আমেরিকায় দাওয়াত সমাচার

কমিউনিটি অ্যাকটিভিস্ট নার্গিস আহমেদ তার নিউইয়র্কের বাসায় সেই আশির দশক থেকে নিয়মিত পার্টি দিয়ে আসছেন
কমিউনিটি অ্যাকটিভিস্ট নার্গিস আহমেদ তার নিউইয়র্কের বাসায় সেই আশির দশক থেকে নিয়মিত পার্টি দিয়ে আসছেন

প্রবাস জীবনে দাওয়াত যেন এক আকাঙ্ক্ষিত উৎসবের নাম। আপন মাতৃভূমি ছেড়ে ভিনদেশে আড্ডা আর গল্পমুখর সময়েরও অপর নাম দাওয়াত। তবে এখানে দাওয়াতের মধ্যে যেমন আছে ভিন্নতা, তেমনই আছে বৈচিত্র্য। ভোজন রসিক বাঙালি দেশে থাকুক কিংবা প্রবাসে, তারা নিজেদের মতো ঠিকই জমিয়ে নেবে সবখানে। আর সে কারণে কোন আড্ডা বা দাওয়াতে লোকসংখ্যা ২০ থেকে পঞ্চাশে ছড়ালেও নেই কোনো বিপত্তি। কারণ হলো, ‘পটলাক’। ‘পটলাক’ হচ্ছে অনেকটাই পিকনিকের মতো।
ধরা যাক, পাঁচটি পরিবার ছুটির দিনে আড্ডা দিতে চাইছে। জায়গা ঠিক হলো যেকোনো একজনের বাসায়। কিন্তু সবাই নিজেদের পছন্দমতো কিছু না কিছু রেঁধে নিয়ে আসবে। একটি বা দুইটি পদ। এতে মানুষের সংখ্যা যতই বৃদ্ধি পাক, তাতে চিন্তা করার কিছুই নেই। কারণ একই সঙ্গে বৃদ্ধি পাচ্ছে খাবারের আইটেমও। আর শুধু একজন বা একটি পরিবারের ওপর আয়োজনের চাপও পড়ছে না। এ ছাড়া ইংরেজি মাসের শুরু, বাংলা নববর্ষ, ফাল্গুন ও ঈদের দাওয়াত তো রয়েছেই। গল্প, আড্ডা, বোর্ড গেম, গানে, কবিতায় মুখরিত হয়ে ওঠে অনেক দাওয়াত। যার ফলে শুধু উদরপূর্তিই নয় বরং আত্মিক বিনোদনের স্থানটুকুও হয়ে ওঠে পূর্ণ।
যেখানে বাংলাদেশ কিংবা ঢাকার মতো ব্যস্ত শহরে অনেকেরই অবসর সময় কাটে রেস্তোরাঁয় আড্ডা দিয়ে, সেখানে আমেরিকার নানা অঙ্গরাজ্যে বাইরের রেস্তোরাঁর চেয়ে বাড়ির দাওয়াতের জনপ্রিয়তাই বেশি। সদ্য প্রবাসে আসা অনেক ছাত্র-ছাত্রী কিংবা পরিবারই বাঙালি কমিউনিটির চেনা মুখ হয়ে ওঠে এই ঘরোয়া দাওয়াতগুলোর মাধ্যমে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরস্পরের প্রতি বন্ধুত্ব আর সৌহার্দ্যও বেড়ে যায়। অনেকে হয়তো দেশে থাকতে রাঁধতেই জানতেন না, কিন্তু প্রবাসে এসে নানাজনকে জিজ্ঞেস করে, দাওয়াতে এসে রেসিপি নিয়ে, রান্না সংক্রান্ত ভিডিও দেখে চমৎকার রাঁন্না জেনেছেন—এমন উদাহরণও আছে।

সংস্কৃতিকর্মী কবির কিরনের নিউ জার্সির বাসায় পার্টির দৃশ্য
সংস্কৃতিকর্মী কবির কিরনের নিউ জার্সির বাসায় পার্টির দৃশ্য

নিতান্তই শখের বসে কেক বানাতেন একজন বাঙালি নারী। পটলাক আর ঘরোয়া দাওয়াতে যখনই যেতেন বা কাউকে ডাকতেন, নিজের বানানো দুই থেকে তিন রকমের কেক সেখানে থাকতই। সেখান থেকে দিন দিন তার বানানো কেক এতই জনপ্রিয়তা পেয়ে যায় যে, সেই শহরের মানুষেরা এখন আর বেকারি থেকে কেক না কিনে তার কাছেই এসে কেকের অর্ডার দেয়। এভাবেই অবসর সময় কাজে লাগাতে শিখেছেন তিনি।
প্রবাসের দাওয়াতের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, নারী ও পুরুষের অংশগ্রহণ। দেশে রসুইঘরের দরজার সামনেও যাননি এমন অনেক পুরুষকেই দেখা যায়, প্রবাসে এসে দিব্যি সঙ্গীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রান্না করছেন। কাটা-বাছা থেকে পরিবেশনে সার্বিক সহায়তা করছেন। সেই দৃশ্য বড় মধুর। এখানকার দাওয়াত ও পরিবেশনে তাই স্ত্রীর পাশাপাশি স্বামীর অবদানও দৃঢ়ভাবেই থাকে।
কথায় বলে, দুইভাবে মানুষের হৃদয় জয় করা যায়। ভালোবাসা দিয়ে এবং মজাদার রান্না দিয়ে। প্রবাসের দাওয়াত ভালোবাসা, আন্তরিকতা ও সুস্বাদু খাবারের সমন্বয়। আর তাই মন ও ভুরিভোজ—দুই ক্ষেত্রেই সন্তুষ্ট হওয়া যায়।
তবে এসব কিছুর পাশাপাশি কিছু ভেদাভেদও আছে, যা একেবারেই না বললে নয়। ছোট ছোট কিছু দলবদ্ধ ভাব ও শ্রেণিবিভাগ আছে প্রবাসের দাওয়াতে। যেমন, আমেরিকায় স্থায়ী বাঙালিদের দল কিংবা শুধুই গ্রিনকার্ড আছে এমন পরিবারগুলোর আড্ডা, সন্তানসহ দম্পতিদের দাওয়াত কিংবা শুধুই ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য দাওয়াত। অনেকেই এরকম ভেদাভেদ করে দাওয়াত দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এ ছাড়া দাওয়াত নিলে দাওয়াত দেওয়ার একটি অদৃশ্য সংস্কৃতির প্রচলন আছে প্রায় সব জায়গায়, যার কারণে অনেককেই শত ব্যস্ততার মাঝেও ‘দাওয়াত দিতে হবে’—এই চাপ ও প্রস্তুতিটুকু নিতেই হয়।
তবে এই অল্প কিছু বিষয় বাদে প্রবাসের দাওয়াত মানেই বাংলা ভাষায় ও গল্পে মুখরিত সন্ধ্যা। কিংবা চিরচেনা বাঙালি খাবারের টেবিল ভরা আয়োজন, যা কিনা সারা সপ্তাহ বা মাসে নানা ব্যস্ততায় বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা অনেক বাংলাদেশিকেই এক করে ফেলে। আর যেখানেই এমন ঘটে, সেখানেই জেগে ওঠে যেন ছোট্ট বাংলাদেশ।