বাংলাদেশ ভ্রমণ ও বিমানের গল্প

প্রবাসে আসার এক সপ্তাহের ভেতরে আমি বুঝে নিই এই দেশে আমার হবে না, তার অন্যতম কারণ ছিল ঠান্ডা! যদিও আমি ঠান্ডার সময়টা বেশি পছন্দ করি। তারপর আস্তে আস্তে ঠিক হয়। কিন্তু প্রতিটা ডিসেম্বর এলেই ইচ্ছা করে চলে যাই। প্রতিবার দেশে যাওয়ার পরিকল্পনা করেও দেশে যেতে পারি না, এইবার হবে। কারণ এইবার অনেক শক্ত কাগজ আছে! একেবারে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন নিয়ে হাজির। আমার দাঁতে ব্যথা। একটা দাঁত রুট কেনেল করতে ৮০০ ডলার ব্যয় হয়েছে আরও ২টা দাঁতে একই সমস্যা আছে। এখানে চিকিৎসা (আমেরিকা) করতে যে টাকা ব্যয় হবে তা দিয়ে বাংলাদেশ থেকে ঘুরে আসতে পারব। সঙ্গে দাঁতের চিকিৎসাতো হবেই।

৪ বছর ৬ মাস পর দেশে যাব। প্রচুর শপিং করেছি। আমার একটা বাড়তি লাগেজ হয়ে গেছে। ২ টা লাগেজ নেওয়া যায়, আমি নিয়েছি ৩ টা। একটা হাতের ব্যাগ আর ল্যাপটপের ব্যাগ, মোট ৫ টা। প্লাস্টিক ব্যাগে সঙ্গে করে নিয়েছি আর অনেকগুলো কসমেটিকস যদি দয়া করে নিতে দেয়! না দিলে আমার বন্ধু ইয়াছিন এর কাছে দিয়ে যাব।
ফ্লাইট ১০: ৩০ আমি পৌঁছালাম ৮:৪০এ! এমিরেটস এয়ারলাইনসের আপাকে বুঝিয়ে বললাম আমার আলাদা কিছু জিনিস আছে। উনি কয়েক সেকেন্ড আমার দিকে তাকালেন, আমি যতটা সম্ভব অসহায় ভাব দেখালাম। এই মুহূর্তটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, কয়েক সেকেন্ড পর উনি বললেন ঠিক আছে আপনার সবকিছু দেন। হ্যান্ড ব্যাগের ভেতরে দেন। এইটার জন্য কোনো এক্সট্রা চার্জ হবে না, আপনি যেহেতু একটা এক্সট্রা লাগেজ নিচ্ছেন সেইটার জন্য আপনাকে ১৭৫ ডলার দিতে হবে। আলাদা ব্যাগে যা নিয়েছিলাম তা সব হ্যান্ড ব্যাগে ঢোকালাম।
এক্সট্রা লাগেজের পেমেন্ট দেওয়ার জন্য আলাদা লাইনে আছি। হঠাৎ মনে হলো আরে আমার ডলার। আমার ডলারতো হ্যান্ড ব্যাগে। আর তাঁরা বলেছে, এই ব্যাগ আমি পাব বাংলাদেশে গিয়ে, দৌড়ে গেলাম আবার তাদের কাছে, এখন যত অসহায় হই না কেন কাজ দেবে না। বড় একজন অফিসার এলেন উনি বললেন আমার ব্যাগ এখন বিমানে এটা আবার ফিরত আনতে অনেক সময় লাগবে আর এটা নিশ্চিত আমার ফ্লাইট মিস হবে। ফ্লাইট মিস করা যাবে না, যে কারণে আমি চিন্তিত তা হচ্ছে বাংলাদেশে অনেক লাগেজ চুরির ঘটনা হয়! যদি আমারটা...?

