স্বপ্নের দেশে মুক্ত বাতাসে

ছোট্ট চিলেকোঠায় রাখা হলো আসাদকে। রক্তলাল রং চারিদিকে। মধ্যখানে ছোট টুলে তার বসার ব্যবস্থা। সিলিঙে ২৫ পাওয়ার বাতি টিমটিম করে জ্বলছে। বাতিটি নিবে গেলে কবরের অন্ধকার এসে গ্রাস করবে তাকে। এ যেন ফাঁসির আসামির জন্য তৈরি সেলের গা ছমছম করা নির্জনতা, মাথার চুলের ফাঁকে যেন গরম লু হাওয়া প্রবাহিত হচ্ছে। মনে হচ্ছে কোন এক মুড়ি ফেরিওয়ালা গরম বালি ঢেলে মুড়ি ভাজছে তার মাথার ওপরে; শরীরের সব রক্ত যেন হিম হয়ে যাচ্ছে। অজানা শঙ্কা আর ভয়ে বুক শুকিয়ে যাচ্ছে। বারবার সে চিৎকার করে বলছে, ওয়াটার এক গ্লাস ওয়াটার, কিছুক্ষণের মধ্যেই একজন হিন্দি ভাষী অফিসার করাক করে দরজা খুলে তাকে রুম থেকে বের করে নিয়ে এল; তারপর গ্লাস ভরা জল দেখিয়ে বলল, আমার প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিলে তোমাকে খাবারসহ জল দেব, না হলে তোমাকে তোমার দেশে পাঠিয়ে দেব।
হিন্দি ভাষায় কথা শুনে আসাদ ভীষণ বিস্ময়ে একবারে থ বনে গেল। তার কানে যেন হিন্দি ছবির ভিলেনের সংলাপ প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। খানিক পরেই সে বুঝে গেল এই হিন্দিভাষী লোকটি হয়তো অভিবাসন কর্মকর্তা। তারপর একটা স্বস্তির ঢোঁক গিলে সে বাংলা হিন্দি মিশিয়ে অফিসারকে জিজ্ঞেস করে, কি তার অপরাধ? অফিসার আরও উষ্মা প্রকাশ করে বলল, তুমি জাল ভিসা নিয়ে এ দেশে প্রবেশ করেছ, তুমি কি জানো এর পরিণাম? আসাদ বিনীত স্বরে অস্বীকার করে যতই বলতে চাইল, তার পাসপোর্ট, ভিসা জাল নয়, ততই অফিসারটা তার ওপর চড়াও হতে লাগল এবং একপর্যায়ে তাকে আবার গলা ধাক্কা দিয়ে ছোট্ট রুমটায় রেখে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিল। বলে গেল, এক্ষুনি তোমাকে জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
অফিসারের কথা যেন আসাদকে রক্তাক্ত করে দিল। তার মনে হলো, কে যেন শাণিত ছুরি দিয়ে রাতের নীরবতাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে। সে আবার ভাবতে লাগল দালালের কথা, বিশ্বস্ত লোক হয়ে দালাল দুই নম্বরি করতে পারে না। আসাদ মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, যতই নির্যাতন আসুক সে কখনো দেশে ফিরে যেতে রাজি হবে না। আসাদ জানে, আমেরিকার অভিবাসন আইনে আছে কাউকে জবরদস্তি করে তার দেশে পাঠানো যাবে না। তার আইনের সহায়তা পাওয়ার অধিকার আছে। সুতরাং সেও আইনের আশ্রয় নেবে।
টুলের মধ্যে বসে বসে কোমরে খিল ধরে গেছে। একে তো দীর্ঘ সময় উড়োজাহাজের সিটে বসা, তার পরে এই চিলেকোঠার টুল। আর যেন পেরে উঠছে না সে। মনে হয় এক্ষুনি মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। এমনি এক সময় বাইরে কারও পদশব্দে সে একটু নড়েচড়ে বসে। মুহূর্তেই একজন লোক দরজা খুলে তাকে ইশারায় বাইরে আসতে বলে। আসাদ তার হ্যান্ডব্যাগ আর সুটকেস নিয়ে লোকটার নির্দেশ মতো আগে আগে চলতে থাকে। সে ভাবছে এক্ষুনি হয়তো ফিরতি বিমানে উঠিয়ে দিয়ে বলবে, গুডবাই!
