। আহা মুক্তি!
আমার এক অনুজ পঞ্চাশোর্ধ্ব বন্ধু। বিয়ে-শাদি করে না। বিয়ের কথা বললে আরও দু চারজনের উদাহরণ টেনে বলে, এইতো বেশ আছি, ভালো আছি। কথায় কথা বাড়ে। বলে, আপনাকে এক সিলেটি প্রবাদ শোনাই, ‘দুপা হলে ঘুরে ফিরে খাও, চার পা হলে খানি-খোরাকি দিয়ে যাও, আর ছয় পা হলে বাবা তুমি কোথায় যাও!’
বললাম, এতো জীবন থেকে পালিয়ে বেড়ানো। এটিতো মুক্তি নয়, ভয়ের কাছে দাসত্ব।
মুক্তির নিশ্বাস, এটিতো আপেক্ষিক। কেউ আছে, গাছের নিচে নিদ্রায় বিভোর হয়ে সুখ খুঁজে। আর কেউতো শীতাতপে ডজন ডজন ওষুধ খেয়ে ঘুমাতে পারে না। তাই বলে কি বলব, গাছের নিচেই হোক আমার ঠিকানা?
একবার কয়েক বন্ধু দল বেঁধে গেছে পড়শির নারকেলের ডাব চুরি করে খেতে। রাতের আঁধারে এক ডাব এসে পড়ল একজনের মাথায়। চিৎকার করতে পারছে না, গৃহস্থ জেগে যাবে। ব্যথায়–যন্ত্রণায় বন্ধুদের চাপা আর্তনাদ করে বলল, আমাকে তোরা খালি মাঠে নিয়ে যা, আমি চিৎকার করে কিছুক্ষণ কাঁদব। ওই সময় ডাব নয়, চিৎকার করে কাঁদতে পারাটাই ছিল তার মুক্তি।
আমেরিকায় অনেকের কণ্ঠে অনেক সাহসী উচ্চারণ শুনি। লেখার অনেক ঝাল! বিষয় কি! স্বদেশে যা ছিল না, এখানে তাই আছে। বলার স্বাধীনতা, লেখারও। তা কি শতভাগ সত্য? এখানে চাইলেই কি সব বলা যায়? সব লেখা যায়? ওখানে চোখ রাঙানি থাকলে এখানে আছে ‘সু’। আছে বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থ।
এক সময় মনে করা হতো, আমেরিকায় ফ্রিডমেরই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। অন্য কিছু ক্ষুণ্ন হোক, ফ্রিডমের বেলায় কোনো আপস নয়। নাইন–ইলেভেনের পর সব বদলে গেল। ফ্রিডম নয়, নিরাপত্তাই হলো নম্বর ওয়ান ইস্যু। জিরো টলারেন্স। অন্য সবকিছুর আত্মসমর্পণ এই নিরাপত্তার কাছে।
এক গল্প মনে পড়ল। এক বধূ তরকারিতে শুধু ঝাল দেয়। স্বামী মুখে দিতে পারে না। একদিন রেগে গিয়ে স্বামী তাড়া করল বউকে। বউ দৌড়ে বাড়ির খাল পাড়ি দিয়ে মুক্তির নিশ্বাস টেনে বলল, ঝাল তো ঝাল, আজ তরকারিতে লবণও দিইনি। এই গল্পের মতো অনেকে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে হুংকার ছাড়েন।
স্বদেশে অন্য কিছুতে কি আছে না–আছে সে তর্কে যাব না। তবে দু–এক বিষয়ে মানুষের অঢেল স্বাধীনতা আছে। গাছের নিচে অথবা রেল জাহাজ ঘাটে রাত কাটানো আর খাল নদীর ধারে বা খোলা মাঠে জমির আইলে প্রাকৃতিক কর্ম সম্পাদনে কোনো বাধা নেই। অবশ্য আরেকটি বিষয়েও প্রচুর ফ্রিডম আছে। রাস্তা-ঘাটে যত্রতত্র যেখানে-সেখানে ময়লা আবর্জনা ফেলা। এই স্বাধীনতা অনেকেই উপভোগ করেন।
আপনি যখনই ছাদের নিচে ঘুমাতে চাইবেন তখনই আসে মূল্যের বিষয়। এই পৃথিবীতে কোনো কিছুই ফ্রি বা বিনা মূল্যের নয়। এমনকি হাসিটাও। রেস্তোরাঁর গুমরো মুখো কাউকে আপনি টিপস দেবেন? হাসিমাখা মুখের জয় সবখানে।
এখানে লাখ লাখ মানুষ বাড়ির মালিক। কিন্তু সবাই কি মালিক? এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ব্যাংকই আসল মালিক। তিন মাসের মর্টগেজ বকেয়া থাকলে বাড়ি হাত ছাড়া হয়ে যাবে। পুরো পরিশোধের বাড়িতেও অনেক খরচ। পৌরকর, নগর কর্তৃপক্ষের কর, ইনস্যুরেন্স, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, পয়োনিষ্কাশন—সব মিলিয়ে অনেক খরচ, অনেক টাকা। সেটা নিউইয়র্কে হোক বা হোক ঢাকায়। একই কথা, একই খরচ।
এই পৃথিবীতে তা হলে ফ্রি কোনটি? আর কোথায়? ফ্রি বলে কিছু নেই। বরং আছে দায়িত্বশীলতা-রেসপনসিবিলিটি। জীবনটাও তাই।
হিলসাইড অ্যাভিনিউয়ে এক পথচারীর ক্যাপে লেখা ‘ফ্রিডম ইজ নট ফ্রি’। এই স্লোগানটি দেখে মনে এল এত কথা।
লেখক: সাংবাদিক, নিউইয়র্কপ্রবাসী