বিমানে বসে আছি। অনেকগুলো চ্যানেল আছে টিভি স্ক্রিনে। দেখতে লাগলাম কী কী আছে।
বাংলা কিছু গান আছে, গানগুলো বেশি পরিচিত না, মন ভরতাছে শুনে। বাংলা অনেক ভালো ভালো নাটক আছে, এগুলো থাকলে ভালো হতো অথবা ভালো বাংলা ছবি।
যথেষ্ট ক্লান্ত ঘুমাতে হবে।

দুবাইতে পৌঁছালাম স্থানীয় সময় রাত ১২ টার দিকে। দুবাই বিমান বন্দর আধুনিকতা ও পরিচ্ছন্নতায় ভরপুর। এত দিন আমেরিকা বসবাস করার পরও আমি কখনো ম্যাকডোনাল্ডসে খাই নাই। দুবাইয়ে খাওয়া যেতে পারে এখানে সব হালাল। একবার এর জায়গায় ৩ বার খেলাম ৯ ঘণ্টায় ৩ বার খাওয়া ব্যাপার না। কয়েক বছর আগে আমি আর আমার বন্ধু লিটন চন্দ্র দাস চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগে আমরা তিন দিনের খাবারের বাজেট করেছিলাম ১৮০০ টাকা। বাসা থেকে ট্রেন স্টেশন যাওয়ার আগে পরোটা ভাজি নাশতা ৫০ টাকা। ট্রেনে হাবিজাবি ১০০ টাকা। যাওয়ার পথে চা ৬ বার ৬০ টাকা। দুবাই বিমান বন্দরকে সব দেশের ট্রানজিট পয়েন্ট মনে হচ্ছে। অনেক অনেক মানুষ।

Duty free দোকানগুলোতে মানুষের উপচে পড়া ভিড়, স্বর্ণের দোকানে প্রচুর মানুষ। মানুষ অনেক শপিং করছে, আমি কেন করব না? আমি কিনলাম ২ কার্টন সিগারেট। সিগারেট কোনো মানুষের জন্য গিফট হতে পারে? তবুও আমি কিনলাম কারণ একজন বিশেষ মানুষ অনুরোধ করে বলেছেন। আর কিনলাম অনেকগুলো চকলেট নিউইয়র্ক থেকে অনেক কেন্ডি কিনেছি এখানে আবার সস্তা পেয়ে বরে নিলাম বস্তা। বিমানে ওঠার পর মনে হলে এটা বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। আমার সামনে পেছনে সব দিকে বাংলাদেশি মানুষ। এমিরেটস এয়ারলাইনসের কেবিন ক্রুরাও বাংলাদেশি।

দুবাই থেকে বাংলাদেশ আনুমানিক ৫ ঘণ্টার পথ। আমার পাশের ২ সিটে বসেছেন ২ জন মহিলা। আমার একেবারে পাশে যিনি বসেছেন উনি কিছুক্ষণ পর বললেন ভাই আপনি দুবাই থাকেন?
আমি বললাম না আপু আমি নিউইয়র্কে থাকি।
উনি বললেন ইউরোপ?
আমি: না আপু এটা আমেরিকা।
আমি জিজ্ঞাসা করার আগেই উনি বললেন উনি মরিশাস থেকে দেশে যাচ্ছেন। সেখানে কাজ করেন।

আমার সামনে যিনি বসেছেন ওনার নাম স্বপ্না। ওনার পাশে বসেছেন ওনার খালা। আমি স্বপ্না আপাকে জিজ্ঞাসা করলাম আপনারা দুজনই মরিশাস থেকে? উনি বললেন, শুধু আমরা না, এই বিমানে আমরা ৪৬ জন আছি, আমরা সবাই একই কোম্পানিতে কাজ করি।
আমি বললাম বাহ! তাইলেত খুব ভালো! সবাই একসাথে যাচ্ছেন। আপু আপনি কয় বছর পর যাচ্ছেন দেশে?
স্বপ্না আপু: ২ বছর হবে?
আমি জানতে চাইলাম দেশে আপনার কে কে আছেন? স্বপ্না আপু: ২ বোন, ১ ভাই আমার মা আর আমার একটা ছেলে। আমি: আপনার ছেলে? আপনার একটাই ছেলে? আপনার স্বামী?
স্বপ্না আপু: নিশ্চুপ! কোনো একটা অদ্ভুত কারণে স্বপ্না আপু ওনার স্বামীর কথা বলতে চাচ্ছেন না।
স্বপ্না আপু বলতে লাগলেন জানো ভাই আমার ছেলের জন্য আমি দেশে যাচ্ছি। গত কোরবানি ঈদে তাকে বলেছিলাম আমি দেশে যাব তাকে নিয়ে বেড়াতে যাব। আমার ছেলের খুব পছন্দ করে কোরমা-পোলাও। সে খুব শখ করছিল তা কোরবানি ঈদে খাবে। আমি বললাম কেন তাকে কেউ দেয় নাই? আপনারতো ২ জন বোন আছেন।
স্বপ্না আপু: আছে, তারপরও ভাই কোরবানির ঈদ। স্বপ্না আপুর ছেলের নাম সৌরভ। বয়স ৯ বছর।

