পলোকাহিনি

পলো। মাছ ধরার যন্ত্র। পলোর আকার হয় নানা ধরনের। গ্রাম বাংলায় ছোট আকারের যেমন হয়, তেমনি বড় ও মাঝারি আকারের পলো দেখা যায়। অথচ কী আশ্চর্য, সেই গ্রাম-বান্ধব পলো আজ হাজার মাইল উড়ে এসে নিউইয়র্ক নগরীর অভিজাত পাড়ায়।
পরিবার, স্বজনের পাশাপাশি বন্ধু-বান্ধবদের ক্রমাগত অভিযোগের ভার কমাতে ছুটির দিন শুক্রবার গেলাম নিউইয়র্কে বাঙালিদের অভিজাত পাড়া লং আইল্যান্ডের এক ধনবান আত্মীয়ের খোলামেলা বাসায়। সুদৃশ্য বাংলো টাইপের বাড়ির পেছনের বারান্দায় চা-কফি পানের সঙ্গে আত্মীয়স্বজনদের নিয়ে আড্ডার বিশেষ ব্যবস্থা বেশ চোখে পড়ার মতো। গৃহকর্তা ডেকে নিলেন সেখানে। আরামদায়ক গার্ডেন সোফায় বসতে বসতে সামনের ব্যতিক্রমী ডিজাইনের টেবিলটি হঠাৎ চোখে পড়ল। দেশের হাজার হাজার গ্রামের বাড়িঘরে অনাদরে আর অবহেলায় ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা খালে বিলে মাছ ধরার যন্ত্র ‘পলো’। বেশ বড় সাইজের শক্ত বাঁশ বেতের তৈরি পলোর ডিজাইনে বানানো সেন্টার টেবিল একেবারে খোলা বারান্দার সেন্টারে। কায়দা করে পলোর মাঝখানে লোহার খুঁটির ওপর পুরু গ্লাসের টপ বসানো।
গৃহকর্তাকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, গ্রামীণ পরিবেশ বিশ্বের আধুনিক নগরীতে তৈরি নিজ বাড়িতে প্রদর্শনের আকাঙ্ক্ষা থেকেই ভালো পরিমাণের ডলার খরচ করে টেবিলটি তৈরি করেছেন। বুদ্ধি করে বলে দিলেন, স্মৃতিতে আর চোখে আটকে রাখেন ডিজাইনটা। ফোনে তুলে পুরো দুনিয়ায় ভাইরাল করবেন না দয়া করে। বুদ্ধিমানের জন্য ইশারাই কাফি। মনে মনে বললাম, ভাইজান ফোন আটকাতে পারবেন বৈকি, কলম আটকাবেন কীভাবে? সাদাকালোতে সবাইকে জানানোর সিদ্ধান্ত মেজবানের পাশে বসেই নিয়ে নিলাম। গ্রাম ছিল যার আত্মার অপর পিঠ, সেই গ্রাম্য হৃদয়ের এক শহুরে মানুষের চোখে তাই পলো নিয়ে কৈশোরের কিছু স্মৃতির অবতারণা করতে হল এখানে।

গ্রামে বিশেষ করে হাওর–বাওর অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে কেউ না কেউ থাকেন বাঁশ-বেত দিয়ে পলো বানানোর ওস্তাদ। ফাল্গুন চৈত্র মাসে বাড়ির পাশে ডোবা আর এঁদো পুকুর শুকিয়ে যেতো, গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট্ট নদীর পানি কমে হয়ে যেতো মরা নদী। সবাই এ সময় নিজ নিজ পলো মেরামত করে তৈরি হয়ে যেতেন। যেকোনো দিন ডাক পড়তে পারে পলো বাইচের। গ্রামের মুরুব্বিরা বসে ঠিক করেন, কবে আর কোনো ডোবাতে পলো বাইচ হবে। সময়ও ঠিক করা থাকে আগেই। সময় হওয়া মাত্র পুরো গ্রামে হইচই পড়ে যায়। প্রতিটি বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে ছোট বড় নানা আকারের পলো। বড়রা বড় সাইজের পলো হাতে ডোবার দিকে যেতে শুরু করলে বাড়ির ছোটরাও তাদের ছোট পলোটি নিয়ে শরিক হন দলের সঙ্গে। গ্রামজুড়ে তখন, চলো চলো আওয়াজ। সবাই একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ত ডোবা কিংবা শীর্ণ হয়ে যাওয়া নদীর বুকে। ঝুপ ঝুপ করে একসঙ্গে শত শত পলো পড়ছে আর উঠছে। এক লাইনে সবাই পলো হাতে ঝাঁপ মারতে মারতে এগোচ্ছে। ঝাঁপ মেরে পলোর নিচে কোনো আওয়াজ পেলে কুঁজো হয়ে বাম হাতে পলো শক্ত করে মাটিতে চেপে ধরে ডান হাতে মাছের খোঁজে চলে তল্লাশি। ভেতরে মাছ ধরা পড়লে শক্ত করে মাথায় চেপে ধরে, বাইরে এনে সুচালো শিকের পেছনে আটকানো মোটা দড়িতে গেঁথে ঝুলিয়ে রাখা হতো রশি কোমরে প্যাঁচ দিয়ে।

