বিবর্ণ প্রকৃতি বিবর্ণ মন

‘আমাদের দেশ’ প্রবন্ধে দেশের প্রকৃতিই ছিল আমাদের কাছে প্রধান। এর বাইরে যে প্রকৃতি কত বিস্তৃত আছে, সে সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের মাত্রা ছিল না বললেই চলে। গল্প-উপন্যাসেও কতটা পড়েছি, বুঝেছি তা আমার ঠিক হয়তো মনেও নেই। বলা হয়ে থাকে বা মনে করা হয়, মানুষের বয়স বাড়লে সে প্রকৃতির প্রেমে ডুব দেয়। তবে সেদিন প্রায় ২০ বছর আগের পুরোনো ডায়েরি খুলে যমুনা সেতুর নিচের বর্ণনায় দেখেছি, সে দিনও আমি তেমন ছিলাম। আকাশ, বাতাস মৌসুম কেমন করে যেন প্রভাবিত করে বড়। তবে প্রকৃতির এক নয়, অনেক অজানা অধ্যায় আমি দেখেছি এই নিউইয়র্কে। সে যে কত বিশাল, তা এ দেশে না আসলে হয়তো জানা হতো না। গাছের পাতার রং কত বাহারী হতে পারে, তা না দেখলে বিশ্বাসই হতো না। সেই প্রকৃতির ছাপ আমি শুধু আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজের চোখে দেখি না, দেখি এই শহরের প্রতিটি মানুষের চোখে। প্রকৃতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানব মনে ঘটে এক আলোড়ন, হয় তো সেটা তেমন করে দেখা যায় না বা আমরা দেখি না। সাধারণ দৃষ্টিতে তা মৌসুমি অসুখ বলেই আমরা মেনে নেই। আসলে মানব মনেও ঝরে এই পতন, ঋতুর মতন অজস্র পতন। সুখও যেন অসুখ হয়ে ওঠে এমন বিবর্তনের ছোঁয়ায়।

আমেরিকায় ইংরেজি বারো শতাব্দীতে শরৎ ঋতুর প্রাধান্য শুরু হয়, চৌদ্দ শতাব্দী পর্যন্ত তাই ছিল বা একে বলা হতো অটাম কিন্তু এখন আর কেউ তা বলে না বা এ নামে এ দেশে কোনো ঋতু নেই। আছে ফল (fall) ‘পতন ঋতু’ মানে ইংরেজিতে যাকে ‘ফল সিজন’ বলে। ষোড়শ শতাব্দীর পর শুরু হয় এই ঋতু। প্রকৃতির ওপর ভিত্তি করেই সব মৌসুমের নাম রাখা হয়। কেন রাখা হলো আমার চোখে আজ শুধু তার কথাই বলব।

গ্রীষ্মের আমেজ, বসন্তের বাহার মানুষের দেহ মনকে ভরিয়ে রাখে চেরি ফুল, সব অজানা অসংখ্য ফুলের বাহারে। স্বল্পবসনা নারীরাও যেন রঙিন হয়ে ওঠে এক একটা ফুলের মতো। বাইরের তাপদাহ অনেকের প্রিয়, নিজের ফ্যাকাশে সাদা রং বাদামি করতে। ফ্লোরিডার সব সৈকতে বসে রৌদ্রস্নান। মায়ামি থেকে শুরু করে সব সমুদ্র বন্দর হয়ে ওঠে মুখরিত, রমণীয়। যুগলের হাঁট বসে ভালোবাসার পসরা নিয়ে, যেন উড়ছে ওরা। এ দেশে ৬০ শতাংশ মানুষ গ্রীষ্মের ছুটি উপভোগ করে, কারণ তারা জানে, তাদেরও সাইবেরীয় ভালুকদের মতো এক সময় হাইবারনেটিং-এ যেতে হবে। গুহায় থেকে জৈবিক ক্ষুধা মেটানো যায় বটে, কিন্তু মনের তৃপ্তির জন্য আকাশ–বাতাসের চেয়ে বড় কিছু যে নেই! তাই তারা কর্মব্যস্ত জীবনের কিছুটা সময় নিজের করে নেয় । শুধু এর জন্য তাদের আলাদাভাবে কিছু সঞ্চয়ও করতে হয়।