স্বপ্না আপুর খালা আমাকে বললেন, ‘তুমি কী কর বল। আমাদের তুমার অ্যামরিকার কথা বল। এখানেত তুমরা খুব সুখি? বেশির ভাগ মানুষ মনে করে আমেরিকা মানে স্বর্গ, আসলেই কি তাই? স্বপ্নের দেশ! কোনো কষ্ট নাই শুধু আরাম আর আরাম।’
আমি আমার নিজের সম্পর্কে, নিজের পরিবার সম্পর্কে বলতে লাগলাম খুব আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলাম, ‘আমার পেছনে সামনে ও বাম দিকে সবাই খুব আগ্রহ নিয়ে শুনতাছেন। আমেরিকা মানেই যে স্বর্গ না এটা আমি তাঁদের বোঝানোর চেষ্টা করেছি জানি না কতটা সফল। আবার এটাও সত্য আমেরিকা স্বপ্নের দেশ।’
স্বপ্না আপু আবার বলতে লাগলেন ওনার এক বোন সবার ছোট, ওনার বাবা নাই আর ভাইটা প্রতিবন্ধী। ওনার মাও খুব সুস্থ না। আরেকটা যে বোন আছে তার কথা আর নাই বললাম। খারাপ মানুষের সঙ্গে চলাফেরা। কী খারাপ তা আমি জানতে চাই নাই!

স্বপ্না আপু বলে যাচ্ছেন ওনার ছেলের কথা আর আমি মনোযোগ দিয়ে শুনতাছি। ‘আমি আজকে বাসায় গিয়ে আমার ছেলের জন্য রান্না করব, সে যা পছন্দ করে আর কালকেই তাকে বেড়াতে নিয়ে যাব।’ আমি ওনাকে বললাম আপু আমিও ভোজন-রসিক একজন মানুষ। উনি বললেন, ‘ভাই, তুমরা কি বুঝবা ইউরোপ-অ্যামেরিকাতে থাক, আমাদের কাছে পেট ভরে ভালো কিছু দিয়ে ভাত খাওয়াটাই অনেক বড় কিছু। তারপর আল্লাহর কাছে শুকরিয়া খুব ভালো আছি।’
পেট ভরে ভাত খাওয়াটাই অনেক বড় কিছু। আমার এই ২৪ বছর বয়সে আমি এখনো আমার পছন্দ অনুযায়ী রান্না না হলে খাই না!! এত কিছু পাওয়ার পরও সৃষ্টিকর্তার কাছে বারবার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি না।