বাইরে আসলে একটা প্রাইভেট কারে করে আসাদকে নিয়ে যাওয়া হলো বিরাট দেয়ালঘেরা দোতলা আবাসিক ভবনের একটা রুমে। স্থানীয় সময় সকাল সাতটা, আসাদ ঘুমাচ্ছে অবচেতন হয়ে; টানা দুই রাতের নিদ্রাহীন সে। উড়োজাহাজের লম্বা ভ্রমণে তার দুচোখের পাতা এক হয়নি নানান উৎকণ্ঠায়, নানান বিরূপ আবেগতাড়নায়। হঠাৎ এক লোকের কর্কশ চিৎকারে অতি কষ্টে চোখ মেলে তাকাল সে। কিন্তু মনে মনে খুবই বিরক্ত। লোকটি তাকে ঘুম থেকে ওঠার ইঙ্গিত করল এবং তাড়াতাড়ি বাথরুম শেষ করে নাশতা করে তৈরি হতে বলল, কারণ আজ তাকে আদালতে হাজিরা দিতে হবে। আসাদ সবকিছু না বুঝলেও একেবারে যে বোঝেনি তা নয়। প্রথমেই সে বাথরুমে ঢুকে গেল, দেখে দাঁত মাজার পেস্ট-ব্রাশ-সেভিং-রেজার সব রেডি।
বাথরুম শেষ করে আসাদ দেখে ওই লোকটা তাকে ডাকছে,সে ধীরপায়ে সামনে এগিয়ে দেখে লম্বা লাইন দিয়ে লোক দাঁড়িয়ে আছে। তারপর এক এক করে সামনের টেবিলে সাজানো নাশতা সামগ্রী হাতে নিচ্ছে আর সারি করা চেয়ারে বসে নাশতা খাচ্ছে। আসাদও সবাইকে অনুসরণ করে করে নাশতা করতে লাগল। হঠাৎ তার কানে বাজল দুই তিনজন লোক বাংলায় কথা বলছে, প্রথমে সে ভাবল হয়তো তার মতিভ্রম হচ্ছে। কারণ তার ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোতেই সে গলদঘর্ম। নাশতায় আবার মনোযোগী হয়, কিন্তু আবার তার কানে বাজে বাংলায় কথোপকথন, এবার সে চোখ ঘোরায় চারদিকে, দেখে সত্যিই তিনজন দেশি কথা বলছে।
ত্বরিত বেগে আসাদ চলে আসে তাদের কাছে। তার আলাপ-পরিচয়, দুঃখের কথা, দেশের কথা। আলাপের সূত্র থেকে আসাদ জেনে গেল, এটিন জেল নয়, এটা আটক কেন্দ্র। দেশি লোক পেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে আসাদ, ওই দিন তাকে আদালতে নিয়ে যাওয়া হলো। লম্বা হলুদ রঙের বাস, চালক সাদা চামড়ার এক মহিলা পুলিশ। আটক, বন্দী প্রায় অর্ধশত যাত্রী। এর মধ্যে তিন ভারতবাসী পাঞ্জাবি আর আসাদ বাদে বাকি সবাই সাউথ আমেরিকান নারী-পুরুষ।
সকালের লস অ্যাঞ্জেলেসের আকাশ খুবই চমৎকার গাঢ় নীল, চারদিকে কেমন খোলা ফকফকা, খুবই নিম্ন তাপের সূর্যের আলো। বাসের জানালাগুলো এক ধরনের ধাতব নির্মিত গ্রিল দ্বারা নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করে বোঝানো হয়েছে, এটি অসাধারণ বাস। মৃদু ঝাঁকি দিতে দিতে বাসটা চলছে, মাঝে মধ্যে দু-একটি প্রাইভেট কার বাসটিকে অতিক্রম করে যাচ্ছে। কেউবা আবার সমান তালে বাসের পাশাপাশি যাচ্ছে। আসাদ তাকিয়ে আছে গ্রিল লাগানো জানালায়। এক সময় দেখে প্রাইভেট গাড়ি থেকে একটা পুরুষ আর মহিলা বাসের পাশে আসতেই হাসি-ঠাট্টা করছে। দেখে আসাদ মনে মনে খুবই লজ্জিত হলো। তার মনে হলো, বন্দীদের বাস তারা চিনে গেছে হয়তো। একজন মহিলা পুলিশ এত বড় একটা বাস চালাচ্ছে, আসাদ তা ভেবেই অবাক হচ্ছে। সে একবার একটা ইংরেজি ছবি দেখেছিল, নাম ছিল সানফ্লাওয়ার। ছবির নায়িকার নাম তার মনে আসছিল না, হঠাৎ মনে হলো তার নায়িকা সোফিয়া লরেনের সঙ্গে এই মহিলা পুলিশ অফিসারের চেহারায় হুবহু মিল রয়েছে।
