প্রাইভেট টিউশনি

এক ছাত্রের অভিভাবক এসে বললেন, ‘যেহেতু রিন্টুর পরীক্ষা শেষ, আপাতত আপনাকে আসতে হবে না। আসছে এপ্রিল মাসে যোগাযোগ করেন। গত দুই মাসের যে বেতন বাকি পড়েছে সেটা আগামী মাসের ১০ তারিখ এসে নিয়ে যাবেন।’
আমি প্রমাদ গুণি কিন্তু চলে আসি অনিচ্ছা সত্ত্বেও। একে তো আগের দুই মাসে বেতন বাকি তার ওপর আগামী মাসগুলো চলব কেমন করে সেই চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে!
তারপর কত ১০ তারিখ, ১১ তারিখ, ১২ তারিখ আসে যায়-আমি যাই আর আসি কিন্তু টাকা পাই না। তখন সেলফোন ছিল না। থাকলেও আমার ছিল না। কোনো দিন বিল্ডিংয়ের নিচে দাঁড়িয়ে অনেক অপেক্ষা আর ডাকাডাকির পর কেউ দয়া করে বারান্দায় উঁকি দিয়ে বলে, খালাম্মা বাসায় নাই। কালকে আইসেন।
পরদিন যথারীতি যাই কিন্তু ডাকাডাকির পরও কেউ বারান্দায় আসে না। খুব সন্তর্পণে পর্দা হালকা সরিয়ে উঁকি দিয়ে বুঝিয়ে দেয় যে বাসায় কেউ নাই। আমিও নাছোড় বান্দা। পরিশ্রমের টাকা বলে কথা। মোড়ের চুলকানির-মলম বিক্রেতার হ্যান্ডমাইক ধার করে ডাকলাম, রিন্টু, আমি তোমার স্যার। আমার পাওনা টাকাটা নিতে এসেছি।
শেষমেশ ছাত্র বারান্দায় এল। আট বছরের বাচ্চার চোখেমুখে ভীষণ রাগ! সম্ভবত অপমানের। সে হ্যান্ডমাইকের চেয়ে দ্বিগুণ জোরে সারা পাড়াকে জানিয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে বলল, স্যার আপনের কাছে পইড়া আমি পরীক্ষায় ফেল করছি, তাই আম্মা মনে হয় আপনেরে বেতন দেবে না।
এবার হ্যান্ড মাইক রেখে মিনমিন করে বললাম, তাহলে আমি কি পরে আসব?
ছাত্রের মনে হয় এবার একটু করুণা হলো। বলল, ‘আসলে আইসেন, না আসলে না আইসেন’। বলেই দৌড়ে ভেতরে চলে গেল।
আসতে যেতে ৩০ টাকা রিকশা ভাড়া, মোড়ের দোকানে চা-বিস্কুটের পেছনে পয়সা খসানো, আর রাজপথ ক্ষয় করা চপ্পলের আঘাত—এসব পার হয়ে অবশেষে একদিন বকেয়া বেতন হাতে পেয়েছিলাম। ছাত্রের মা আমার সামনে ছাত্রকে কানমলা দিয়ে ক্ষমাও চাইলেন। বললেন, কার্টুন দেখার ব্যস্ততায় সে ওসব বলেছিল। বললেন, হ্যান্ডমাইকে ডাকাডাকি করে পাওনা টাকা চাওয়ার কোনো দরকার ছিল না। আমরা অন্য টিচার দেখছি, আপনার আর আসার দরকার নাই!
