বেঁচে থাকাটাই আনন্দের

বেশ কিছুদিন ধরেই কেমন যেন ঘোরের মধ্যে বসবাস করছি। সবকিছুতেই নির্লিপ্ত হয়ে আছি। কোনো কিছুর প্রতি টান অনুভব করছি না। রোজ ঘুম, খাওয়া, কাজ আর মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা। এমন নিশ্বাস-ভারী সময়ে নিজের কাছে নিজেকেই অচেনা লাগছে। গতানুগতিক জীবনটাকে একঘেয়ে মনে হচ্ছিল। কোথাও কোনো বৈচিত্র্য নেই। বাবা-মাসহ অনেক দূরে ফেলে আসা আপনজনদের ভীষণ মনে পড়ছে। বুঝতে পারি, কোনো কারণ ছাড়াই যুক্তিহীন হতাশা, অস্থিরতা পেয়ে বসেছে। অস্থিরতা কাটাতে যোগ ব্যায়ামের আশ্রয় নিই। তাতেও কোনো উপকার পেলাম না।
চিন্তা, চেতনা ও মননে প্রতিটি মানুষ-ই স্বতন্ত্র। চেষ্টা করেও মানুষ তার নিজস্বতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। যান্ত্রিক এই শহরে মন ভালো হওয়ার জন্য ইউটিউবে গান শোনা কিংবা বদ্ধ ঘরে বসে রোবটের মতো একের পর এক টিভি চ্যানেল ঘুরে টেলিভিশন দেখায় আমার মন স্থির হয় না কখনো। আমার ইচ্ছে করে মাছেদের শান্ত দিঘির জলে সাঁতার কাটতে। সবুজ ঘাসের ওপরে ঘাসফড়িঙের সঙ্গে লাফিয়ে বেড়াতে। ঝুম বৃষ্টিতে নৌকা নিয়ে মাঠের মাঝখানে গিয়ে খোলা আকাশের নিচে জীবনানন্দের, ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়, হয়তো মানুষ নয় হয়তো শঙ্খচিল শালিকের বেশে’ কিংবা আবদুল আলিমের, ‘হলুদিয়া পাখি সোনার-ই বরণ, পাখিটি ছাড়িল কে, কেউ না জানিল কেউ না দেখিল, কেমনে পাখি দিয়া যে ফাঁকি উইড়া গেলো হায় চোখের পলকে’ গানগুলো গলা ছেড়ে গাইতে। শিশিরভেজা ধানখেতের আলপথ ধরে দৌড়ে বহুদূর যেতে। দাদার পাশে জল চৌকিতে বসে মাটির উনুনের তাপ নিতে। ভোরের শিউলি ফুল কুড়াতে। সকালের নরম মিষ্টি রোদে প্রজাপতির পেছনে ছুটতে। ইট, কাঠের এই শহরে আমার আকাঙ্ক্ষাগুলোকে পূর্ণতা দেওয়া সম্ভব হয় না। ইচ্ছেগুলো দীর্ঘশ্বাসের ভাঁজে চাপা পড়ে যায়। শরীরে জ্বর অনুভব করায় ওষুধ খেয়ে ক্লান্ত মস্তিষ্কে ঘুমিয়ে পড়ি।
অ্যাম্বুলেন্সের বিকট শব্দে সূর্যোদয়ের আগেই ঘুম ভেঙে যায়। ততক্ষণে জ্বরের মাত্রাও নেমে যায় আমার। অজানা ভয়ে প্রথমেই বুকটা দুমড়ে-মুচড়ে উঠল। তড়িঘড়ি জানালার কাছে গিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম, আমার বাড়ির একতলার ভাড়াটিয়া খালাম্মাকে অ্যাম্বুলেন্সে ওঠানো হচ্ছে। খালার দুই ছেলের চোখেমুখে রোজকার মতো আজও রাজ্যের বিষাদ চেয়ে আছে। খালু শূন্য চোখে খালার হাত দুটো ধরে রেখেছে। খালাও পরম নির্ভরতায় খালুর হাত দুটো আঁকড়ে ধরে আছে। অনেক দিন ধরে ডায়াবেটিসের কারণে খালার দুটি কিডনিই অনেকখানি নষ্ট হয়ে গেছে। সপ্তাহে তিন দিন ডায়ালাইসিস করতে হয়। এর মধ্যেও প্রায় উনি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। খালার মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে অ্যাম্বুলেন্স দ্রুতগতিতে চলে গেল। গতকাল বিকেলেও বাসার সামনে খালাকে হাঁটতে দেখলাম। অন্য শহরে বাস করা তাঁর আত্মীয়ের সঙ্গে বেশ খোশমেজাজে কথা বলতে শুনলাম। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে উনি এখন হাসপাতালের বিছানায়। মনে মনে বললাম, মানুষের জীবনের কোনো ভরসা নেই। কয়েক সেকেন্ড পরে মানুষের জীবনে কী ঘটবে কেউ জানে না। জীবনের কোনো অবস্থান চিরস্থায়ী নয়। মানুষের সব চাওয়া- পাওয়ার একদিন কোনো মূল্য থাকবে না জেনেও মানুষ জীবনকে ভালোবাসে। কত স্বপ্ন প্রস্ফুটিত হওয়ার আগেই ঝরে যায়, তবুও মানুষ রঙিন স্বপ্ন দেখে। থেমে যাওয়ার অপর নাম মৃত্যু। জীবনের নির্দিষ্ট কোনো অর্থ খুঁজে না পেয়েও তাই নিয়ত এই পথ চলা।