পলো কি শুধু মাছ ধরতে ব্যবহার হতো? তা কিন্তু নয়। হলদে আর কালো রঙের মিশেলে তুল তুলে হাঁসের ছানাদের চিল আর দাঁড়কাকের ঝাপটা থেকে বাঁচাতে পলোর নিচে মাটির থালায় পানি আর ভুষিমাখা দিয়ে ঝাঁপিয়ে রাখতেন বাড়ির মা-চাচিরা। বাড়ির উঠোনে মরিচ, নয়তো কাঁচা মাছ কেটে শুকোতে দিয়েছেন, কিন্তু আশঙ্কা আছে কাকের দল এসে ছোঁ মেরে নিয়ে যাওয়ার। গৃহিণীরা বড় আকারের পেটমোটা টাইপের পলো দিয়ে আগলে রাখতেন শুকাতে দেওয়া মরিচ বা কাঁচা মাছ। গ্রামের প্রতিটি বাড়ির উঠোনে দু-একটি পলো থাকবেই। গৃহিণীদের দরকারি এক সামগ্রী বাঁশের তৈরি এই পলো।

ছোটবেলায় আমরাও দেখেছি বাসার বারান্দায় না হয় উঠোনে মাঝারি সাইজের একটি পলো অযত্নে একপাশে পড়ে আছে। শহরে থাকলেও আমাদের সময়ে ছোট্ট মফস্বল শহরের অধিকাংশ বাসা ছিল গ্রামীণ আদলে। প্রায় প্রত্যেক বাসায় পেছনে গোয়ালঘর, হাঁস মুরগির খুট্টি, গোয়াল ঘরের বারান্দার এক কোণে ছাগলের জন্য বাঁশ দিয়ে বানানো আলগা ঘর। বাসার পেছনে ছিল মায়ের নিজ হাতে গড়ে তোলা মিনি পশু খামার। চারটি দুধেল গাই, সঙ্গে শ খানেক দেশি হাঁসের সঙ্গে সমান সংখ্যক কিংবা তার চেয়েও বেশি নানা জাতের মোরগ–মুরগি, গোটা পনেরো তিতিরসহ আরও অনেক জাতের পোষা পাখি। কবুতরের চারটি বাক্স ছিল গোয়াল ঘরের বারান্দায় ঝোলানো। মূল ঘরের বারান্দায় ঝোলানো সুদৃশ্য বাঁশের তৈরি খাঁচায় পোষা ময়না। যেটি মেহমান কিংবা ভিক্ষুক দেখলে বলতো ‘আম্মা মেহমান’। ভোরে ঘুম থেকে উঠে কর্মী বাহিনী নিয়ে মা নামতেন তাঁর মিনি খামার আর বাগান তদারকিতে। শহরে বাস করে আমাদের শৈশব থেকে যতদূর মনে পড়ে, গরুর দুধ কিংবা হাঁস মুরগির ডিম কিনে খাইনি। সেই গ্রামীণ ছোঁয়ায় মাখা শহরের বাড়িতে বাঁশের তৈরি শক্ত পলো না থাকার কথা নয়।