কিছু টিউশনির স্মৃতি আবার অন্যরকম। ঢাকার মগবাজারে সোনালীবাগ নামে একটা জায়গা আছে। সেখানে একটা বাসায় টিউশনি করতে যেতাম। মানুষ মুড়ির সঙ্গে ঠোঙা ফ্রি পায় আর বেতনের সঙ্গে পায় বোনাস। আমি ফ্রি পেয়েছিলাম ছাত্র। প্রাইভেট পড়াতাম ক্লাস ফাইভের ছাত্র সায়মাকে। এক বিকেলে পড়ানোর পর চলে আসছিলাম। সায়মা দৌড়ে এসে বলল, স্যার, আম্মু আপনাকে একটু বসতে বলেছেন। বসলাম। একটু পরে সায়মার মা হাত ধরে একরকম টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে এলেন তাঁর চার বছর বয়সী ছেলেকে। ছেলের অন্য হাতে একটা পিস্তল ধরা (অবশ্যই খেলনা)। সে সেই হাত আর দুই পা সমানে ছুড়ছে।
তিনি ছেলেকে আটকে রেখে বললেন, আবিদ সারা দিন শুধু কার্টুন দেখে আর দুষ্টুমি করে। কিন্ডার গার্টেনে যায়, কিন্তু ওখানে কিছু শেখে না, বাসায়ও কিছু পড়ে না। কাল থেকে সায়মার সঙ্গে ওকেও যদি একটু পড়াও তাহলে খুব ভালো হয়। টিউশনিটা আমার প্রয়োজন, তাই হ্যাঁ বলা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। বললাম, আচ্ছা। সায়মার মা খুশি হয়ে চলে গেলেন। আবিদও মায়ের পেছন পেছন চলে গেল হাতের পিস্তল দিয়ে আমাকে লক্ষ্য করে অদৃশ্য গুলি ছুড়তে ছুড়তে। এভাবেই আবিদকে বোনাস হিসেবে পেলাম।
সায়মা খুব লক্ষ্মী একটা মেয়ে আর পড়াশোনায় বেশ মনোযোগী। আবিদ তার উল্টো। পরদিন সায়মা এসে যথারীতি পড়ছে। কিন্তু, আবিদকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আধা ঘণ্টা পর তার মা কোথা থেকে যেন তাকে বের করে নিয়ে এলেন। সে সমানে চিৎকার করে প্রতিবাদ জানিয়ে যাচ্ছে। কিছুতেই পড়বে না। আমি ঢোক গিললাম! তার মা আমার পাশে একটা চেয়ার এনে তাকে বসিয়ে হাতটি আমাকে ধরিয়ে দিলেন।
আমি জোর জবরদস্তি পছন্দ করি না; তাই শুরুতেই পড়ানোর রাস্তায় না গিয়ে তার সঙ্গে একটু বন্ধুত্ব পাতানোর চিন্তা করলাম। কিন্তু, কিছু বলার আগেই সে আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘স্যার, আপনে কি বুগি-ওগি দেখেছেন?’
—না।
‘ইসকি টোপি-উসকি সর্?’
—না দেখিনি।
আবিদ আমার অজ্ঞতা দেখে খুব হতাশ হয়ে রং-পেনসিল নিয়ে খেলতে লাগল। একটু পরে একটা অঙ্ক দেখাতে আমি সায়মার দিকে ফিরতে না ফিরতেই হাত ছাড়া পেয়ে সে চেয়ার থেকে নেমে দিল ভোঁ দৌড়! সারা দিন আর ফিরে এল না।
মগবাজারে সোনালীবাগে আবিদদের বিশাল বাড়ি। এখানে কোথাও লুকালে তাকে খুঁজে পাওয়া ছিল আসলেই দুষ্কর। আমি আসার পর প্রতিদিনই তাকে কখনো খাটের তলা থেকে, কখনো আলমারির ওপর থেকে, কখনো ওয়ার্ডরোবের ভেতর থেকে, কখনো আলনার পেছন থেকে, আবার কখনো বিল্ডিংয়ের বিভিন্ন ফ্লোরে থাকা অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের বাসা থেকে বের করে আনতে হতো। কখনো এমন হতো আমি আসার এক ঘণ্টা বা আধা ঘণ্টা আগে হয়তো লুকিয়েছিল, সেখানেই ঘুমিয়ে পড়েছে। কখনো-কখনো ঘুম চোখেই আবিদকে তার মা এনে আমার কোলে বসিয়ে দিতেন। সে কখনো আমাকে জড়িয়ে ধরে আর কখনো বা টেবিলে মাথা রেখে আবার ঘুমিয়ে পড়ত। আমি ওই অবস্থায়ই সায়মাকে পড়াতাম।
একদিন চোখ বন্ধ রেখে মাথা না তুলেই আবিদ তার ভাঙা গলায় বলল, স্যার, আপনে কিন্তু কালকে আসবেন না।
—কেন আসব না?