ঘণ্টাখানেক পরেই আসাদের মনে হলো, তাদের বহনকারী বাস একটি বহুতল ভবনের পাশে সাইড নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। হাঁ এটিই লস অ্যাঞ্জেলেস আদালত ভবন হবে। তার ধারণাই ঠিক হলো, কয়েকজন পুলিশ এসে বাসের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে বন্দী সবাইকে লাইন করে আদালতের ভেতরে যেতে আদেশ করল। একটা বড় কক্ষের মধ্যে লম্বা কয়েকটা স্টেইনলেস স্টিলের বেঞ্চ পাতা, তাতে হাতল কিংবা হেলান কিছুই নেই। কক্ষের এক কোণে একটি দরজাহীন বাথরুম, তাতে আবার ছাদ নেই। আসাদ লক্ষ্য করে, যাদেরই বাথরুম চাপে তারা নির্দ্বিধায় অর্ধনগ্ন হয়ে বসে যায়। আসাদ ভেবে কূল পায় না, যেদিকে তাকায় দেখে সবকিছুই ঠিকঠাক পরিস্থিতি বিদ্যমান কিন্তু বাথরুমের এ অবস্থা কেন! এক সময় তার ডাক এল। অন্য একটি রুমে তাকে ডেকে পাঠাল। একটা ক্লারিক্যাল রুম। বেশ কয়েকজন মহিলা কম্পিউটার নিয়ে বসে আছে। আসাদের বাম হাতে বাঁধা বেল্ট দেখে তার নাম-নম্বর টুকে রাখা হলো, একজন তাকে জিজ্ঞেস করে সে মাংস খাবে নাকি সবজি। সে বলে দিল ভেজিটেবল, তার সন্দেহ মাংস খাবে বললে হয়তো শুকরের মাংস দিয়ে দেবে। এক সময় দুপুরের খাবার দেওয়া হলো, ভেবে-চিন্তে প্যাকেট খোলে সে, দেখে সব সেদ্ধ সবজি। সঙ্গে একটা জুস থাকায় রক্ষা, গলা টেনে টেনে জুসের সঙ্গে খাবারটা শেষ করে নিল। তারপর শুরু হলো ম্যারাথন বসা। বিরামহীন এসি চালু থাকায় স্টিলের বেঞ্চসহ পুরো রুমটা ভীষণ ঠান্ডা অনুভূত হচ্ছে তার, বসে বসে আবার কোমরে খিল ধরার জোগাড়। এটা কী ধরনের কোর্ট হাজিরা—আসাদের বোধগম্য হলো না। পুরোদিন বসিয়ে রেখে দিল কোর্ট হাউসে। বিকেল পাঁচটা, এবার আটক কেন্দ্রে ফিরে যাওয়ার পালা। সবাইকে আবার জড়ো করা হলো।
যথারীতি বাস প্রস্তুত। সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে বাসে উঠতে তৎপর। বাস চলছে গন্তব্যে, মন্থর গতিতে। সূর্য ধীরে ধীরে দিবসের সমাপনী টানার পাঁয়তারা চালাচ্ছে। চলন্ত বাসের জানালায় সূর্যরশ্মির আলোকচ্ছটা কখনো ঝলসে দিচ্ছে যাত্রীদের চোখ। হাইওয়ের পাশে প্রশস্ত মাঠের সবুজে পড়ন্ত বেলার সূর্যের আলোতে ছায়া সুনিবিড় হাতছানি এক সময় দূরের বৃক্ষরাজির আড়ালে লুকিয়ে গেল। বাস যখন গন্তব্যে পৌঁছাল তখন সন্ধ্যার পরের লগ্ন। দ্বিতল আবাসিক ভবনের প্রতিটি কক্ষের দরজা নিয়মের আহ্বানে বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু একটি জানালায় দেখা গেল আলোর ঝলকানি। কোর্ট ফেরা লোকের উপস্থিতি টের পেয়ে সেই তিন বাঙালি আসাদকে খুঁজে বের করে। তার রাতের খাবারের ব্যবস্থা করে তাদের রুমে একটা বাংকার বেডে তার শোয়ার ব্যবস্থা করে দিল। তারপর এখানকার কিছু নিয়মকানুন