জানা কথার অজানা তথ্য

ভ্রমণের জন্য বা নিত্যদিনের অফিসের কাজে পাবলিক যানবাহনের চাহিদা অতি দ্রুতগতিতে বাড়ছে। আমরা যারা দেশের বাইরে থাকি তাদের সবাই পাতাল ট্রেন সম্পর্কে জানি। আমার নিজের দেখা এবং জানা কিছু বিষয় সবার সঙ্গে ভাগ করার উদ্দেশ্যে আজকের এই লেখা। আমরা যারা নিউইয়র্কে থাকি আমাদের নিত্যদিনের পথচলার একমাত্র ভরসা এই সাবওয়ে বা পাতাল ট্রেন এবং বাস। একটা রাইডের জন্য লাগে ২.৭৫ ডলার। একটা টিকিট কেটে আপনি পুরো শহর ঘুরে আসেন। নিউইয়র্ক ঘুরে দেখতে বা যেকোনো কাজে যেতে বেশির ভাগ মানুষই ট্রেনে চলাচলে পছন্দ করে। নিজস্ব গাড়ি থাকা সত্ত্বেও পার্কিংয়ের ভয়াবহ সমস্যার কথা চিন্তা করে অনেকে এই ট্রেন বা বাসে চলাচল করেন। হরেক রকম মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে আমাদের যাতায়াত করতে হয় এবং এই চলার পথে বিভিন্ন অভিজ্ঞতা অর্জন করি। প্রতিদিনের এই চলাচলের ক্ষেত্রে আমরা নানা রকম সমস্যা মোকাবিলা করি। আমি ট্রেনের মানচিত্রে নেভিগেশন করার মধ্যে মজাদার কিছু চ্যালেঞ্জ খুঁজে পাই। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট যেহেতু আমাদের নিত্য প্রয়োজন সেহেতু আমরা যদি আমাদের কিছু জানা বিষয় একটু ঝালাই করে নিই তাহলে মন্দ হয় না। আমি মনে করি যে পাবলিক পরিবহনে চলাচলের কিছু নির্দিষ্ট নিয়মাবলি রয়েছে। এগুলো সবাই যদি অনুসরণ করি তাহলে চলার পথে অযথা হয়রানি হতে হয় না। মিশ্র সাংস্কৃতিক যুগে এ দেশের মানুষ যত শিক্ষিত হোক না কেন জাতিগত ও ধর্মীয় বিভেদ এবং গায়ের রঙের বিভেদ স্পষ্ট চোখে পড়ে যখন আমরা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করি। সে সবকিছু মাথায় রেখে আজকে ভাবছি কিছু জানা কথা নতুন করে বলি।

শিশুদের সঙ্গে ভ্রমণ
একটি বিষয় পরিষ্কার যে সন্তানেরা পিতামাতার ভ্রমণের স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ করে না। ছোট শিশুদের সঙ্গে ভ্রমণের সময় আপনাকে অনেক ধৈর্য ধরতে হবে। ছোট শিশু আপনার সঙ্গে থাকুক বা অন্য কারও সঙ্গে থাকতে পারে। উভয় ক্ষেত্রেই আমাদের সহানুভূতির পরিচয় দিতে হবে। কেউ যদি ছোট বাচ্চা নিয়ে ট্রেন বা বাসে ওঠেন সেই শিশুকে বা তার মাকে প্রয়োজনে নিজে উঠে বসার জায়গা করে দিতে হবে। আপনার বাচ্চার স্ট্রলার বা ব্যবহার্য কোনো জিনিস যেন কারও গায়ে না লাগে সে দিকে নজর রাখতে হবে। হয়তো আপনি মনোযোগ দিয়ে কোনো কিছু পড়ছেন সে সময় কোনো বাচ্চা যদি কান্নাকাটি বা অস্থিরতা সৃষ্টি করে তাতে আপনি যদি বিরক্ত হোন তাহলে খুবই বাজে দেখাবে, আবার পরিস্থিতিটি সামাল দেওয়ার জন্য অযথা পরামর্শ দেওয়া থেকে বিরত থাকুন। বাচ্চার মা-বাবা যদি আপনার কাছে সাহায্য চায় সে ক্ষেত্রে করা যায়। তবে তা হতে হবে অন্যকে বিরক্ত না করে। কান্না থামাতে কোনো অবস্থাতেই পকেট থেকে চকলেট বা বিস্কুট বের করে বাচ্চার হাতে দেবেন না।