‘কারণ, আসলে আমি আপনেরে মাইর দিমু।’
বলেই আবার ঘুমিয়ে পড়ল। জানের ডর আমারও আছে, কিন্তু বেতনের মায়া বা প্রয়োজন ছিল আরও বেশি। তাই ঠিকই পরের দিন পড়াতে গেলাম। নিষেধ সত্ত্বেও যাওয়ার অপরাধে আবিদ দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে আমার বিচার করত। সে নিজেই বাদী, নিজেই বিচারক। শাস্তি ছিল আমার হাতে কামড়। নিজেই সেই শাস্তি কার্যকর করত। কিন্তু তার সর্বশক্তির কামড় আমাকে যতটা না ব্যথা দিত, চকলেট খেয়ে ক্ষয়ে যাওয়া দাঁতের কারণে সুড়সুড়ি লাগত বেশি। ওদিকে আমাকে আক্রান্ত দেখে আমি কিছু বলার আগেই সায়মা দৌড়ে গিয়ে উচ্চতর আদালতে নালিশ জানাতো। সায়মার মা এসে আমাকে উদ্ধার করে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতেন। তখন আবিদের পিঠেও পড়ত দু-এক ঘা!
লিখতে-পড়তে না জানা এক বিষয়, আর লিখতে-পড়তে না চাওয়া আরেক বিষয়। এই দুই প্রবল প্রতিরোধী শক্তির সঙ্গে মোকাবিলা করেই আবিদকে পড়াতাম। যতক্ষণ পড়াতাম বা পড়ানোর চেষ্টা করতাম-সে নানাভাবে অনীহা প্রকাশ করত। তারপরও শিশুর হাতে ধরা পেনসিলের এলোমেলো কিছু দাগ দিনে দিনে যখন একেকটা বর্ণ হয়ে ওঠতো সেটা দেখতে ভীষণ ভালো লাগত। ধীরে ধীরে আমার পরিশ্রমের ফল পেতে শুরু করলাম। একসময় লক্ষ্য করলাম, সে বাংলা, ইংরেজি হাতের লেখা বা বাড়ির কাজ দিলে তা ঠিকঠাক করে রাখত। তার মধ্যে চ্যালেঞ্জ নেওয়ার একটা ক্ষমতা ছিল, যা আমাকে মুগ্ধ করত।
দিনে দিনে পড়ার চাপ বাড়ালাম। সে ধীরে ধীরে হলেও সাড়া দিতে লাগল। গুরু-শিষ্যে এক ধরনের সুন্দর বোঝাপড়া গড়ে উঠল।
একদিন সায়মা বলল, স্যার, আম্মু বলেছেন আবিদের হাতের লেখার জন্য সহজ কিছু লিখে দিতে। আপনি যা লিখে দেন সেগুলো ওর জন্য খুব কঠিন! আমার খুব লজ্জা লাগল। সম্ভবত ইগো। সেই মাসে ২০ দিন পড়িয়েছিলাম। কিন্তু আর যেতে ইচ্ছে করল না। আর গেলামও না। বেতন নেওয়ার জন্যও না। যে আত্মীয়ের বাসার ফোন নম্বর দিয়েছিলাম (তখন মোবাইল তেমন সুলভ ছিল না) সেখানে ফোন করে আবিদের মা আবার পড়াতে যেতে অনুরোধ করেছিলেন অনেকবার। মন সায় দেয়নি। পড়াশোনার চাপ, এটা ওটা ইত্যাদি বলে এড়ালাম।
এত বছর পর কখনো কখনো হঠাৎ তাদের কথা মনে পড়ে। ভাবি, আমার ছাত্র-ছাত্রীরা আজ কোথায় কেমন আছে! এক ধরনের মমত্ববোধ অনুভব করি। আর, এত বছর পর ভাবি যা লিখেছিলাম, কেন লিখেছিলাম! সাড়ে চার বা পাঁচ বছর বয়সী শিশুর জন্য সম্ভবত লাইনগুলো ছিল আসলেই বেমানান।
—‘পূঁজিছে গ্রন্থ ভণ্ডের দল, মূর্খেরা সব শোনো-
মানুষ এনেছে গ্রন্থ; গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো!’