সুজয় মাঝি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সন্ধ্যা হয়ে আসছে। প্রতিদিন আশুগঞ্জে সূর্য ওঠে নদীর ওপারে ভৈরবে গিয়ে ডুবে যায় আকাশটা লাল করে। লুঙ্গি কাছা দিয়ে দিয়ে নদীর পাড় থেকে ওরা একজন একজন করে ছিপ নৌকাটিতে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে আর নৌকাটি দুলছে ভীষণ। দুলুনি আরও বেড়ে যাচ্ছে ভারি বস্তাগুলো নৌকার গলুইয়ে বেমক্কা আছড়ে পড়ায়। সঙ্গে দুলে দুলে উঠছে ছোট্ট মেয়েটিও। বাবার নৌকার অন্য মাথায় চুপ করে বসে আছে সে। কোলে ধরা একটা খয়েরি রঙের ছাগলছানা। সে সারাক্ষণ সেটিকে কোলে ধরে থাকে।

‘আর না বাজান! আর উডাইয়েন না!’ সুজয় মাঝি আর্তনাদ করে।
‘চুপ!’ হিসহিসিয়ে ক্রুদ্ধ চেহারা করে ধমক দিল ওদের একজন। তারপর ধরাধরি করে টেনে টেনে আরও একটা বস্তা তুলল নৌকাটিতে। সুজয়ের কথায় কারও ভ্রুক্ষেপ নেই। ওদিকে নদীর জল আশকারা পেয়ে পেয়ে নৌকার ভেতর লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে এখানে ওখানে।

‘ও বাজান! এমুন ভারি হইছে নাও-তো আগাইব না। মালও ডুইব্যা যাইব, আফনেরাও ডুববেন! আর উডাইয়েন না!’
ছয়টা বস্তার সঙ্গে তিনজন উঠতেই নৌকার দু’পাশে জল এ-কান ও-কান হয়ে গেল। সুজয়ের চোখে মুখে উৎকণ্ঠা। ছোট্ট মেয়েটা নির্বিকার। সে আশ্চর্য দক্ষতায় অনায়াসে ভারসাম্য রক্ষা করে নির্বিকার মুখে ও-মাথায় বসে আছে। তার পেছনে সূর্যটা ধীরে ধীরে অস্ত যাচ্ছে।

সুজয় ইদানীং আর নৌকা ভাসায় না। মাঝির পেশা পৈতৃক সূত্রে পাওয়া। কিন্তু ফেরি আর ইঞ্জিনের নৌকা ছেড়ে তার নৌকায় আজকাল কেউ আর নদী পার হয় না। উপরন্তু ক’দিন ধরে গায়ের জ্বরটা ছাড়ছে না। মাঝনদীতে গেলে শীত শীত লাগে, শরীর কাঁপে! এই ভরা বর্ষায় হঠাৎ ঝোড়ো বাতাস আর শান্ত মেঘনার অশান্ত ঢেউয়ের তোড়ে নৌকা সামলানো আরও কঠিন হয়ে পড়ে। তবু নৌকা তাকে ভাসাতে হয়। পুলিশের ধাওয়া থেকে বাঁচতে ‘বেলেকের মাল’ নদীর ওপারে পৌঁছে দিতে তার ডাক পড়ে। তারা তাকে ডাকে কারণ সে বিশ্বস্ত। মেঘনার বুকে ছিপ নৌকা দেখলে পুলিশও তেমন সন্দেহ করে না। সুজয় এ কাজ ছেড়ে দিতে চেয়েছিল অনেকবার। কিন্তু ছেড়ে দিলে খাবে কী? এমনিতেই রুজি একেবারেই নেই বললেই চলে।