অসুস্থ হলে
আমরা মানুষ। তাই অসুস্থতাকে আমাদের মেনে নিতেই হয়। কোনো মতেই অসুস্থতাকে এড়িয়ে চলা যায় না। খুব বেশি অসুস্থ বোধ করলে আমার মতে ঘর থেকে বের না হওয়াই সমীচীন। কিন্তু হালকা অসুখে আমরা পাত্তা দিই না বা যারা এ দেশে বাস করি আমাদের শরীর খারাপ নিয়েও অনেক সময় কাজের জন্য বের হতেই হয়। আমরা হাঁচি-কাশি-সর্দিজ্বর, পেট খারাপ নিয়েই ট্রেন বা বাসে চড়ি। এ ক্ষেত্রে আগে থেকেই প্রস্তুত হয়ে আসুন। অবশ্যই মনে করে সঙ্গে যথেষ্ট পরিমাণে রুমাল বা টিস্যু পেপার, পলিথিন ব্যাগ, পানির বোতল ও হ্যান্ড সেনিটাইজার নিয়ে বের হবেন। যতটুকু সম্ভব একটু আলাদা বসার চেষ্টা করবেন। তবে অফিস টাইমে আলাদা বসার কথা ভাবা অমূলক। যথাসম্ভব মুখে রুমাল দিয়ে কাশতে চেষ্টা করবেন। ট্রেনে-বাসে হাঁচি দেওয়া আমরা সব সময়ই ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখি। তাই হাঁচি দেওয়ার সময় অবশ্যই মুখে হাত দিতে হবে এবং হাঁচি শেষে ‘এক্সকিউজ মি’ বলতে ভুলবেন না । হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় যদি কোনো কিছুই আপনার হাতের কাছে না থাকে চেষ্টা করবেন নিজের মুখকে নিজের শার্ট বা জামার ভেতরে নিয়ে নিতে। চলার পথে অনেককেই দেখতে পাই এমন খোলা হাঁচি-কাশির জন্য বিব্রত হতে। তাই হাঁচি দেওয়ার সময় সাবধানতা অবলম্বন করুন। একটু সাবধান হলেই আমরা এটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। ঠিক তেমনি পাশে যদি অসুস্থ যাত্রী থাকে তার থেকেও একটু আলাদা হয়ে বসতে পারি। কারণ সবাই জানি হাঁচি-কাশির মাধ্যমে জীবাণু আমাদের শরীরে প্রবেশ করবে। পরে আমার মাধ্যমে আমার পরিবারে ছড়াবে। পাশের অসুস্থ যাত্রীকে গায়ে পরে সাহায্য করতে যাওয়া বোকামি হবে। কারণ এ দেশের মানুষকে সাহায্য করতে গেলে তারা বেশির ভাগ সময়ই বিরক্ত হয়। নিতান্তই কিছু করার না থাকলে পাশের অসুস্থ যাত্রীর প্রতি সহানুভূতির দৃষ্টি দেখানোর চেষ্টা করুন। ট্রেনে কোনো যাত্রী যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে সে ক্ষেত্রে তাকে ভিড় করে দেখার দরকার নেই, যদি অন্য যাত্রী না থাকে তখন আপনাকে ট্রেন কর্তৃপক্ষকে কল দিয়ে সাহায্য করতে পারেন। কোনো সময়ই অতি ভালো মানুষী দেখাতে গিয়ে অসুস্থ যাত্রীর সঙ্গে নিজে অ্যাম্বুলেন্সে উঠে পড়বেন না। কারণ এ দেশে রোগীর সঙ্গে কাউকে দরকার হয় না। এসব উপকার করতে গিয়ে আপনার কাজের দেরি হতে পারে এবং আপনার অযথা হয়রানির শিকার হওয়ার সুযোগ থেকে যায়।