ছোটবেলায় দেখতাম পলোতে করে রোগী বহনের দৃশ্য। শহরের উপকণ্ঠ থেকে বড় সাইজের পলোকে উল্টিয়ে ওপর নিচ করে মাঝখানে বিছানা বসিয়ে বয়স্ক পুরুষ বা মহিলা, কখনো প্রসূতি মায়েদের শহরের মাতৃমঙ্গলে নয়তো হাসপাতালে নিয়ে আসত স্বজনেরা।
কাউকে দেখতাম দরজার পাটাতনে করে রোগী বহন করতেন। কৌশলে পাটাতনের দুই পাশ আটকিয়ে পাতলা তোশকের ওপরে রোগীদের শুইয়ে শক্ত করে ঝোলানো রশির ভেতর লম্বা বাঁশ আড়াআড়ি ঢুকিয়ে সামনে পেছনে বাঁশটি কাঁধে নিয়ে জোর কদমে হেঁটে চলতেন দুজন পুরুষ। একসময় গ্রামীণ জনপদে দুবেহারা কিংবা চার বেহেরার পালকি বহনের মতোই। পলোতে রোগী বহনের দেখা শিশুকালের এক স্মৃতি আজও আমায় খানিকের জন্য হলেও বাকহীন করে দেয়। তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। ১৯৬৫/৬৬ সালের দিকের ঘটনা। বাসার পাশে কলেজ হোস্টেলের সামনের মাঠে আমরা ক্রিকেট খেলতাম। সামনের রাস্তার পাশেই ছিল চাপকল অর্থাৎ টিউবওয়েল। খেলাধুলা করে তৃষ্ণার্ত হয়ে আমরা প্রাণভরে চাপকলের পানি পান করতাম। দারুণ স্বচ্ছ ও মিষ্টি পানি ছিল। আঁজলা ভরে লাগাতার পান করলেও যেন তৃষ্ণা মিটত না। গরমের ছুটিতে এক রৌদ্রকরোজ্জ্বল বিকেলে হোস্টেলের সামনের মাঠে আমরা পাড়ার ছেলেরা ক্রিকেট খেলছি। সময় তখন বেলা চারটার কাছাকাছি। আমি আর নূরল গিয়েছি চাপকলের পানি পান করতে। পানি পান করার সময় দেখি, বিছানার চাদর দিয়ে আচ্ছাদিত বেশ বড় সাইজের একটি পলো দুজনে বহন করে টিউবওয়েলের পাশেই রাখল। টের পেলাম পলোর ভেতর একজন মহিলা রোগী। নাকি সুরে কাঁদছে আর বলছে ‘বাছতাম না গো, ‘বাছতাম না গো, মনে হয় আর বাছতাম না।’

পলোর সঙ্গেই হাতে একটি বড়সড় গাট্টি নিয়ে দাঁড়ানো এক মধ্য বয়স্ক মহিলা। ওদের দেখে আমরা দুজন সরে দাঁড়ালাম। বেহেরা দুজন কলতলায় যেতে না যেতেই পলোর ভেতর থেকে মরণ চিৎকার, ‘মাই তুমি কই গো’!
‘আমারে বাঁচাও, আমারে বাঁচাও!’ মা পাশ থেকে এক দৌড়ে চাদরে ঢাকা পলোর ভেতর মুখ ঢুকিয়ে বলে উঠল, সর্বনাশ হয়ে গেছে, সর্বনাশ হয়ে গেছে, বাইচ্ছা দুনিয়াত আইচ্চন, বাইচ্ছা দুনিয়াত আইচ্চন! ও বেটা তোমরা জলদি করি হাসপাতালো যাও, ডাক্তর আনো ডাক্তর আনো, আমার ফুরিরে বাঁচাও, আমার ফুরিরে বাঁচাও! তখনো মেয়েটির আর্তনাদ আর চিৎকার, ‘আমি মরে যাব, আমি মরে যাব।’ চিৎকার শুনে খেলা রেখে সবাই এসে দূরে দাঁড়ানো। কেউ কাছে আসতে সাহস করছে না। হঠাৎ শুনি শিশুর ওঁয়াও ওঁয়াও কান্না আসছে চাদরে ঢাকা পলোর ভেতর থেকে। কান্নার রেশ ফুরাতে না ফুরাতে দেখি দুজন বেহেরা পুরুষের একজন হ্যাঁচকা টানে পলোর ভেতর মুখ ঢোকানো নারীকে বের করে সঙ্গীকে ধমক দিয়ে বলছে, ‘কিতা দেখছ বেটা হুরু ভাই! এক দৌড়ে চল, হাসপাতাল যাই!’
‘আমার বংশ বাছাইতো অইবো, আমার বউরে বাছাইতো অইবো। নিমেষেই দেখলাম, সদ্যভূমিষ্ঠ সন্তানের কান্নার সঙ্গে মায়ের বিলাপ ক্রমে ক্ষীণ হতে থাকল, দুজন তাগড়া জোয়ানের প্রায় ছুটে গেল তার কাছে। তাকে নিয়ে ছুটছে শহরের উত্তর প্রান্তে সুরমা নদীর পাড়ে মহকুমা জেলের পাশের লাল বিল্ডিংয়ের সদর হাসপাতালের দিকে।
চাপকলের পাশের সবুজ ঘাসের ওপর অনেকখানি জায়গা জুড়ে তখনো পড়ে আছে প্রচুর ছাপ ছাপ লাল রক্ত। এমনকি সবুজ ঘাস পেরিয়ে কংক্রিটের রাস্তায় উঠে গেছে তাজা লাল রক্তের অবিরাম ফোঁটা।
ক্রমশ চলে যাচ্ছে উত্তর দিকে। তখনো কানে ভেসে আসছে এক মায়ের আকুতি, আল্লাহ আমার মেয়েটিকে বাঁচাও, আমার মেয়েটিকে বাঁচাও।