তারপর হঠাৎ করেই যেন প্রকৃতি বদলাতে শুরু করে। অক্টোবর মাস আসতে না আসতে শুরু হয় আকাশে-বাতাসে পরিবর্তন। বেশির ভাগ সময় আকাশ মেঘে ঢাকা, বিরহী রমণীর করুণ মুখ। হঠাৎ বৃষ্টি আসে ঠান্ডা ঝাপটা নিয়ে। সে বৃষ্টি ভালোবাসার কথা বলে না। এই ভালোবাসার জায়গাটা দখল করে নিয়েছে তীব্র শীতের তুষার। তাই বৃষ্টি এখানে গৌণ। ঝোড়ো হাওয়া তখন থেকেই শরীর মনে বিরূপ ভাব ফেলতে থাকে। প্রচণ্ড শীত সহ্য করার ক্ষমতা এ দেশের মানুষের আছে। কিন্তু উষ্ণতার পাশে হঠাৎ করে আসা শীতল হাওয়া প্রকৃতির মতোই যেন বিধ্বস্ত করে মানুষের মন। ঝলমলে নগরীও যেন কেমন বিষণ্ন হয়ে ওঠে। আর এটি আমি বিগত পাঁচ বছর ধরেই লক্ষ্য করেছি, হ্যালোইনের সঙ্গে সঙ্গে পুরো নগরী ঝোড়ো বাতাসে ভুতুড়ে হয়ে ওঠে। রাতের অন্ধকারে পথ চলতে কেমন গা ছম ছম করে। সব ভেজা গাছকে মনে হয় কোনো অশরীরী আত্মা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।

অক্টোবরের শেষ দিকে এক শনিবার, ভোর পাঁচটায় ঘর থেকে বের হয়ে দেখি, ঝড়ে এলোমেলো পথঘাট। সারা রাত করুণ রাগিণীর মতো বৃষ্টি হয়েছে। সবুজ সবুজ গাছের পাতা পড়ে ভরে গেছে পায়ে চলা পথ। নাকে মুখে এসে ঠান্ডা বৃষ্টির ঝাপটা লাগছে। তারপর এক সময় পৌঁছালাম রুজভেল্ট। আমি এবং আরও অনেক যাত্রী দাঁড়িয়ে আছি কিউ সেভেনটি বাসের জন্য। সাধারণ বিমান বন্দরের যাত্রী থেকে শুরু করে পাইলট কেবিন ক্রুসহ অন্যান্য বিভাগের অনেক। ঠান্ডা হাওয়া এসে ঝোড়ো কাকের মতো তরে তুলছে ক্রমশ। ‘লাইফ ইজ নট এ বেড অফ রোজেজ’ এখন বুঝি হাড়ে হাড়ে। অল্প বয়সী, বয়স্ক কর্মজীবী মানুষের জীবন এমন কাছে থেকে দেখলে বোঝা যায় জীবন কতটা কষ্টের! আবহাওয়া যাই থাক, কাজ করতে হয় সবাইকে। প্রচণ্ড শীত এক সময় সহ্য হয়ে, স্বাভাবিক হয়ে ওঠে, কিন্তু মৌসুমের এ বদল যেন জবুথবু করে দেয়। গাড়ির কাচ নামালেই শীতল বাতাস এসে স্পর্শ করে। বিন্দু বিন্দু জমা জল বড় উদাসী করে। কিসের এই উদাসীনতা? তা আমরা যেন জানি না। ব্যস্ত নগরীর মানুষ কষ্ট উপেক্ষা করে প্রকৃতির মতোই চলছে নিজের ভাগ্য বদলাতে। অথচ এমন ক্ষণে ইচ্ছে করে চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে গল্পের বই পড়তে।

