কপোতাক্ষ এক্সপ্রেস

রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশন। ছাত্র-জনতার উপচে পড়া ভিড়। গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবিরের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ বাঁধে। ছাত্র শিক্ষকসহ আহত হয়েছে পনেরো-বিশজন । তাদের এ সংঘর্ষের কারণে গোটা মতিহার চত্বর রণক্ষেত্রে রূপ নেয় । পরিস্থিতি সামাল দিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হলগুলো খালি করার নির্দেশ দিয়েছে। হঠাৎ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ঘটনা ঘটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যে যার বাড়ি ফেরার জন্য এসে ভিড় জমিয়েছে স্টেশনে। এই স্টেশন থেকে প্রতিদিন লোকাল ও দূরপাল্লার বেশ কয়েকটি ট্রেন যাতায়াত করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। ঘড়ির কাটায় বেলা ঠিক সাড়ে দশটা। খুলনাগামী কপোতাক্ষ এক্সপ্রেস ট্রেনটি ছাড়ার ঘণ্টা বেজে গেছে, ট্রেনের গার্ড সাহেবও তাঁর হাতে রাখা সবুজ পতাকাটি উড়িয়ে বাঁশিতে ফু দিয়েছেন। ট্রেনটি টার্ন নিবে ঠিক এমন সময় ঘাড়ে একটা স্কুল ব্যাগ নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে এক যুবক ট্রেনে লাফিয়ে উঠল। দৌড়ে সে হাঁপিয়ে গেছে, বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে কপালে । পকেট থেকে একটি রুমাল বের করে তা মুছতে মুছতে নিজ মনে বলল, থ্যাংকস গড, আর একটু লেট হলেই মিস করতাম ট্রেনটি ।
বগিতে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। প্রতিটি সিটই পূর্ণ। দাঁড়িয়ে আছে বহু যাত্রী। যুবকটি পকেট থেকে সিট নম্বর মিলিয়ে দেখে তার সিটে এক বয়স্ক লোক বসে আছেন। সে যে সিট নম্বর মিলাচ্ছে লোকটিও তা লক্ষ করছিলেন। তিনি বললেন, ‘এটা বাবাজির সিট ? আমি জয়পুরহাট যাব। খালি পেয়ে বসে পড়েছি। সামনে ঈশ্বরদী জংশন । সেখান থেকে জয়পুরহাটের কানেকশন ট্রেন । আসুন আমি সিট ছেড়ে দিচ্ছি।’
না, না । আপনি বসুন। আপনি ঈশ্বরদী নেমে গেলে না হয় বসা যাবে । ততক্ষণ আমি দাঁড়িয়ে যেতে পারব। কোনো অসুবিধা হবে না বলল, যুবকটি।
ওই সিটেরই সামনাসামনি সিটে এক তরুণী বসে একটা ম্যাগাজিনের পাতা উল্টাচ্ছিলেন। ভার্সিটির ছাত্রীই মনে হলো। যুবকটি ও বয়স্ক ভদ্রলোকের কথোপকথন শুনে সে তাদের দিকে একবার চোখ তুলে তাকিয়ে আবার চোখ রাখল ম্যাগাজিনের পাতায়।
ঈশ্বরদী জংশনে ট্রেন পৌঁছালে ভদ্রলোক যুবকটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে নেমে গেল। সে তার সিটে গিয়ে বসে পড়ল। এবার তরুণিটি একটু শঙ্কিত বোধকরে স্বীয় শরীর পর্যবেক্ষণ করে গায়ের ওড়নাটা এদিক-সেদিক টেনে টুনে নড়ে চড়ে বসল। ট্রেন আবার তার গন্তব্যে যাত্রা করল। পাকশী পার হয়ে পদ্মার ওপর দিয়ে যখন হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পার হচ্ছিল দু‘জনই তখন জানালা দিয়ে ঝুঁকে পদ্মার দৃশ্য দেখছিল। প্রমত্তা পদ্মা অভিশপ্ত ফারাক্কা বাঁধের কারণে সে তার যৌবন হারিয়ে এখন বার্ধক্যে এসে পৌঁছেছে। যত দূর চোখ যায় দেখা যাচ্ছিল শুধু ধু ধু বালুচর। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ থেকে খানিকটা দূরে আবছা আবছা আরও একটি ব্রিজ দেখা যাচ্ছিল সেটা হলো লালন শাহ ব্রিজ।
ঠিক এ সময়ে যুবকটির একটি পা তরুণীর পায়ে ধাক্কা লেগে যায়। ‘আই অ্যাম সরি বলে সে পা গুছিয়ে নিল।’ তরুণিটিও লজ্জা পেয়ে জবাব দিল, ‘দ্যাটস অল রাইট ।’ পরে জিজ্ঞেস করল, আপনি কোথায় যাবেন?
