লাতিন আমেরিকার নেতাদের উড়োজাহাজ বিড়ম্বনা

রয়টার্স ফাইল ছবি
রয়টার্স ফাইল ছবি

মেক্সিকোয় এক ভ্রমণকারীর ফ্লাইট ছাড়তে দেরি হয়েছে পাঁচ ঘণ্টা। এ নিয়ে একটি ভিডিও গত সেপ্টেম্বর মাসে অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ে। তা দেখে দেশটির নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ও বামপন্থী নেতা আন্দ্রে ম্যানুয়েল লোপেজ ওব্রাডোরের নজরে এলে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন। বৃষ্টির কারণে ওই ফ্লাইটটি ছাড়তে দেরি হয়েছিল বলে পরে জানতে পারেন আন্দ্রে ম্যানুয়েল।

উড়োজাহাজবিষয়ক জটিলতা এড়াতে ও ব্যয় কমাতে তিনি নিজের জন্য বরাদ্দ করা উড়োজাহাজ বিক্রির ঘোষণা দিয়েছেন। অবশ্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে নির্বাচনী প্রচারণায় আন্দ্রে প্রেসিডেন্টের জন্য বরাদ্দ করা উড়োজাহাজ বিক্রির কথা বলেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর সে ঘোষণা এখন কার্যকর করার অপেক্ষায় রয়েছেন ম্যানুয়েল লোপেজ। তিনি বলছেন, ‘দেশে এত দারিদ্র্য রেখে ব্যয়বহুল উড়োজাহাজ ব্যবহার করলে আমি বিব্রত হব।’
বিভক্সওয়াগেন জেটটা গাড়ি ব্যবহার করেন লোপেজ। মাসে ৬০ শতাংশ (১ লাখ ৮ হাজার পেসো বা ৫ হাজার ৭০০ ডলার) পরিবহন খরচ কমানোর পরিকল্পনা করেন তিনি। অবশ্য এটাকে অনেকে রাজনৈতিক কৌশল বলেও মনে করছেন।
নিজ দেশের অর্থনৈতিক নাজুক পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে গত মে মাসে নতুন উড়োজাহাজ কেনার সিদ্ধান্ত স্থগিত করেছেন আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট মাওরিসিয়ো মাকরি। প্রেসিডেন্টকে বহনকারী বর্তমানে দেশটিতে ২৬ বছরের পুরোনো ‘ট্যানগু ০১’ নামে বোয়িং ৭৫৭ রয়েছে। গত বছর ইকুয়েডরের প্রেসিডেন্ট লেনিন মোরিনো দুটি উড়োজাহাজের মধ্যে একটি বিক্রির ঘোষণা দেন। ওই দুটি উড়োজাহাজ কিনেছিলেন পূর্ববর্তী বামপন্থী প্রেসিডেন্ট রাফায়েল কোরেয়া। সরকারি হিসাবের নিয়মিত তদন্তের অংশ হিসেবে রাফায়েল ক্ষমতায় থাকার সময় ব্যবহার করা উড়োজাহাজ দুটির বিষয়ে তদন্ত করছে দেশটির নিরীক্ষা দপ্তর।
এ বিষয়ে রাফায়েল কোরেয়া বলেন, তিনি কেমন পরিশ্রম করেছিলেন, নিরীক্ষা তদন্ত প্রকাশ হলে তা দেখা যাবে। অর্থ সাশ্রয় করতে প্রেসিডেন্ট ভবনে ফ্লাইটে করে খাবার পরিবহন করে নিয়ে এসেছিলেন বলেও জানান তিনি। এতে প্রেসিডেন্টের উড়োজাহাজ ব্যবহারজনিত অতিরিক্ত ব্যয়ের তথ্য নিরীক্ষায় বেরিয়ে আশার আশঙ্কা করছে কেউ কেউ।
সম্প্রতি ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০১৬ সাল ব্রাজিলের ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়। তখন প্রেসিডেন্টের এয়ারবাসে সরবরাহের জন্য ৫ লাখ ২০ হাজার ডলারের খাবারের অর্ডার জব্দ করে সরকার। ওই অর্ডারের মধ্যে ৫০০ আইসক্রিমের টিউব ও দেড় টন চকলেট কেক ছিল। এমন ঘটনায় ব্রাজিলের অনেক নাগরিক হতভম্ব হয়ে যান। সে সময়ের প্রেসিডেন্ট মাইকেল টিম্বার পরে ওই অর্ডার বাতিল করে দেন।