আসাদকে তারা বুঝিয়ে দিল। শুরু হলো তার অনিশ্চিত জীবন। সকাল সাতটায় ঘুম থেকে ওঠার নিয়ম। আটটার মধ্যে সকালের নাশতা সেরে নিতে হয়। সবকিছু এখানে নিয়ম মাফিক চলে। পরদিন তার একমাত্র বন্ধু জিলানের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দিল সঙ্গের একজন বাঙালি ভাই। জিলানের সঙ্গে আলাপ করে নিজেকে খুবই উৎফুল্ল মনে হলো তার। ভাবসাব এমন যেন আশার তরী কিনারায় ভিড়ল বলে। হঠাৎ এক সময় বুকটা ভীষণভাবে মোচড় দিল। মনে হলো বাচ্চাদের কথা। মনে হলো সোনিয়ার কথা। এখন চোখের জল আর থামতে চায় না। চিৎকার করে তার কাঁদতে ইচ্ছে করছে। চিত হয়ে শুয়েছিল বালিশে মাথা রেখে তাই চোখের জল গড়াচ্ছিল দুই কানের পাশ দিয়ে। কখন যে বালিশ ভিজে জবুথবু হয়েছে, তার কোনো খেয়াল ছিল না আসাদের। এক সময় তার রুমমেটের ডাকে সংবিৎ ফিরে পায় সে। তারপর দেশে চিঠি পাঠানোর সব নিয়মকানুন জেনে ঠিক করে কালই সে সোনিয়াকে চিঠি লিখবে। কিন্তু চিঠিতে কী লিখবে সে! সমুদ্রের বিশালতার মতো ভাবনা নিয়ে বসে আছে সোনিয়া। ছেলেমেয়েকে সান্ত্বনা দিচ্ছে, নীল আকাশে উড়তে উড়তে নীল খামে বাবার চিঠি আসবে আমেরিকা থেকে। আর আসাদ কি তাদের স্বপ্নিল আশার গুড়ে বালি ঢালবে! চিঠিতে লিখবে, আমি ভালো নেই। আমি আমেরিকায় এসে ফেঁসে গেছি। শত ভাবনায় জর্জরিত আসাদ কিছুতেই চিঠি লেখার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। সারা রাতেও জ্যামিতিক সমাধান সে খুঁজে পায়নি।
সপ্তাহ পার হয়ে গেলে শুরু হলো সোনিয়ার পথ চাওয়া। সে জানে আমেরিকা থেকে চিঠি এত অল্পদিনে আসার কথা নয়। তবুও অজানা আতঙ্কে সারাক্ষণ বুক ধড়ফড় করতে থাকে। সোনিয়া মনে মনে ভাবে, একবার জিলানদের বাড়ি থেকে ঘুরে আসা দরকার। আসাদ নিশ্চয়ই জিলানের সঙ্গে দেখা করেছে। নতুন অবস্থায় সে হয়তো চিঠি লেখার সুযোগ পায়নি। তাই জিলানকে বলে দিয়েছে তার বাড়িতে একটা খবর পাঠিয়ে দিতে। মনের ভাবনাশক্তি মনেই তোলপাড় করে নীরবে। কারও সঙ্গে শেয়ার করতে চায় না সোনিয়া।
যতই দিন যাচ্ছে, ততই নিষ্প্রভ হচ্ছে আসাদ। প্রতিদিন কথা হয় বন্ধু জিলানের সঙ্গে। তাও কথা বলার একমাত্র অবলম্বন হচ্ছে পে-ফোন, এক কয়েনে তিন মিনিট ফোনটা সরব থাকে, কিন্তু আসাদ দীর্ঘশ্বাস টানতে টানতে কখন যে তিন মিনিট পুরো হয়ে লাইন কেটে যায়, তা সে নিজেই টের পায় না। ধীরে ধীরে বন্ধু জিলান ব্যস্ততার দোহাই দেখিয়ে আগের মতো প্রাণবন্ত হয় না। দুদিন পরেই আসাদের আদালতে হাজিরার তারিখ। সে ভীষণ চিন্তিত। এসব ব্যাপারে নাকি অভিবাসন উকিল ধরতে হয়। কেউ ইচ্ছে করলে নাকি বিনা খরচে সরকারি উকিলেরও সাহায্য পেতে পারে। কিন্তু কেউ এসব উকিল নিতে চায় না। কারণ ওরা নাকি মক্কেলের পক্ষে কোন যুক্তি দেখায় না। এ সব জেনেশুনে সেও এক উকিল নেওয়ার চিন্তা করে। যে করেই হোক, তাকে তার অস্তিত্বের জন্য লড়তে হবে!