স্বপ্না আপু কিছু সময় পর ওয়াশ রুমে গেলেন আর ওনার খালা আমার সামনে এসে বললেন স্বপ্নার স্বামী নেশা করে!! একদিন হঠাৎ স্বপ্নাকে ফেলে চলে গেছে যাওয়ার সময় স্বপ্নার জমানো অনেক টাকা আর একটা স্বর্ণের চেইন ছিল তাও নিয়ে গেছে।
অদ্ভুত! জগৎ সংসার বড়ই অদ্ভুত। স্বপ্না আপু ওয়াশ রুম থেকে আসার পর মোবাইলে ফোনে ওনার ছেলের ছবি আমাকে দেখাতে লাগলেন আর বলতে লাগলেন কোনটা কোন বয়সের। বিমান থেকে নামার আগে ওনাদের সবার ইমিগ্রেশনের যে কাগজ আছে সেটা লেখার জন্য বললেন, আমি আনুমানিক ১৩ জনেরটা লেখেছিলাম! কোন দেশ থেকে আপনি এসেছেন এইটার জায়গায় যখন মরিশাস লেখতে যাব অবাক হয়ে লক্ষ করলাম আমি মরিশাস বানান লেখতে পারতাছি না ৯ম শ্রেণিতে যখন পড়ি তখন বাংলা পরীক্ষা দেওয়ার সময় আমি অনেক কষ্ট করে ‘তৈরি’ বানান মনে করতে পারি নাই। তৈরি লেখার জায়গা খালি রেখে পেপার জমা দিয়ে আসি। অনেক খুঁজে একজনের কাছে একটা কাগজ পেলাম যেটাতে মরিশাস লেখা আছে ইংরেজিতে। বাংলাদেশে নামার পর দুবাই বিমান বন্দর থেকে যে কেন্ডি কিনেছিলাম তা স্বপ্না আপুকে দিয়ে বললাম এইটা আপনার সৌরভকে দেবেন।

মাত্র ১২ দিন দেশ ভ্রমণ শেষে আমেরিকা আসার জন্য হজরত শাহজালাল (রা.) আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে বসে আছি। বাংলাদেশের বিমান বন্দর সম্পর্কে অনেক কিছু লেখা যাবে আপাতত এখন শুধু বিমানের গল্প লেখি। আমার ফ্লাইট ঢাকা থেকে সন্ধ্যা ৭টায়। আমার সঙ্গে আছেন আমার এক বোন। কিছুদিন আগে ওনার অপারেশন হয়েছে উনি হুইলচেয়ারে যাচ্ছেন তাই ওনার বেশির ভাগ ব্যাগ আমার কাছে।

সঠিক সময়ে যাত্রা শুরু করলাম। ঢাকা থেকে দুবাই বেশির ভাগ সময় বোনের সঙ্গে গল্প আর ঘুমে কাটল। দুবাই থেকে এমিরেটস এয়ারলাইনসের ফ্লাইটে নিউইয়র্ক ফিরছি। দুবাই থেকে নিউইয়র্ক যেতে সময় লাগে প্রায় ১৪ ঘণ্টা। আটলান্টিকের ওপরে যাবে বিমান তার আগ মুহূর্তে ঘোষণা মেডিকেল ইমার্জেন্সির জন্য ফ্লাইট নিউইয়র্ক পৌঁছাতে দেরি হবে। বিমানের ম্যাপে এতক্ষণ দেখলাম নিউইয়র্ক এখন পরিবর্তন হয়ে এসে গেছে Oslo. বারবার বলছে, মেডিকেল ইমার্জেন্সির জন্য আমরা দুঃখিত। Norway এর রাজধানী Oslo তে অনেক বার চেষ্টা করল নামতে বিমান কিন্তু কী কারণে বারবার ঘুরে অন্য দিকে চলে যায়। জানালার পাশে বসে থাকার জন্য বারবার আমি অনুভব করছি বিষয়টা ও দেখছি। এইভাবে অনেক বার চেষ্টা করেও কী কারণে আর নামতে পারল না বিমান। তারপর আবার ঘোষণা আসল বিমান নরওয়েতে নয় ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে নামবে।

আমার সামনে বসে ছিলেন ভারতের দুজন বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ। স্বামী-স্ত্রী যাচ্ছেন নিউইয়র্কে ছেলের কাছে। প্রথম থেকেই ওনারা আমাকে বেটহে (বাপ) বলে যাচ্ছেন। কথাবার্তা খুবই আন্তরিক। আমি বারবার আমার সিট থেকে উঠে পেছনে যাচ্ছি। কারণ আমার সঙ্গে সিলেট থেকে আমার একজন আত্মীয় ছিলেন। ওনার সিট পড়ছে বেশ পেছনে আর আমরা সিট পরিবর্তন করতে পারি নাই।