মেঘে মেঘে এমন খেলার মাঝেই চলে আসে পতন ঋতু। বৃষ্টির পানির ছোঁয়া লাগার পর পাতাগুলোতে নামে এক অমোঘ পরিবর্তন, ফুলও এত রঙিন নয়। এরা যে রং ধারণ করে, ইচ্ছে হবে মুগ্ধ চোখে চেয়ে থাকতে। বৃষ্টির পর পর সূর্যের ছোঁয়ায় এই মৌসুমে নতুন করে আবির মাখে গাছগুলো। মনে হবে বসন্ত এসে কথা কয়। রবি বাবু কি এমন দৃশ্য দেখেই লিখছিলেন—

ওরে ভাই, ফাগুন লেগেছে বনে বনে–
ডালে ডালে ফুলে ফুলে পাতায় পাতায় রে,
আড়ালে আড়ালে কোণে কোণে॥
রঙে রঙে রঙিন আকাশ, গানে গানে নিখিল উদাস—
যেন চল-চঞ্চল নব পল্লবদল
মর্মরে মোর মনে মনে।।
হেরো হেরো অবনির রঙ্গ,
গগনের করে তপোভঙ্গ।
হাসির আঘাতে তার মৌন রহে না আর,
কেঁপে কেঁপে ওঠে খনে খনে।
বাতাস ছুটিছে বনময় রে,
ফুলের না জানে পরিচয় রে।
তাই বুঝি বারে বারে
কুঞ্জের দ্বারে দ্বারে
শুধায়ে ফিরিছে জনে জনে॥

শীতল হাওয়া উপেক্ষা করেও চলে আমাদের প্রকৃতি প্রেমের বিন্যাসে নিজেকে হারিয়ে ফেলার প্রয়াস। সুখও যেন অসুখ হয়ে ওঠে, নিজেকে দুঃখী রাখার মাঝেও যেন এক বিলাস কাজ করে, দুঃখ বিলাসী না হলে এ ঋতুর সৌন্দর্য কি স্পর্শ করবে প্রেমিক হৃদয়? সব আছে তবু কি যেন নেই এক গোপন প্রেমিকের মতো। দুঃখবোধই যেন ভালোবাসা। কিসের জন্য এ দুঃখ?

চোখের সামনে সুন্দর স্তরে সাজানো গাছগুলোর পাতা ফলের মতোই যেন পাকে, কখনো লাল, কখনো বেগুনি, তারপর তীব্র হলুদ তারপর উত্তাল বাতাসে ঝিরঝির করে পড়তে থাকে। খুব যৈবতী পাইন ছাড়া সব গাছের পাতা ঝরছে অঝোরে, একটু দাঁড়ালেই দেখা যায় বৃষ্টির মতো ঝরছে। প্রতিটা গাছে পাতাও থাকে বেশুমার। সেই সব পাতা পড়ে থাকে শুধু পত্রবিহীন বৃক্ষ, কি এক নিদারুণভাবে গাছগুলো যেন নিঃস্ব হয় যায়। প্রেমিক যেমন নিঃস্ব করে চলে যায়, এ প্রকৃতিও তেমন নিঃস্ব করে। এই পত্রপতনের জন্যই এই মৌসুমের নাম ফল। প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে ক্ষণিক বিরহ লেগে থাকে মানুষেরও চোখে মুখেও। বিবর্ণ প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে বিবর্ণ হতে থাকে মানুষের মন। চলতে খাতে প্রস্তুতি দীর্ঘ বিরহ, দীর্ঘ শীতের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার খেয়াল।

আজ ঝরে বনে বনে হলুদ সবুজ পাতার বাহার
হৃদয় করে হরণ দূর বিরহ প্রেমিকের মতন তাহার।