দুপুর বেলায় খালাকে দেখতে হাসপাতালে গেলাম। বিষয়টা ছিল অনেকটা এক ঢিলে দুই পাখি মারার মতন। দেশ ছেড়ে বিদেশে আসার পর থেকে যখনই আমার মন খারাপ হয়, তখনই আমি মন ভালো করার জন্য হাসপাতাল, সাগর, পর্বতের কাছে ছুটে যাই। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। অশান্ত চিত্তকে শান্ত করা এবং খালাকে দেখতে যাওয়া—দুটোই ছিল আমার লক্ষ্য। হাসপাতালে ঢুকতেই হুইলচেয়ারে বসা প্রতিবন্ধী সন্তানের সঙ্গে মায়ের খেলার দৃশ্য দেখেই মন ভালো হয়ে গেল। কিছু সময় সেখানটায় দাঁড়িয়ে দেখলাম মেয়েটির মাথা স্বাভাবিকের চাইতে অনেক বড়। ঠান্ডাজনিত সমস্যা বা অন্য কোন কারণে মেয়েটি স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিতে পারছিল না। তার নিশ্বাস নেওয়ার কষ্ট দেখে আমার খারাপ লাগছিল বলে দ্রুত খালাকে দেখতে চলে যাই কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টারে। যে রুমটিতে কিডনি ডায়ালাইসিস করানো হয়, সেখানে গিয়ে আমি অনড়ভাবে কিছু সময় থাকি। আপাদমস্তক অবশ হয়ে আসে। আমার কানের মধ্যে মানুষের চিৎকার, গোঙানির করুণ শব্দ ভেসে আসছে। খালাসহ আরও কয়েকজন রোগীর মুখের দিকে আমি পাথর চোখে তাকিয়ে থাকি। কতক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম মনে নেই। প্রতিটি মানুষের চোখেমুখে বেঁচে থাকার স্বপ্ন। প্রতিটি প্রাণ বেঁচে থাকার জন্য, সুস্থভাবে একটু নিশ্বাস নেওয়ার জন্য কী আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে, তা অন্তর দিয়ে অনুভব করেছিলাম। বাঁচার জন্য সবাই যেন যমদূতের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। চারপাশে তাকিয়ে আমার দমবন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হলো।
দ্রুত পায়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আমি খোলা আকাশের নিচে এসে দাঁড়াই। বুক ভরে শ্বাস নেই। আইসিইউতে একেকটি নিশ্বাসের মূল্য যখন হাজার হাজার টাকা, তখন রাতদিন প্রাণভরে এভাবে যে শ্বাস নিতে পারছি তার জন্য স্রষ্টাকে শ্রদ্ধাবনত মস্তকে কৃতজ্ঞতা জানাই। ততক্ষণে শীতের দুপুরের স্বল্পায়ু রোদ বিদায় নিয়ে বিকেলের মৃদু বাতাস বইছে। জীবনের সবকিছুকে ভীষণ সুন্দর, সহনীয় ও আদরণীয় লাগছে। চারপাশটাকে নিখুঁত মনে হচ্ছে। মেঘ সরে আলোর টুকরোগুলো শিমুল তুলোর মতো এসে মনের ঘরে উড়ছে। সহস্র ঝরনা জলের শব্দে বুকের গহিন বন পুলকিত হয়ে উঠে। ফুলে ফুলে মধুর হাসি বইছে। পাতার মর্মরে প্রিয় গানের সুর বাজছে। সব কথা, হাসি, সুরে সুরে যেন রূপকথা হয়ে আমার কানে বাজছে। বিস্তীর্ণ পুরো আকাশ, পৃথিবী হাতছানি দিয়ে যেন আমায় ডাকছিল। সঙ্গে থাকা ইলেকট্রনিক ডিভাইসটাকে বন্ধ করে পুরো বিকেল প্রকৃতির সান্নিধ্যে কাটিয়ে মনে প্রশান্তি ও সতেজতা নিয়ে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে এলাম।
জীবন ক্ষণস্থায়ী। জীবনের নির্ধারিত সময় খুব দ্রুত ফুরিয়ে যায়। শেষ ঠিকানা অজানা হলেও গন্তব্য সব মানুষের-ই জানা। মৃত্যুতেই ইহজাগতিক জীবন পরিপূর্ণ হয়। জীবনের আলো, অন্ধকার, সুখ-দুঃখ কোনটিই স্থায়ী হয় না। জীবনের কোনো কথাও শেষ কথা নয়। সময়ের প্রয়োজনে জীবনের রং আপনাআপনি পাল্টে যায়। জীবনের ওপরে মানুষের নিয়ন্ত্রণ নেই। জীবনের অপার রহস্য হয়তো এই অনিশ্চয়তার মধ্যেই নিহিত রয়েছে। অতীতে কেউ ফিরতে পারবে না। ভবিষ্যৎ ধোঁয়াশা। শুধু বর্তমানেই মানুষ বাঁচে। মৃত্যুর পূর্বক্ষণ পর্যন্ত যার যা আছে, তা নিয়ে সুস্থভাবে নিশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকাটাই আনন্দের এবং সুখের।