খুলনা। সে উত্তর দিল।
আপনি ?
আমিও।
আপনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন বুঝি?
জি হ্যাঁ।
কোনো ইয়ারে ?
ফাস্ট ইয়ারে ।
আমিও গণসংযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে থার্ড ইয়ারে।
আপনাদের বাড়ি কি খুলনায় ?
জি, হ্যাঁ, সোনাডাঙ্গা।
ও আচ্ছা, আমাদের মুন্সিপাড়া।
যাক ভালোই হলো, দুজন যখন একই শহরের বাসিন্দা আর যাচ্ছিও একই গন্তব্যে বেশ গল্প করতে করতে সময় চলে যাবে।
আপনার নামটা জানি কী বললেন?
আমার নাম, লায়লা।
আমি আবদুর রাজ্জাক। বন্ধু বান্ধবীরা রাজু নামে ডাকে।
ও আচ্ছা।
এমন সময় যাত্রীদের ভিড় ঢেলে ফেরিওয়ালা হেঁকে যাচ্ছিল, বাদাম , বাদাম। বাদাম নেবেন মচমচ মজাদার চিনা বাদাম।
রাজু জিজ্ঞেস করল, মিস লায়লা বাদাম খাবেন নাকি ?
না, আপনি খান।
আমি একা খাই কী করে?
রাজু বাদামওয়ালাকে ডেকে দুই ঠোঙা বাদাম নিল। একটি নিজে নিল, আরেকটি লায়লাকে দিল।
আপনি বাদাম কিনতে গেলেন কেন। বললাম তো আমি খাব না, আপনি খান।
না, ঠিক আছে। অনেক দূরের রাস্তা যেতে হবে। আপনি না হয় পরে অন্য কিছু কিনবেন।
মুচকি হেসে সে বলল, আচ্ছা । আমি আপনার অনেক ছোট, আপনি নয় তুমি বলবেন।
ওকে, রাজু জবাব দিল।
রাজু বাদামওয়ালার মূল্য পরিশোধ করে দিলে সে চলে যাচ্ছিল।
লায়লা তাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, এই বাদামওয়ালা তোমার কাছে ঝাল লবণ আছে?
আছে আপা। দিমু?
দাও তো একটু ।
রাজুর দিকে তাকিয়ে সে জিজ্ঞেস করল, আপনাকেও দিমু স্যার?