সরকারি উন্নয়নের ছোঁয়া রাস্তার শরীরে লেগেছে, ব্রিজের শরীরে লেগেছে, বড় রাস্তার পাশে উপজেলা চেয়ারম্যানের বাংলো বাড়িটিতে লেগেছে, লেগেছে দারোয়ানের পোশাক-আশাকেও। উন্নয়নের আঁচ পেয়েছে চোরাকারবারিরাও। রাস্তা কিছুটা ভালো হওয়ায় মালের বস্তা ঢাকার ট্রেনে উঠিয়ে দিতে এখন সময় কম লাগে। উন্নয়ন শুধু লাগেনি সুজয় মাঝির চৌদ্দ পুরুষের গতরে।
দাউদ মিয়া দু/একবার সুজয়কে বলেছে, ‘এই মালু, নাও থুইয়া আমাগো লগে ভিড়া যা! সোজা কাম! বর্ডারে বস্তা লামাবি। ট্যাকা পাবি নগদ। ধাওয়া দিলে দৌড়াবি তাইলে আর শইল্যে গুলি লাগব না!” বলে ক্রুঢ় হাসি হাসে।
‘তুই যেমুন কালা, টছ মাইরাও বিডিআর তরে খুইজ্জা পাইতো না।’ পাশ থেকে টিপ্পনির ঢঙে দাউদের কথায় সমর্থন যোগায় আরেকজন।
সুজয় একবার এ-কে দেখে আরেকবার ও-র দিকে তাকায়। ছোটলোকের জাত বলে কথা, ঘাটের মায়া ছাড়তে পারে না কিংবা নৌকাটির। হয়তো পেশাটির। কিংবা মেয়েটির। কে জানে! সুজয়ের কাছে সবকিছু গোলমেলে ঠেকে। ধীরে ধীরে মাথা নাড়ে, ‘এত দূরে বডারে যাইতাম না, দাউদ বাই।’

সুজয়ের নিজের বলতে এই মা-মরা মেয়েটি, এই নৌকাটি, আর সে নিজে। অন্যসময় কাজে এলে বৌদির কাছে মেয়েটিকে রেখে আসত। ক’দিন হলো বৌদি বাপের বাড়ি গেছে। এখন কাজের সময় মেয়েটি তার নিজের কাছেই থাকে।
ছাগলছানাটি কুড়িয়ে পাওয়া। সেদিন নদীর আসার পথে সেটি সুজয়ের মেয়েটিকে অনুসরণ করতে করতে লাফাতে লাফাতে অনেক দূর পর্যন্ত চলে এসেছিল। সুজয় চেয়েছিল সেটিকে ফিরিয়ে দিতে, কিন্তু মেয়েটি ভীষণ জেদি, কিছুতেই ওটিকে ফেরত যেতে দেবে না। ছাগলছানাটিকে নিজের কাছেই রেখে দিয়েছে।

ধোঁয়ায় ডিজেলের পোড়া গন্ধ ছড়িয়ে বিকট ধস্‌-ধস্‌ শব্দে যাওয়া-আসা করে ফেরিগুলো। নদীর পেটের ভেতর টিউমারের মতো ডুবো চর ঢেউয়ের আচ্ছাদন ভেদ করে ইতিউতি উঁকি দিচ্ছে। ফেরিচালকেরা রেল ব্রিজের পিলার আর ডুবোচরের মাঝে একটু গভীর বুঝে বেশ কায়দা করে ফেরিটিকে চালিয়ে নেয়। চাকার নিচে বড় বড় ইট দিয়ে ফেরি আরোহিত বাসগুলো আটকে দেওয়া, তারপরও দুলুনি থামে না। বাসের যাত্রীরা নেমে এসে ফেরির চারপাশে খোলা বাতাসে দাঁড়ায়। ওপারে সবার চোখ। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নদী দেখে, নৌকা দেখে, পান-সিগারেট খায়। ওদিকে বাসের ভেতরে আনাচে-কানাচে চলে পুলিশের তল্লাশি। পুলিশের সন্দেহের সতর্ক চোখ ফেরি আর ইঞ্জিনের নৌকায়। পুলিশের দৌরাত্ম্য ঘাটে ঘাটে। ফেনসিডিল, ইয়াবা, চিনি অথবা শাড়ি-কাপড় ধরলেই নগদ টাকা। গরু হলে তো কথাই নেই।

সীমান্তে কড়াকড়ি করলে এ পাড়ে জিনিসের দাম বেড়ে যায়। বেঁচে থাকার দায়ে চোরাকারবারিরা ভিন্ন পেশায় ঝুঁকে পড়ে। বেড়ে যায় বাড়িঘরে চুরি-ডাকাতি, মহাসড়কে রাহাজানি। আবার সীমান্তে ‘ঢিলা দিলে’ দাউদ মিয়ারা চুরি-ডাকাতি ছেড়ে বর্ডারে মালের জন্য ওত পেতে থাকে। তখন বিদেশি পণ্যে বাজার সয়লাব হয়ে এপারের ব্যবসায়ীর মাথায় হাত, কৃষকের পেটে লাথি। তাতে কী! তখন আবার অভ্যন্তরের পুলিশের পোয়াবারো। ধর-পাকড় আর চাঁদাবাজিতে চলে বাড়তি আয়ের মহোৎসব।

