'আমিই বাংলাদেশ'

কয়েক দিন আগে নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে হঠাৎ একটা গাড়ির ওপর সেঁটে দেওয়া স্টিকারে চোখ পড়ল। সেখানে লেখা রয়েছে, ‘আমিই বাংলাদেশ’। আহা! ‘আমিই বাংলাদেশ’ দুটো শব্দের মাঝে কতই না অধিকারের ঘ্রাণ খুঁজে পাই। জীবনের প্রয়োজনে পৃথিবীর নানান প্রান্তে বাঙালিরা তাঁদের জাহাজ নোঙর করলেও আমাদের আত্মায় নিত্যই বাংলাদেশ নামের একটা দেশ বাস করে। সত্যি বলতে কি, পৃথিবীর নানা দেশের নানান কিসিমের মানুষ দেখেছি। কিন্তু এই বাঙালির মতো এত দেশপ্রিয় জাতি খুব কমই দেখেছি।
বাঙালিকে আর ঘরকুনো বাঙালি কোনোভাবেই বলা যাবে না। গোটা পৃথিবীই এখন বাঙালির হাতের মুঠোয়। জীবনের নানা প্রয়োজনে এই বাঙালি প্রবাসীরা প্রতিদিনই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশ থেকে দেশান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। জীবনসংগ্রামে নেমেছেন এবং জীবনকে নতুন করে নির্মাণ করছেন। তাঁরা কখনো বিপুল সাহসের সঙ্গে সাগর পাড়ি দিচ্ছে, কেউ কেউ নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে সুখের ঠিকানা খুঁজে পেয়েছেন, কেউ আবার হয়তো আফ্রিকার আদ্দিস আবাবার পথে পথে ঘুরে দূর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছেন। পৃথিবীর নানা প্রান্তে বাঙালির এই শিকড় গভীরভাবে প্রবেশ করলেও বাঙালি প্রবাসীরা তাঁদের ছোট্ট ধমনিতে একটা শব্দ খুব ভালোবাসা আর আদর দিয়ে লালন করেন, আর তা হলো ‘বাংলাদেশ’। আর সে কারণেই পৃথিবীর সব প্রবাসীই যেন এককাট্টা হয়ে চিত্কার করে বলতে চান—‘আমিই বাংলাদেশ’।
এই সুদূর প্রবাস ভূমি অনেকটা স্বপ্নরাজ্যের মতো মনে হলেও বাস্তবে কিন্তু এর চেহারা একেবারেই ভিন্ন। কেউ কেউ যেমন দালালের খপ্পরে পড়ে ভিটেবাড়ি বিক্রি করে সবকিছু হারিয়ে দিশেহারা হচ্ছেন, আবার কেউ প্রবাস নামের কল্পনার রাজ্যে বাস করতে গিয়ে গোটা জীবনই প্রবাসের অজানা-অচেনা শহরের প্রাণহীন ইট-কাঠের মাঝে নিজেকে আটকে ফেলেছেন। সত্যি বলতে, প্রবাসী হওয়া কিন্তু এত সহজ কোনো কথা নয়। যাঁরা প্রবাসী হয়েছেন, শুধু তাঁরাই বুঝতে পারেন এর মর্মজ্বালা কত কঠিন আর নিষ্ঠুর। নিজের প্রিয় শহর, গ্রামগঞ্জ, নদী, খাল-বিল, ভাষা, সংস্কৃতি, ঋতু, খাবারদাবার, প্রিয় মানুষগুলো আর সবচেয়ে বড় কথা নিজের প্রিয় দেশকে ছেড়ে দূরের কোনো অচেনা শহরে, অচেনা মানুষের সঙ্গে জীবনের নোঙর ফেলা চাট্টিখানি কথা নয়। অথচ সেই কঠিন কাজটিই নিত্য, নির্ভয়ে করে চলেছেন আমাদের বাঙালি প্রবাসীরা। প্রবাসীদের এই মহান ত্যাগ আর কষ্টের বিনিময়ে আজ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক চাকা সচল হচ্ছে, প্রবাসীদের পাঠানো অর্থে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য হচ্ছে, বাংলাদেশে উন্নয়নের জোয়ার লেগেছে। তাই তো, যে বাংলাদেশি নিজের জীবন জিম্মি রেখে, হাসি মুখে সব কষ্ট সহ্য করে ‘প্রবাসী’ নামটি নিয়ে নিত্য বাংলাদেশ গড়ার মহান দায়িত্বে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন, গোটা বিশ্বের সামনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে চলেছেন, তিনি তো গর্ব করে বলতেই পারেন—‘আমিই বাংলাদেশ’।