দাও ।
সে দুজনকে দুই পুড়িয়া ঝাল লবণ দিয়ে চলে গেল।
কেমন লাগছে ভার্সিটি জীবন? রাজু জিজ্ঞেস করল লায়লাকে।
না, খুব একটা খারাপ না। তবে, হঠাৎ করে এই ভাবে হল ত্যাগ করতে যে বিড়ম্বনা মোকাবিলা করতে হয় তা এই প্রথম। এ পরিবেশ সামাল দিতে বেশ বেগ পেতেই হয়েছে। তবুও খারাপ না।
ভার্সিটিতে এ রকম প্রায়ই ঘটে। গত তিন বছর ধরে আমি ভুক্তভোগী। বিশ্ববিদ্যালয় হলো শিক্ষার শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান। এ কথা এখন শুধু বই-পুস্তকের পাতায় পাতায়, বাস্তবে এর কোনো দেখা-সাক্ষাৎ নেই। ছাত্র রাজনীতিই শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশকে কলুষিত করে রেখেছে।
আমি ছাত্র রাজনীতি একদম পছন্দ করি না। শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করে দেওয়া উচিত, লায়লা বলল।
আমিও ছাত্র রাজনীতি বন্ধের পক্ষে। বললেই কি ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা যায়। আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা যখন ক্ষমতার বাইরে থাকেন তখন ছাত্র রাজনীতি বন্ধের পক্ষে কথা বলেন, আর যখন তারা ক্ষমতার মসনদে বসেন তখন বেমালুম ভুলে যান। আসলে তাঁরা চান না যে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ হোক। ছাত্রদের রাজনীতির মাঠে নামিয়ে তাঁরাই তো ফায়দা লোটেন। দেখা গেছে ছাত্রদের রাজনীতিতে প্রায়ই দাঙ্গা বাঁধে, আর সে কারণেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। লেখাপড়া আটকে পড়ে। এভাবেই সেশনজট বেঁধে যায়। দুই বছরের কোর্স শেষ হতে পাঁচ বছর লেগে যায়। আমাদের দেশের ধুরন্ধর রাজনীতিবিদরা তাঁদের সন্তানদের কিন্তু দেশে লেখা পড়ে করান না। করান বিদেশে। আর সে সব সোনার টুকরো সন্তানেরা বিদেশের মাটিতে গিয়ে সেখানে বিয়ে থা করে কেউ কেউ ফিরে আসে, কেউ কেউ আসে না। যারা ফিরে আসে তারা আবার পিতা মাতার প্রভাব খাটায় দেশেরই ছাত্রসমাজের ওপর। আমাদের মতো গরিব শিক্ষার্থীরা যাদের বিদেশে লেখাপড়া করার সামর্থ্য নেই তাদের সেশন জটের জাঁতাকলে ঘুরতে ঘুরতে জীবন বিসর্জন দিতে হয়। দুই বছরের কোর্স পাঁচ বছরে শেষ করেও চাকরি-বাকরি পায় না। বুঝলে, এই হলো আমাদের দেশের অবস্থা। এ দেশ থেকে ছাত্র রাজনীতি কখনো বন্ধ হবে না, এবং রাজনীতিবিদরা তা করবেনও না।
অনুগত ছাত্রীর মতো গভীর মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনছিল লায়লা। আর মাথা নেড়ে নেড়ে হু হু করছিল।
ট্রেনটি মোবারকগঞ্জ স্টেশনে এসে থামল । সেখানে অনেক যাত্রী নেমে গেল, আবার নতুন যাত্রীও যোগ দিল তাদের সঙ্গে। বাইরে সেই একই কোলাহল, হই-হুল্লা হকারের ডাক।
রাজু লায়লাকে জিজ্ঞেস করল কিছু খাবে নাকি?
সে জবাব দিল, না।
লায়লা বরাবরই চাপা স্বভাবের মেয়ে, সরাসরি কখনো হ্যাঁ বলে না।
ফ্রেশ ডাব পাওয়া যাচ্ছে। খাবে ?
তাহলে মন্দ না।
হকার ডেকে দুজনে দুটি ডাব খেল।
এখানে একটি সুগার মিল আছে তাই না রাজু ভাই? লায়লা জিজ্ঞেস করল রাজুকে ।
হ্যাঁ। ট্রেনটি ছেড়ে গেলে সামনে ট্রেনে বসেই মিল দেখা যাবে।
খুলনা পৌঁছতে আর কতক্ষণ লাগবে?