এই বর্ষায় সীমান্ত আলগা। তাই গত দুই সপ্তাহে সুজয়ের ডাক পড়েছে। এবার অনেক বড় চালান। মালগুলো ওপারে পৌঁছে দিতে হবে সন্ধ্যার আগে। দাউদ মিয়ারা সেগুলো ভৈরবে নিয়ে গিয়ে আন্তঃনগর ট্রেনে বা ‘লসুন্দি’র বাসে তুলে দেবে। অনেক টাকার ‘মাল’। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে বস্তাগুলো ফেরিঘাট থেকে নিরাপদ দূরত্বে ব্রিজের নিচে নির্জন জায়গায় আনা হয়েছে। এ পর্যন্ত আনতে তাদের জান খারাপ হয়ে গেছে। সুজয় তার নৌকা ভেড়াতেই মাল ওঠানো আরম্ভ হয়েছে। কিন্তু দেরিটা পোষানোর চিন্তায় দাউদ মিয়ার কপালে ভাঁজ পড়েছে, রাত জাগা রক্তজবা লাল চোখগুলো এখন আরও বেশি রক্তবর্ণ! সে ডাকাতির দায়ে জেল খেটেছে আবার খুনের মামলারও আসামি। চোরাকারবারি পেশাটির প্রতি তার বিশ্বস্ততা এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় নিষ্ঠুরতার কথা এই মহলের সবার জানা।

‘অইছে অইছে... নাও ভাসা! আর দিরং করলে টেরিন ফাইতাম না।’-দাউদ মিয়া সাপের মতো হিসহিসিয়ে ওঠে। ’ওই জাকির, তুই হেই মাথাত বইয়া বইডা মার’ বলেই একটা বইঠা তুলে ছুঁড়ে দেয়।
জাকির বৈঠাটি শূন্যেই ধরে ফেলে। সুজয়ের মেয়েটির সামনে গিয়ে বলে, ‘ওই ছেড়ি, সর্‌!’
মেয়েটি সরে না। নির্বিকার তাকিয়ে থাকে।
ঝোড়ো বাতাস শুরু হয়েছে আবার। সুজয়ের শীত শীত লাগে। সে নরম স্বরে বলে, ‘স্মৃতি মা, তুই নাওয়ের মইধ্যে আয়।’

মেয়েটি বাবার কথায়ও নড়ে না। বরাবর নৌকার এই মাথাটিতেই সে বসে, এটিই তার জায়গা। সুজয় এবার কাছে গিয়ে হাত ধরে টানল। কাজ হলো না।
দাউদ অধৈর্য হয়ে চেঁচিয়ে উঠল, “এই সুজয়, নাও ভাসা! লগি ঠেল্‌। ওই জাকির বইডা লইয়া ব’। না সরলে ছেরিডারে লাত্থি মাইরা পানিত ফালা।”
সুজয়ের বুক কেঁপে উঠল। এই নির্জন জায়গায় তারা যা ইচ্ছা করতে পারে। চোরাচালানের কাজে দরকার পশুপ্রবৃত্তি আর অন্ধ প্রশ্নহীন তাৎক্ষণিক আনুগত্য। জাকির যেকোনো সময় লাথি মেরে তার মেয়েটিকে জলে ফেলে দেবে, একটুও বাধবে না। নৌকার গতি বাড়াতে তারা যা ইচ্ছা করতে পারে। এই অবস্থায় এদের সঙ্গে ডুবো ডুবো নৌকায় মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে নদী পার হওয়ার কথা ভেবে সুজয়ের ভেতর থেকে বাধা এল!
সে মেয়েটিকে একপ্রকার জোর করে কোলে তুলে নিল। তাকে নিয়ে নৌকা থেকে নেমে বালিতে দাঁড় করিয়ে বলল, “স্মৃতি মা, আমি হেই পার থিকা অহনই আইয়া পড়মু। তুই এইহানে একটু খাড়াইয়া থাক, মা। লড়িস না কইলাম। এইহানেই থাহিস।”

