আমাদের শচীন দেব বর্মণ

শচীন দেব বর্মণ
শচীন দেব বর্মণ

তৎকালীন পূর্ববঙ্গ আর আজকের বাংলাদেশের পূর্ব প্রান্তে সুর ও সংগীতের অমর কিছু দিকপাল জন্ম নিয়েছেন। তাঁরা দাপটের সঙ্গে রাজত্ব করে গেছেন উপমহাদেশের শাস্ত্রীয় সংগীত, চলচ্চিত্র সংগীতসহ সংগীতের নানা ক্ষেত্রে। যেখানে বাকি সবাই বিভিন্ন ধারাকে ধারণ করে চলেন, সেখানে তাঁরা নিজেরাই জন্ম দিয়েছেন কিছু অনন্য ধারার। প্রথমেই নাম করতে হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সন্তান উপমহাদেশের মহান সুরসম্রাট ওস্তাদ ‘বাবা’ আলাউদ্দিন খাঁর। বলা চলে, তিনি জন্ম দেন ‘মইহার সেনিয়া’ নামের এক উর্বর ধারার। সে স্রোত বেয়ে উন্মেষ ঘটে বিশ্বদরবারে সুপরিচিত সুর আর সংগীতের বহু রথী-মহারথীর। আলাউদ্দিন খাঁর শিষ্য বিশ্বখ্যাত সেতার বাদক পণ্ডিত রবিশঙ্কর, সরোদ বাদক ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ, সুরবাহারের অন্নপূর্ণা দেবী, বাঁশির পণ্ডিত পান্নালাল ঘোষ, সরোদের ওস্তাদ আশীষ খাঁ। আবার সদ্যপ্রয়াত অন্নপূর্ণা দেবীর শিষ্য বাঁশির পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া, সেতারের নিখিল ব্যানার্জি প্রমুখ। ওদিকে রবিশঙ্করের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন বিটলস ব্যান্ডের জর্জ হ্যারিসন। রবিশঙ্করের কন্যা সংগীতজ্ঞ সেতারশিল্পী আনুষ্কা শংকর এখন বিশ্বে স্বনামে পরিচিত। এমনি তালিকা করে শেষ করা কঠিন। এই উর্বর ধারাটি এখনো চলমান।
আলাউদ্দিন খাঁর অন্যতম শিষ্য ছিলেন কুমিল্লার কৃতি সন্তান শচীন দেব বর্মণ। তিনি ভারতীয় উপমহাদেশের এক প্রবাদপ্রতীম সুর স্রষ্টা ও সংগীত পরিচালক। তিনি তৈরি করে গেছেন বহু কালোত্তীর্ণ সুর আর খ্যাতিমান করেছেন অনেক গায়ক-গায়িকাকে। শচীন দেবের কুমিল্লায় জন্ম, বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা কুমিল্লা জিলা স্কুল হয়ে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। তারপর বহু উপেক্ষা আর অবহেলার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে এক সময় তিনি বোম্বের চলচ্চিত্র জগতে নিজের স্থান তৈরি করে নেন, যা পরবর্তীতে আক্ষরিক অর্থেই বিস্তৃত হয় স্থায়ী এক ‘রাজত্বে’। ত্রিপুরা রাজপরিবারের উত্তরাধিকারী শচীন কর্তা আরাম-আয়েশের হাতছানি ছেড়ে কঠোর সংগীত সাধনার পথ বেছে নেন, ছোটকাল থেকেই খুব সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেলামেশার মাধ্যমে যার শুরু। লোকগানের খোঁজে তিনি গ্রাম-গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছেন। তাঁর অনুপম সৃষ্টি হিন্দি ও বাংলা গানগুলো আমাদের ঐতিহ্যবাহী ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, সারি, মুর্শিদি, বাউল, ঝুমুর গানের ভিত্তির ওপর রচিত হয়—
‘কই গেল সেই গাঁয়ের মাটি, কই সে মায়ের কোল
কই সে হাসি, কই সে খেলা, কই সে বুনোরোল
ওই না পাড়ে ঢোল বাজে রে, এই পাড়ে তার সাড়া
মাঝখানে বয় থই থই থই নয়ন জলের ধারা’
সংগীত এক মহাসমুদ্র, যিনি ভালোবেসে এতে অবগাহন করেন তিনি এতে ডুবেই থাকেন। সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি-সা শুধু এই সাতটি স্বরের ৫,০৪০ টি প্যাটার্ন হয়—যাকে ভেঙে ভেঙে নানান তালের সংমিশ্রণে অসংখ্য সুরবিন্যাস সুরবৈচিত্র্য সৃষ্টি করা সম্ভব। শচীন দেব বর্মণ নিজস্ব এক অপূর্ব সংগীত জগৎ তৈরি করেছিলেন, যার মূল উপাদান হচ্ছে উচ্চাঙ্গসংগীত ও আমাদের বাংলা লোকগীতির এক অপূর্ব সংমিশ্রণ। ‘সুন মেরে বন্ধু রে, সুন মেরে মিতওয়া...’ শুনে কারও বুঝতে এক মুহূর্তও লাগে না—এ সুরে কোন মাটির গন্ধ লেগে আছে। ১৯৪৫ সাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রায় তিন দশক ধরে শতাধিক সিনেমাতে সুর ও সংগীত পরিচালনা করেন শচীন ‘কর্তা’। লতা মঙ্গেশকর, মুহম্মদ রফি, কিশোর কুমার, হেমন্ত মুখার্জি, মান্না দে, গীতা দত্ত, আশা ভোসলেসহ আরও অনেকে তাঁদের পরম শ্রদ্ধার ‘দাদা বর্মণ’–এর সুরে গান গাইতে পারলে নিজেদের ধন্য মনে করতেন। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা পেয়েছি অসামান্য কিছু সুর আর অমর কিছু গান, যার প্রিয় তালিকা করতে যাওয়া খুব কঠিন কাজ, কোনটি ছেড়ে কোনটি নেব তা মনস্থির করা যায় না।
ভারতীয় সিনে-সংগীতের ‘ভগবান’ খ্যাত রাহুল দেব বর্মণ তাঁর একমাত্র সন্তান। শচীন কর্তার স্ত্রী মীরা বর্মণ বিখ্যাত বহু গানের গীতিকার। নিজের কাজ আর দেশ ভাগ শচীন দেব বর্মণকে বাংলাদেশ থেকে শারীরিকভাবে বিচ্ছিন্ন করলেও কুমিল্লা তথা বাংলাদেশকেই নিজের সংগীতের সূতিকাগার হিসেবে নিজ মনে আজীবন লালন করে গেছেন। তিনি গেয়েছেন—
‘সেই যে দিনগুলি
বাঁশি বাজানোর দিনগুলি
ভাটিয়ালির দিনগুলি
বাউলের দিনগুলি
আজও তারা পিছু ডাকে
কূল ভাঙা গাঙের বাঁকে
তাল সুপারির ফাঁকে ফাঁকে
পিছু ডাকে-পিছু ডাকে...’