আদালতে হাজিরার তারিখ অনুযায়ী আসাদকে হাজির করা হলো বিচারকের সামনে। আসাদ দেখে একজন বাঙালি দোভাষী বসে আছে তারই অপেক্ষায়। দোভাষীর মাধ্যমে সে বুঝে গেল, আগামী হাজিরার তারিখে তাকে অবশ্যই একজন উকিলের সাহায্য নিতে হবে। অন্যথায় তাকে মেনে নেওয়া যাবে না। এখন আবার নতুন ভাবনার উদ্রেক হলো আসাদের। কোথায় পাবে সে একজন আইনজীবী,দেশ থেকে আসার সময় বিদেশি মুদ্রা হিসাবে এক হাজার ডলার তার হাতে আছে, সুতরাং সে মনে করে প্রাথমিকভাবে হয়তো আইনজীবীর ব্যাপারটা সামাল দেওয়া যাবে, কিন্তু ব্যাপার হচ্ছে উকিল সে পাবে কীভাবে!
আটক কেন্দ্রে একদিন এক আইনজীবীর সঙ্গে পরিচয় হয় আসাদের। মিসরীয় আমেরিকান আইনজীবী। তিনি রাজি হলেন আসাদের জন্য তিনি কাজ করবেন। জেনে একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে সে। এখন শুরু হলো আদালতে হাজিরার তারিখের অপেক্ষা।
ডিসেম্বর মাস। লস অ্যাঞ্জেলেস শহরের ঘরে ঘরে শুধু সাজ সাজ রব। ক্রিসমাস দিবস আগত প্রায়, আটক কেন্দ্রে একটা কানাঘুষা চলছে, আমেরিকার আদালত মাঝেমধ্যে লঘুদণ্ডের আসামিদের সাধারণ ক্ষমা দিয়ে বড়দিনের আগেই মুক্ত করে দেয়। হলোও তাই। একদিন দেখা গেল আটক কেন্দ্রের দোরগোড়া পরিপূর্ণ করে হলুদ বাসগুলো লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সবাইকে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। যার যার বাক্সপেটরা গুছিয়ে রাখতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাইকে আদালতে নিয়ে যাওয়া হবে। এ ঘোষণায় আসাদ যেন কিছুতেই খুশি হতে পারছে না। তার মনে একটা অজানা আশঙ্কা ঘুরপাক খাচ্ছে। যেন সমুদ্রের উত্তাল ঢেউগুলো আঁচড়ে পড়ছে। আর তটিনীর সব বালিরাশি চোরাবালির গহ্বরে বিলীন করে দিচ্ছে হলুদ রঙের বাসগুলো।
একই লেন ধরে বাসগুলো এগোচ্ছে মন্থর গতিতে। যাত্রী সবাই নির্বাক। কারও মুখে কোন রা নেই। সবার মনে একটা আতঙ্ক বিরাজ করছে। কেউ আন্দাজ করতে পারছে না পরের মুহূর্তে কী হতে যাচ্ছে! আসাদ ধরে নিয়েছে, আদালতে সবাইকে হাজির করেই একটা কাগজ হাতে ধরিয়ে বিমানবন্দরের রাস্তা দেখাবে। তারপর উড়োজাহাজে উঠিয়ে দিয়ে বলবে, গুডবাই! ইতিমধ্যে হলুদ বাসের সারিটা এক এক করে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে গেল বহুতলা আদালত ভবনের সামনে। তারপর যথারীতি আদালতের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকল। বিরাট হলওয়েতে আবার লাইন দিতে নির্দেশ দেওয়া হলো সবাইকে।
তারপর একজন কর্মকর্তা মোটা রেজিস্ট্রার বুক দেখে এক এক করে নাম ডাকতে লাগল, আর একেকজনের নামের সঙ্গে মিলিয়ে এক একটা কাগজ ধরিয়ে দিতে লাগল। যারা কাগজ হাতে পেল তাদের খুবই উৎফুল্ল দেখাচ্ছে। এক সময় আসাদের ডাক পড়ল। দুরু দুরু বুকে সামনে এগিয়ে যায় সে। একই কায়দায় কাগজখানা হাতে নিল সে। তারপর রেজিস্ট্রারে সাইন করতেই অফিসার আরেকটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলে, এটা তোমার রিলিজ লেটার। তার সঙ্গে আদালতে হাজিরার তারিখ দেওয়া আছে। নির্দিষ্ট সময়ে আদালতে হাজির হতে হবে। তারপর অফিসারকে মৃদু হাসির সঙ্গে ধন্যবাদ জানিয়ে লাগেজ টানতে টানতে বাইরের দরজা দিয়ে অতি দ্রুত অদৃশ্য হয়ে গেল আসাদ।