মেয়েটি শূন্য দৃষ্টিতে বাপের চেহারার দিকে তাকিয়ে রইল। চোখেমুখে বোবা অবিশ্বাস! দাঁড়িয়ে রইল সেখানেই। একটুও নড়ল না। বাপ আগে কখনোই তাকে এভাবে নৌকা থেকে নামায়নি।
নৌকা ভাসাল সুজয়।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। এই মাথায় সুজয় আর ওই মাথায় জাকির। দাউদ আর অপরজন সতর্ক চোখে নদীর বুকে ভাসমান ইঞ্জিন নৌকাগুলোর দিকে চোখ রাখে। অনেক সময় আনসাররা ইঞ্জিনের নৌকায় টহল দেয়।
দূরে যেতে যেতে বইঠা মারার ফাঁকে ফাঁকে সুজয় ঘুরে ঘুরে মেয়েটিকে দেখে আর এক হাত তুলে আশ্বস্ত করার ভঙ্গি করে। মেয়েটি ওখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। সুজয়ের বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে, চোখ ভিজে ওঠে, নদীর বাতাসে দ্রুত শুকিয়েও যায়। সারাক্ষণ মেয়েটা বাপের সঙ্গে লেপ্টে থাকে। এই প্রথম তাকে ঘাটে ফেলে রেখে এসেছে সে।

সুজয়ের বইঠা থামতে দেখে দাউদ তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল! “এই শুয়োরের বাচ্চা! বইডা মারা থামাস ক্যান? এহন ইতরামি দেহানির সময়? লাত্থি মাইরা গাঙ্গে ফালাইয়া দিমু চুৎমারানির পোলা!”
সুজয় আবার জোড়ে হাত চালায়। শরীরটা কাঁপছে। কেমন অসার হয়ে আসছে হাত দুটো। কিন্তু তাড়াতাড়ি ওপারে গেলেই না তাড়াতাড়ি ফিরবে।

নদীর জল নৌকার ভেতর উপচে পড়ছে। নিচ দিয়েও চুঁইয়ে জল ঢুকছে। একটা ভাঙা টিনের থালা দিয়ে একবার দাউদ আরেকবার অপরজন দ্রুত হাতে জল সেচতে লাগল। জলে ভিজে যাচ্ছে বস্তাগুলোও। দাউদ বারবার গতি বাড়ানোর তাগাদা দেয়, কিন্তু গতি বাড়ালে নৌকায় আরও বেশি করে জল ঢুকে পড়ে। বড় বড় ঢেউ আর প্রচণ্ড বাতাসে কাগজের নৌকার মতো মাঝনদীতে দুলছে নৌকাটি, সঙ্গে ওরা সবাই।
নৌকা মাঝ নদী পার হতেই বড় বড় ঢেউ তুলে একটা ফেরি খুব কাছে চলে এল। ঢেউয়ের ধাক্কা সামলাতে নৌকাটিকে দূরে সরিয়ে নিয়ে আসতে হলো। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো দাউদের আরেক দফা খিস্তি-গালাগালি। কণ্ঠে গভীর উৎকণ্ঠার রোষ! দেরি হয়ে যাচ্ছে।

অন্ধকার গাঢ় হয়ে এসেছে দু’পারে। নদীর বুকে নানা জায়গায় তারার মতো অনেকগুলো আলোর বাতি জোনাকির মতো নাচছে।
এবার পেছনে তাকিয়ে মেয়েটিকে হঠাৎ আর দেখতে পেল না সুজয়। বুকটা ধক্‌ করে উঠল অজানা আশঙ্কায়। ওখানেই তো ছিল! বইঠা ফেলে উদ্‌ভ্রান্তের মতো পেছনে ঘুরে খুঁজল আধো-অন্ধকার ভেদ করে দৃষ্টি যত দূর যায়। কিন্তু কোথাও দেখা যাচ্ছে না।
সুজয় দাউদ মিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি আর যাইতাম না।’ এই কণ্ঠস্বর তার নিজের কানেও অচেনা ঠেকে।
‘আর যাইতি না মানে?’ দাউদের কণ্ঠে বিস্ময়!

সুজয় ডুকরে কেঁদে উঠল। ‘আমি যে মাইয়াডারে আরে দেহি না দাউদ বাই! আমি আর যাইতাম না। নাও ঘুরামু।’
‘কুত্তার বাচ্চা কয় কী! হালারে মাইরা নদীতে ফালাইয়া দিমু’, বলেই বর্ষার মতো দেখতে তীক্ষ্ণ লোহার শিক বের করে দাউদ। ওই মাথায় বসা জাকিরও বইঠা পাশে রেখে অদৃশ্য ইশারায় উঠে দাঁড়াল।
সুজয় যন্ত্রের মতো বিড়বিড় করছে ‘আমি আর যাইতাম না। আমার মাইয়াডা বুবা। আমি আর যাইতাম না! আমার নাও আমিই ডুবামু!’
মাঝনদীতে নৌকাটি ডুবিয়ে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল সুজয়। অন্ধকারে উল্টোদিকে ক্লান্ত হাতে সাঁতরাতে শুরু করল।