শচীন কর্তা জীবদ্দশায়ে বাংলাদেশকে না ভুললেও আমরা অনেকেই তাঁর ‘বাংলাদেশের সন্তান’ পরিচয় ভুলে গেছি। কুমিল্লায় শচীন দেব বর্মণের পৈতৃক ভিটা বহু কালের, বহু ইতিহাসের সাক্ষী। সেটি রক্ষণাবেক্ষণ করা আমাদের দায়িত্ব। কিছুকাল আগে যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলীর একটি লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি—‘পাকিস্তান আমলে তাঁর (শচীন দেব বর্মণ) প্রাসাদসম বাড়িটি পরিত্যক্ত ঘোষিত হয় এবং তা মিলিটারি গুদাম হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বাংলাদেশ আমলে প্রথমে পশু চিকিৎসা কেন্দ্র হিসেবে এবং বর্তমানে হাঁস-মুরগির খামার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। দিঘি দুটিতে মাছের চাষ হচ্ছে। শচীন দেবের আদি রাজপ্রাসাদটিকে খামারের সরকারি ভবনটি প্রায় ঢেকে ফেলেছে। সেই ভবনটির পেছন দিক দিয়ে অতি কষ্টে ঢুকে এক জরাজীর্ণ প্রাসাদসম বাড়ির ভগ্নাংশের সামনে দাঁড়াই। মনে হচ্ছিল যুগ-যুগের অবহেলা ও অযত্নে বাড়িটি যেকোনো মুহূর্তে ভেঙে পড়বে। ভবনটির বুকে পাথরের শিলালিপিতে লেখা আছে তাঁর গৌরবময় নাম ও পরিচয়। লেখা আছে কবে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এখানে এসেছিলেন ও গান গেয়েছিলেন শচীন দেবের সঙ্গে। সারা দালানটি ঘিরে রেখেছে জঙ্গল ও হাঁটু সমান উঁচু উঁচু ঘাস। আমাদের জাতীয় দৈন্য ও উদাসীনতা দেখে রাগে-দুঃখে চোখে পানি আসছিল। সারা কুমিল্লা শহরে কি হাঁস-মুরগি ও মাছের খামারের জন্য আর কোনো জায়গা ছিল না? এ প্রাসাদসম অট্টালিকা কি সারানো যায় না? এটাকে শচীন দেবের স্মৃতিভবন হিসেবে গড়া যায় না? শুধু এই ভবনটিকে পুঁজি করে কুমিল্লাকে গড়া যেত উপমহাদেশের এক বিখ্যাত সংগীত কেন্দ্র ও প্রদর্শনশালা হিসেবে। মুম্বাই ও কলকাতার সিনেমা জগতের দিকপালরা আসতেন তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে। প্রতিবছর ১ অক্টোবর তাঁর জন্মদিনে লোকগানের এক আন্তর্জাতিক জলসা বসানো যেত এখানে। সেই রাতে কুমিল্লায় ভালো ঘুম হয়নি। বারবার মনে হয়েছে, আমাদের জাতীয় দৈন্য ও উদাসীনতা কি এতটাই অপরিমেয়? নিজেদের ঐতিহ্য ধরে রাখতে আমরা কি এতটাই অক্ষম? সরকার ও কুমিল্লাবাসীর কাছে আমার আকুল আবেদন, এই ঐতিহ্যবাহী ভবনটি রক্ষা করতে এগিয়ে আসুন এবং গড়ে তুলুন শচীন স্মৃতি সংগীতভবন আমাদের উত্তরসূরিদের জন্য। সেটাই হবে আমাদের সুযোগ্য সন্তান শচীন দেবের প্রতি আমাদের যোগ্য সম্মান।’
গত ৩১ অক্টোবর ছিল শচীন দেব বর্মণের প্রয়াণ দিবস। তাঁর গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতির প্রতি জানাই পরম শ্রদ্ধা।
‘কই সে হাসি, কই সে খেলা, কই সে বুনোরোল
আমি সব ভুলে যাই, তাও ভুলি না বাংলা মায়ের কোল...’