বৈদ্যুতিক যন্ত্র ব্যবহার
ইলেকট্রনিক ডিভাইস জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। সব ধরনের আধুনিক সুবিধা আমরা পাই ল্যাপটপে বা আইফোনে। তাই ঘর থেকে বের হওয়ার সময় আপনার ফোনটি সঙ্গে রাখতে ভুলবেন না। ট্রেন বা বাসে অন্য কারও মোবাইল ফোন বা ল্যাপটপে কিছু পড়ার বা দেখার চেষ্টা করবেন না। এটা বড্ড অশোভন দেখায়। দেশে আমরা বাসে, ট্রেনে এক পেপার কয়েকজনে পড়ার অভ্যাস আছে। মনে রাখবেন এখানে এটা একদমই দৃষ্টিকটু। অনেক ট্রেন, বাসে কর্তৃপক্ষ এ ধরনের সচেতনতামূলক পোস্টার দিয়ে থাকে। তাই চেষ্টা করতে হবে এসব নিয়ম মেনে চলতে। যাত্রাপথে গলার আওয়াজ সংযত করতে হবে। লং ডিসটেনস কল আসতেই পারে। দেশ থেকে সুখবর বা দুঃসংবাদের খবর মোবাইলে ফোনেই আসে। তাই বলে গলা ছেড়ে কথা বলা বা হাসা থেকে বিরত থাকুন। আপনার উচ্চস্বরে হাসা এবং কথা বলা অন্য যাত্রীর বিরক্তির কারণ হতে পারে। জরুরি কিছু হলে আপনি নেক্সট স্টপেজে নেমে গিয়ে কথা শেষ করে আবার ট্রেন চড়তে পারেন। আমি এফ ট্রেন থেকে এক বাঙালি যাত্রিকে নামিয়ে দিতে দেখেছি। কারণ উনি আহাজারি করে কান্না করছিলেন। পরে কথা বলে জেনেছি, ফোনে খবর এসেছে যে তাঁর মা মারা গেছেন। তাই তাঁর সঙ্গে কষ্টে-দুঃখে আমিও নেমে গেছি। আমি বুঝেছি তাঁর বিলাপের কারণ। কিন্তু বাকি যাত্রীরা খুবই বিরক্ত হচ্ছিল। তাই যাত্রাপথে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে চলতে গেলে নিজের আবেগকে সংযত করা জরুরি। ট্রেন বা বাসে কারও সঙ্গে ভিডিও কল করা থেকে বিরত থাকুন অথবা নিজেকে আড়ালে নিয়ে যান। সুন্দরী মেয়ে বা ছেলে দেখলে তার ছবি তুলবেন না। অযথা কোনো কিছুর ভিডিও করবেন না। আজকাল ফ্যাশন হয়ে গেছে স্থান, কাল বিবেচনা না করেই আমরা সেলফি বা নিজের ভিডিও করতে থাকি। আমরা বুঝতে চাই না এ ধরনের কাজে পাশের মানুষ বিরক্ত হচ্ছে কি না। সবাই দেখে অভ্যস্ত সামারে এ দেশের মানুষ স্বল্প বসনে থাকে। মেয়েরা ছোট জামা-কাপড় পরে। সমুদ্রে যায় বিকিনি পরে। অনেক সময় ট্রেনে যাতায়াত করে। এমন সময় আপনার অতি উৎসাহী সেলফি আপনার জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। অনেকে ল্যাপটপের ব্যাক ক্যামেরায় ছবি তোলার চেষ্টা করেন। তা মোটেও উচিত নয়। এই ধরনের ঘটনায় আপনার পাশের যাত্রী আপনাকে পুলিশে ধরিয়ে দিতে পারে। আপনার দৃষ্টিভঙ্গি যেন সুন্দর হয়। কখনো ঝুঁকে মেয়েদের দেখার চেষ্টা করবেন না।

আগে নামতে দিন
এটা আমরা সবাই জানি যে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে আগে যাত্রীদের নামতে দিতে হয়। যাঁরা নামবেন তাঁদের প্রাধান্য আগে। যাঁদের সঙ্গে বেবি থাকে তাঁদের সঙ্গে স্ট্রোলার থাকে, তাই নামতে একটু বেশি সময় লাগতেই পারে। যাঁদের সঙ্গে বড় রোলার ব্যাগ থাকে তাদেরও নামতে সময় লাগে। তাই ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করতে হবে। দরজা দিয়ে সবার নামা শেষ হলেই আপনার ওঠার পালা। তাড়াহুড়া করে উঠতে গিয়ে কারও গায়ে যেন ধাক্কা না লাগে সে দিকে নজর দিতে হবে। না চাইতেও অনেক সময় অন্যর গায়ে যদি ছোঁয়া লেগে যায় তাহলে সরি বলতে ভুলবেন না। অন্যকে ধাক্কা দিয়ে বসার জন্য সিট খুঁজবেন না। হুইল চেয়ারসহ সিনিয়র সিটিজেন, গর্ভবতী বা ছোট শিশুসহ মাকে আগে নামতে দিন। নামা বা ওঠার সময় কোনো অবস্থাতেই যেন কোনো নারীর গায়ে আপনার হাত না লাগে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