না, আর বেশি না। সামনে যশোর এর পর পরই খুলনা। এক্সপ্রেস ট্রেন সব স্টেশন তো আর ধরবে না।
ট্রেন খুলনা পৌঁছালে বাংকার থেকে লাগেজ নামাতে নামাতে লায়লা বলল, ‘রাজু ভাই, আপনার মোবাইল ফোন নম্বরটা দেবেন? ভার্সিটি কবে কখন খোলে আপনাকে ডায়াল অথবা এসএমএস করে জেনে নিব।’
এ সময়ে রাজু তার লাগেজটা বাংকার থেকে নিচে নামাচ্ছিল। সে বলল, ‘আচ্ছা দাঁড়াও, আমার লাগেজটা নামিয়ে নেই। ট্রেন তো স্টেশনে কেবল ঢুকেছে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াক আমি এর একটা ব্যবস্থা করছি।’
রাজু লাগেজটা নামিয়ে সিটের ওপর রাখল। কোমরের বেল্টের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা মোবাইল ফোনটা খুলতে খুলতে বলল, ‘তোমার নম্বরটা বলো আমি ডায়াল করি তাহলে, একই ঢিলে দুই পাখি মারা হয়ে যাবে।’
সে কেমন? লায়লা জিজ্ঞেস করল।
আমি যদি আমার মোবাইল ফোন থেকে তোমার নম্বরে ডায়াল করি তাহলে আমি তো তোমার নম্বর পাচ্ছিই সঙ্গে সঙ্গে তুমিও পাচ্ছ আমার নম্বরটা। এই হলো একই ঢিলে দুই পাখি মারা।
ও আচ্ছা, বলে লায়লা খিলখিলিয়ে হেসে উঠল।
রাজু লায়লার মোবাইল ফোনে ডায়াল করল। একে অপরের নম্বর যে যার মোবাইল ফোনে সেভ করে রাখল।
যাত্রীদের পদচারণায় স্টেশন মুখরিত হয়ে উঠল। ট্রেনের পাশ দিয়ে কুলিমজুরেরা হেঁকে যাচ্ছে, কুলি, কুলি লাগবে কুলি? আবার যার কুলির প্রয়োজন আছে সে সব যাত্রী ডাকছে, কুলি এই কুলি । দশ-বারো বছরের একটি ছেলে এসে লায়লাকে জিজ্ঞেস করল ;
আপনার কুলি লাগবে আপা ?
সে উত্তর দিল, না, লাগবে না।
ছেলেটা রাজুর দিকে তাকিয়ে, আপনার স্যার?
রাজুও জবাব দিল, ‘না;।
সে দ্রুত অন্য বগিতে ছুটে গেল।
ছেলেটা স্থান ত্যাগ করলে লায়লা তার দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবল, এই বয়সে তার স্কুলে পড়ার কথা। তা না করে সে রুজি রোজগারের পথে নেমেছে। নিশ্চয় ওর বাবা নেই , থাকলেও সে অসুস্থ । মাও হয়তো কারও বাসা-বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করেন। গুটিক কয়েক ভাইবোন তাদের আহার জোগাতে সে এ পথে নামতে বাধ্য হয়েছে। কি সেলুকাস আমাদের এ সমাজ।
এমন সময় রাজু ডাক দিল, কি তুমি যে এখনো দাঁড়িয়ে রইলে? ট্রেন স্টেশনে পৌঁছে গেছে, সব প্যাসেঞ্জার নেমে যাচ্ছে, তুমি নামবে না ?
রাজুর ডাকে লায়লার সংবিৎ ফিরে এল, সে জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, নামব তো।’
তাহলে আস। অপেক্ষা কেন?
রাজু ও লায়লা ট্রেন থেকে নেমে পড়ল। স্টেশনের বাইরে অপেক্ষমাণ রিকশা থেকে দুজনে দুটি রিকশা ভাড়া করে যে যার বাড়ির দিকে রওয়ানা দিল।

আটলান্টা