আমি বসেছি ডানদিকে জানালার পাশে আর তাঁরা আমার বাম দিকে ২ সিটে। যতবারই আমি উঠে দাঁড়াই ততবার তাঁরাও উঠে দাঁড়ান আমাকে পথ দেওয়ার জন্য। আমি বিনয়ে সঙ্গে বললাম আঙ্কেল আপনারা কেউ জানালার পাশে চলে যান। তাঁরা বললেন না তাঁদের বারবার বাথরুমে যেতে হবে। আমাকে জানালার পাশেই বসতে হলো। বিমানে যখন খাবার দেওয়ার সময় হলো, আমি দেখলাম সর্ব প্রথম তাঁদের খাবার দেওয়া হলো। সাধারণত যাদের আলাদা কোনো অর্ডার থাকে তাদের আগে দেওয়া হয়, যেমন বাচ্চাদের খাবার সবার আগে দেওয়া হয় এবং যাদের আলাদা কোনো মেনু থাকে তাদের সর্বপ্রথম খাবার দেওয়া হয়। তাদের খাবার অন্য রকম।

মনের কৌতূহল থেকে আমি জিজ্ঞাসা করে বসলাম খাবার সম্পর্কে। এটা হচ্ছে স্পেশাল অর্ডার। তাঁরা হচ্ছেন জৈন ধর্মাবলম্বী। একশত ভাগ নিরামিষভোজি। হ্যাঁ, নিরামিষভোজী আর এতটাই ধর্মপরায়ণ যে দুজনে জীবনে কোনো দিন পেঁয়াজ খান নাই। আচ্ছা পেঁয়াজ কি আমিষ? আমার জানা নাই, কিন্তু কথার মাঝখানে তাঁরা বলেছেন জীবনে কোনো দিন তাঁরা পেঁয়াজ খান নাই। একজনের বয়স ৯৬ বছর আর আরেকজনের ৮৭। জীবনে কোনো দিন তাঁরা আমিষ জাতীয় কোনো খাবার খান নাই। একটি বার টেস্ট করেও দেখেন নাই। খাবারের প্রতি আমার বিশেষ দুর্বলতা আছে সব সময়। আসলে মুখে যেমন বলা হয় বাস্তবে তা নয়। বাংলাদেশে অত্যন্ত জনপ্রিয় অনেক খাবার আছে যা আরাম করে খাওয়াত দূরের কথা একটু স্বাদটা কেমন তাও কোনো দিন পরীক্ষা করে দেখি নাই। আমি মনে করেছিলাম, আমি মনে হয় খুব ভিন্ন কিন্তু আমার ধারণা ভুল করলেন তাঁরা। যা হোক যখন তাঁদের খাবার দেওয়া হলো তখন আমি কয়েকবার তাকিয়েছি খাবারের দিকে। তাই দেখে তাঁরা বললেন একবার দেখতো খেয়ে কেমন লাগে, একেবারে নিরামিষ খাবার। আমি না করা সত্ত্বেও তাঁরা বলছেন তাই অরেঞ্জ জুসটা নিলাম। তাঁদের কথা বার্তায় মনে হচ্ছে তাঁরা খুবই আপন মানুষ আমার। মনে হচ্ছে বহু বছর ধরে তাঁদের সঙ্গে আমি আছি।