যাদের সত্যিকারের প্রয়োজন
যাদের বসার সিট সত্যিকার দরকার তাদেরই আপনার সিটটা ছেড়ে দিন। এমন একটি মৌলিক মানবিক সমবেদনা দেখান যা দিয়ে মানুষ আপনাকে মনে রাখবে সারা জীবন। আপনি যদি দেখেন এমন একটি পরিবার বা গ্রুপ যারা একসঙ্গে বসতে চাইছে তাদের সঙ্গে আপনার সিট ছেড়ে দেওয়া বা ট্রেডিং করার কথা বিবেচনা করুন। আপনি যদি কোনো পরিবারকে সাহায্য করার জন্য স্থানান্তর হতে ইচ্ছুক হন আপনাকে সবাই সম্মানের চোখে দেখবে। কাজটা ছোট হতে পারে কিন্তু অল্প সময়ের জন্য হলেও আপনি নিজের কাছে এবং সবার কাছে সুপার হিরো হয়ে যাবেন। যদি দেখেন বাসটি বা আপনার কামরাটি মানুষে পূর্ণ সে ক্ষেত্রে বয়স্ক ও অন্তঃসত্ত্বা নারীদের আপনার আসনটি অফার করুন।

ডানে দাঁড়ান, বায়ে হাঁটেন
এটা অত্যন্ত জরুরি বিষয় যা কিনা আমরা কোনো সময়ই খেয়াল করি না। আমেরিকায় না এলে হয়তো জানতামই না যে এখানে ট্রাভেল করার সময় হাঁটতে হয় বাম দিকে। যদি সঙ্গে লাগেজ থাকে ও কোথাও দাঁড়াতে হয় তাহলে লাগেজ বাম দিকে নিয়ে নিজে ডান সাইডে দাঁড়াবেন। বিষয়টা আমরা কখনোই মনে রাখি না বা কখনো অনুশীলনও করা হয় না। আমাদের দেশে এর কোনো দরকার পরে না। আমরা রাস্তায় বের হয়ে এলোমেলো হেঁটেই অভ্যস্ত। আপনি খেয়াল করে দেখবেন হাঁটার সময় এ দেশের মানুষ এ নিয়ম মেনেই হাটে। আরও খেয়াল করে দেখবেন এস্কেলেটরে যারা হাটতে চায় না, তারা ডান দিকে দাঁড়িয়ে থাকেন বাঁ দিকটা খালি রাখেন যাতে করে যাদের তাড়া থাকে তারা যেন নিমেষে হেঁটে যেতে পারে। আর সিডি ভাঙার সময় সবাই বামে লাইন ধরে হাটে। একবার টাইম স্কয়ার ৪২ স্ট্রিটে সিডি দিয়ে ওঠার সময় খুবই বাজেভাবে এক মাঝ বয়সী লোক তার বাম কনুই দিয়ে আমাকে ঘেঁষে নেমে যায়। আমার লজ্জায় কান্না পেয়ে যায়। এমন অবস্থায় একজন নারী আমার কাছে এসে বলেন, তুমি ভুল সাইড দিয়ে উঠেছ। তখন খেয়াল করলাম আমার সাইডে আমি ছাড়া আর কেউ নেই সবাই বাম সাইড দিয়ে লাইন ধরে উঠছে। তখন আরও বেশি লজ্জিত হই। যা বলছিলাম এসব তেমন মনে রাখার বিষয় নয়। চলার পথে এ বিষয়গুলো খেয়াল করে চললে হয়তো আমার মতো লজ্জিত হতে হবে না।

আমাদের সামান্য সচেতনতা যাত্রা পথ সুন্দর করে। দেশের বাইরে বসবাসের ক্ষেত্রে এসব ছোটখাটো বিষয়ে নিজেকে সুন্দর করে উপস্থাপন করাও একটা বড় তৃপ্তি। আমাদের কাছ থেকে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম শিখবে। যদিও এসব সর্বজনীনভাবে অনুশীলন করা হয় না, তবে এগুলো সম্পর্কে সচেতন হওয়া জরুরি।