আট সিটের উড়োজাহাজ প্রেসিডেন্টের জন্য মানসম্মত ভাবা হয়। গত ফেব্রুয়ারি মাসে এমন একটি উড়োজাহাজ কেনেন উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট তাবারুয়ে ভাসকুয়েজ, যার মূল্য প্রায় এক মিলিয়ন ডলার। তাবারুয়ে ভাসকুয়েজ আর্জেন্টিনার বামপন্থী নেতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট ক্রিস্তিনা ফের্নান্দেস দে কির্শনার, ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট দিলমা রুসেফের সঙ্গে উড়ন্ত উড়োজাহাজে আকস্মিক ঝাঁকি খেয়ে ভ্যাবাচ্যাকায় পড়ে যান। পরে তিনি উড়োজাহাজটি সংস্কারের জন্য নির্দেশ দেন।

উড়োজাহাজব্যবস্থা নিয়ে বিড়ম্বনা ও চাপের মুখে বিশ্বের অনেক নেতাই পড়েছেন। তবে স্বৈরশাসকদের ক্ষমতার দাপটে এসব কবজায় নিতে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না। কিউবার প্রেসিডেন্ট মিগুয়েল ডিয়াজ-ক্যানেল বিদেশ সফর করেন রাশিয়ার নির্মিত ১২ বছরের পুরোনো উড়োজাহাজে। ওই উড়োজাহাজে উন্নত চামড়ার সিট ও পানশালা রয়েছে। সম্প্রতি তিনি ওই উড়োজাহাজে উড়ে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন।

ভেনেজুয়েলায় উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি ও খাদ্যঘাটতি রয়েছে। দেশের অর্থনীতির নাজুক পরিস্থিতিতে বাণিজ্যিক ফ্লাইটে চলাচল উচিত নয় বলে মনে করেন ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো। তারল্য নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা কড়াকড়িতে বেশির ভাগ এয়ারলাইনস দেশটি ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। খুচরা যন্ত্রাংশ ও জ্বালানির অভাবে অভ্যন্তরীণ উড়োজাহাজগুলো উড়তে না পেরে মাটিতে অবস্থান করছে। তবে দেশের অ্যাথলেটদের বিদেশে প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে মাদুরো উদারভাবে তাঁর ‘এয়ারবাস এ ৩১৯’ ব্যবহারের সুবিধা দেন। প্রেসিডেন্ট মাদুরো বলেন, ‘সারা দেশে আমি মোটরবাইক অথবা গাধার পিঠে চড়েই ভ্রমণ করতে পারি।’

প্রেসিডেন্টের উড়োজাহাজের ওপর অর্থ সংকোচন পরিকল্পনাকে সংকীর্ণতা মনে করে আর্জেন্টিনা। দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী প্রেসিডেন্ট মাকরিকে একযোগে বাণিজ্যিক ফ্লাইট পরিহার করার পরামর্শ দিয়েছে। তারা উড়োজাহাজে নিরাপত্তা, চিকিৎসাসেবা ও জরুরি সেবা চালু করেছে। গত এপ্রিলে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট আন্দ্রে ম্যানুয়েল লোপেজ। বিলম্বিত ফ্লাইটের কারণে যদি জাতিসংঘের বৈঠকে পৌঁছাতে তাঁর দেরি হয়ে যায়, তবে তিনি কী করবেন?
এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে তিনি অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়েন। ফ্লাইট ছাড়ায় বিলম্ব, নিম্নমানের সেবা, অতিরিক্ত ভ্রমণ ব্যয়, রাজনৈতিক কৌশলসহ নানা জটিলতার কারণে লাতিন আমেরিকার নেতারা উড়োজাহাজ বিড়ম্বনার মুখোমুখি হচ্ছেন।