ভারতের হায়দরাবাদ থেকে তাঁরা যাচ্ছেন নিউইয়র্কের জ্যামাইকাতে ছেলের কাছে। এবারই প্রথম নিউইয়র্কে। কিন্তু কথা বলে মনে হচ্ছে নিউইয়র্কে এর আগে গিয়েছেন। শুধু নিউইয়র্ক সম্পর্কে নয় অনেক বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান রাখেন তাঁরা। ভারতীয়রা আমাদের চেয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে, সত্যি অনেক এগিয়ে। বিমানে যখন জরুরি অবতরণের জন্য লেখা আসল Oslo তাঁরা বলে দিলেন Oslo হচ্ছে নরওয়ের রাজধানী। শুধু যে Oslo তা নয় বিশ্বের অনেক দেশ সম্পর্কে অনেক জিনিস সম্পর্কে যথেষ্ট জানা আছে তাঁদের। যা আমি কল্পনাও করি নাই। যে মহিলা বিমানে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তাঁকে অবশ্যই অতি দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। তাঁর ডায়াবেটিস খুব বেড়ে গেছে। পুরুষ মানুষটি তাঁর স্ত্রীকে বুঝিয়ে বলছেন কেন এই রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে এবং কী রোগ ইত্যাদি।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম আপনি কি ডাক্তার? তিনি বললেন না, তবে তিনি অনেক অনেক ডাক্তারি বই পড়েন এই বিষয়টা তাঁর সবচেয়ে পছন্দের। তিনি পেশায় একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। পড়ালেখা করেছেন ফিজিকসে। প্রচুর বই পড়েন। আমাকে তাঁর ব্যাগ দেখিয়ে বললেন সঙ্গে অল্প কয়েকটা বই আছে। তাঁর ছেলে না কি বলেছেন নিউইয়র্কে অনেক বই তাঁর জন্য রেডি করে রেখেছেন।

ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে নামার পর আমি অনুভব করলাম আমার মাথা খুব বেশি ব্যথা করছে। বাইরের আলো বাতাস থেকে দূরে আছি প্রায় ১২ ঘণ্টা। বিমানে ঘোষণা আসছে বারবার-
অল্প কিছুক্ষণের ভেতরে Ek 201 নিউইয়র্কের উদ্দেশে আবার যাত্রা শুরু করবে, অনাকাঙ্ক্ষিত যাত্রা বিরতির জন্য অত্যন্ত দুঃখিত। তীব্র ব্যথায় আমি প্রায় ছটফট করছি। আমার এই অবস্থা দেখে আমার পাশের যাত্রী দুজন পাগলপ্রায়। আমাকে কী দিয়ে কীভাবে সান্ত্বনা দেবেন, কী করলে ভালো লাগবে ইত্যাদি। বৃদ্ধা কিছুক্ষণ পর উঠে গিয়ে কেবিন ক্রু এর কাছ থেকে একটা ওষুধ এনে বললেন, এটা খাও বাবা। ভালো লাগবে। বাসায় যখন আমি মাথা ব্যথায় এ রকম করি আমার আম্মু ঠিক একইভাবে পাগল হয়ে যান। তাঁরা জানেন, আমি একজন মুসলমান। তাঁরা যখন বলেছেন জৈনধর্ম, আমিও বলেছি আমি একজন মুসলিম। গল্প করার ফাঁকে আমি বারবার বলেছি ইনশা আল্লাহ। তারপরও আমার প্রতি যে ব্যবহার তাঁরা দেখাচ্ছেন তা ভোলার নয়। অথচ উচিত ছিল আমি তাঁদের সেবা করব যেহেতু আমি তাঁদের চেয়ে তরুণ। ১৪ ঘণ্টার বিমান ভ্রমণে যেটা হওয়ার কথা ছিল সেটা শেষ হলো ২১ ঘণ্টায়।
২১ ঘণ্টা এই দুজন মানুষের সঙ্গে ছিলাম। আমার ভাষা আর তাঁদের ভাষা ভিন্ন। আমার ধর্ম ভিন্ন তারপরও আমাকে যে ভালোবাসা দিয়েছেন তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। নিউইয়র্কে বিমান নামার পর আমি বললাম, আপনার ছেলের নম্বর আছে? দেন কল করি।
ছোট্ট কাগজে লেখা একটা নম্বর বের করে দিলেন, আমি কল করার পর একজন নারী রিসিভ করলেন। তাঁরা তেলগু ভাষায় কথা বললেন ওই নারীর সঙ্গে। যখন মোবাইল ফোন হাতে দিলেন ঠিক তখনই মনে হলো আরে ছবি তুলি না কেন।
একেবারে শেষ মুহূর্তে ছবি তুললাম।

ব্রঙ্কস, নিউ ইয়র্ক