একজন প্রবাসীর জীবন একটি মাকড়সার সঙ্গে তুলনা করা যায়। মাকড়সা যেমন নিজের জীবনের বিনিময়ে তার সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখে, ঠিক তেমনি একজন প্রবাসীও কিন্তু তাঁর জীবনের সব আনন্দ, সুখ, আহ্লাদকে জলাঞ্জলি দিয়ে তাঁর পরিবার ও দেশটাকে নিত্য বাঁচিয়ে রাখেন। একজন প্রবাসীর ঘামের টাকায় দেশের দরিদ্র মায়ের স্বপ্ন পূরণ হয়, ছোট ছোট ভাইবোনেরা তাদের শখগুলো পূরণ করার সুযোগ পায়, বাড়িতে নতুন উঠানে আনন্দের বাদ্য বাজে। চারদিকে শুরু হয় স্বপ্নপূরণের মহা উত্সব। আর সেই উত্সবের আমেজে ধীরে ধীরে পরিবারের অর্থনীতির চাকাটি এগিয়ে চলে। এগিয়ে চলে বাংলাদেশও। কিন্তু একটা মাকড়সার মতো ক্রমেই জীবনযুদ্ধে ফুরিয়ে যেতে থাকেন প্রবাসী নামের মানুষটি। সময় দ্রুত চলে যায়। তারপরও ভিনদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে এক অচেনা স্বপ্ন জীবনসঙ্গী করে প্রবাসীটি বেঁচে থাকেন তাঁর অনাগত স্বপ্নের ধূসর রং নিয়ে। অথচ জীবনের কঠিন এই চোরাবালিতে হাবুডুবু খেয়েও একজন প্রবাসী আজন্ম বুক চিতিয়ে বেঁচে থাকেন তাঁর ছোট্ট সবুজ আর লাল রঙের পতাকাটাকে আঁকড়ে ধরে। নিত্য স্বপ্ন দেখেন বাংলাদেশকে, স্বপ্ন দেখান বাংলাদেশকে। কারণ, এই প্রবাসীরাই তখন বুকি চিতিয়ে বলতে পারেন—‘আমিই বাংলাদেশ’।
শুধু স্বপ্ন কেন? অনেক বাঙালির জন্য প্রবাস হলো স্বপ্নপূরণের দেশ। অনেকেই নিজ নিজ সাফল্যে বহু দূর এগিয়ে গেছেন। শুধু নিজের সাফল্য নয়, সেই সঙ্গে গোটা বাংলাদেশকেও তাঁরা প্রতিনিয়ত আলোকিত করছেন। আমেরিকায় প্রচুর বাংলাদেশি আছেন, যাঁরা এখানকার নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, বিজ্ঞানী, রাজনীতিক, পরিবেশ বিশেষজ্ঞ, চিকিৎসক, আইনজীবী, লেখক, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশায় কর্মরত। জাতীয়তায় হয়তো তাঁরা ভিন্ন, কিন্তু অস্থিমজ্জায়, মন ও মননে তাঁরা সবাই বাংলাদেশকে ধারণ করেন। বিভিন্ন জাতিসত্তার স্রোতোধারায় তাঁরা নিজেদের বিলীন করে দিলেও বুক চিতিয়ে ঠিকই জানিয়ে দিচ্ছেন—‘আমিই বাংলাদেশ’।
সন্দেহ নেই, আমরা সবাই আমাদের প্রিয় দেশটাকে খুব ভালোবাসি। কিন্তু বলতে ইচ্ছে করে, একজন প্রবাসীর মতো কি কেউ তাঁর দেশটাকে এত ভালোবাসতে পারবেন? বিদেশের মাটিতে দেখেছি, যখন ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ অসাধারণ এই সংগীত বেজে ওঠে, তখন কিন্তু একজন প্রবাসী অতি গর্ব, ভালোবাসায় আর আবেগতাড়িত হয়ে রুমাল দিয়ে নীরবে আড়াল করে চোখের জল মুছেন। একজন প্রবাসীর আত্মায় বাংলাদেশ নামের একটা দেশ নিত্য বেঁচে থাকে বলেই বাংলাদেশের প্রতি তাঁর সেই ভালোবাসার শক্তিটাকে খুঁজে পান। আর সে কারণেই বলতে কোনো দ্বিধা থাকে না যে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রত্যেক প্রবাসীই আমাদের একেকটি ছোট্ট বাংলাদেশ। একজন প্রবাসী যখন বলেন, ‘আমিই বাংলাদেশ’ অথবা তাঁর গাড়ির ওপর স্টিকারে যখন লেখা থাকে, ‘আমিই বাংলাদেশ’, তখন কথাটা শুনতে মোটেও অতিরঞ্জিত মনে হয় না। কারণ, আমিই বাংলাদেশ।