বন্ধন

এই প্রথম বাপনের মন আর হৃদয়টা কাঁদছে! খুব কাঁদছে এই ক’দিন! কোনো জায়গা ছেড়ে যেতে গিয়ে মন, আর হৃদয় এক সঙ্গে এত কাঁদে না তার। এবার মনটা খুব উথাল-পাথাল করছে। কেন? সে কারণ খুঁজে পায় না। আসলে মানুষের মন বড় বিচিত্র! কখন কেমন ভাব নেয়, বোঝা বড় দায়। এ জন্যই জীবন এত রঙিন। সুখ-দুঃখে, আনন্দ-বেদনায় টইটম্বুর। মানুষ এগুলো বোঝে না। তাই এরা কেবলই দুঃখ খুঁজে বেড়ায়, বেদনাই শুধু খুঁজে পায়; আনন্দ এদের চোখে পড়ে না!

২.
কয়েক মাস ধরেই সে এখানে ওখানে ইন্টারভিউ দিয়ে আসছিল। গত দু বছর যাবৎ দেশে যাওয়া হয় না। পড়াশোনা একটা বিষয়। আরও কত বিষয় থাকে মানুষের, বলা যায় না! তারও সে রকম কোনো বিষয় আছে হয়তো!
হুট করে কয়েকটা ইন্টারভিউর রেজাল্ট তার হাতে! তার মধ্যে দুটো জব সে পছন্দ করেছে। প্রথমটা ‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’-এর রিপোর্টার, আর দ্বিতীয়টা একটা মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানিতে ‘ট্রেইনার’ হওয়ার অফার। প্রথম জবটা পছন্দের খুব; কিন্তু রিপোর্টারের আগে ‘জুনিয়র’ শব্দটা তার খুব অপছন্দের! আসলে সে ইন্টারভিউ দিয়েছিল সাব-এডিটর (সহ-সম্পাদক) পদের জন্য। কিন্তু আমেরিকা বলে কথা! তাকে ফোনে জানানো হয়েছে, ‘আমেরিকার কোনো পত্রিকা সরাসরি কাউকে সহ-সম্পাদক করে না! এখানে জুনিয়র, সিনিয়র রিপোর্টার হয়ে পদোন্নতি পেয়েই সহ-সম্পাদক, উপ-সম্পাদক হতে হয়। তাই রিক্রুটিং এডিটর তাকে বলল, ‘আসলে তোমার রিজ্যুমিতে উল্লেখ ছিল তুমি সহ-সম্পাদক কোনো পত্রিকার! কিন্তু সেটা যে বাংলাদেশের “দ্য ডেইলি স্টার” পত্রিকার, সেটা আমরা খেয়াল করিনি! স্যরি!’
বাপন জুনিয়র রিপোর্টার হিসেবে জয়েন করছে না এটাই তার সিদ্ধান্ত। তার বন্ধুরা কেউ কেউ দেশে এখন সিনিয়র সহ-সম্পাদক, চিফ কিংবা ডেপুটি রিপোর্টার। এই জুনিয়র-টুনিয়র আর ভালো শোনায় না। তা ছাড়া রিপোর্টিংয়ে এই দেশে সে খুব ভালো করতে পারবে বলেও তার মনে হয় না। তাই অনেক ভেবে-চিন্তে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ, টেকসই জবে যেতে চায় সে। দীর্ঘদিন প্রশিক্ষক হিসেবে দেশে কাজ করেছে, কলেজে অধ্যাপনা করেছে। টিচার ট্রেইনার হিসেবেও অল্পস্বল্প কাজ করেছে। এনজিওতেও শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে অল্প দিনের। সব মিলিয়ে ট্রেইনার হওয়াটা বেটার মনে হচ্ছে তার।
৩.
পয়লা জুন নতুন জবে জয়েন করছে বাপন। ম্যারিল্যান্ড ছেড়ে যাওয়াটা তাই এখন শুধুই আনুষ্ঠানিকতা! ৩ তারিখ বোস্টন ইউনিভার্সিটিতে (ওয়াশিংটন ডিসি ক্যাম্পাস) তিন মাসের জন্য প্রশিক্ষণে পাঠাচ্ছে তার অফিস। তাই সবকিছু গোছগাছ করছে ধীরে ধীরে; আর ভাবছে, ‘আমি কি সত্যি এই এজহিল অ্যাভিনিউ, ম্যারিল্যান্ডের অ্যাপার্টমেন্টটা ছেড়ে চলে যাচ্ছি? সত্যি? বাড়ির পাশে ছোট্ট বন, সেখানে ভোরবেলার হাজারো পাখির কলতান কি আমাকে বারবার পেছন ফিরে তাকাবার লোভ দেখাবে না?’ ভাবছে আর মনের কোনে মেঘ জমে উঠছে তার...‘কয়েক গজ দূরে জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটি, তার বিশাল লাইব্রেরির অনুপস্থিতি কি বুকের ভেতর শূন্যতা তৈরি করবে না?’
‘বাড়ির সাথে লাগোয়া ইনক প্র্যাট ফ্রি লাইব্রেরির অভাব কি পূর্ণ হবে কখনো?’ এই সব সে ভাবে আর ভাবে...। সারা আমেরিকায় সে মাত্র একটি কাঁচা রাস্তা আবিষ্কার করেছে! সে রাস্তায় মন খারাপ হলে একা হাঁটত আর ভাবত, ‘এই তো আমার দেশ, আমার দেশের মাটির গন্ধ!’ সে রাস্তাটাও খুব খুব মিস করবে সে, খুব, খুব ...মিস করবে এখানের স্কুল পড়ুয়া পিচ্চি-পিচ্চি ছেলেমেয়েদের, যারা তাকে নাম ধরে ডাকতে না পেরে ‘বব’ বলে ডাকত! যাদের দেখে সে ভাবত ‘এই ত আমার ছেলে-মেয়ে, আমার চোখের সামনে!’ যাদের খাবার কেনার দু-এক পয়সা কম পড়লে ‘ডোন্ট অরি! আই অ্যাম হিয়ার’ বলতে পারত সে...

৪.
বাপন ১ জুন যোগ দিচ্ছে নতুন কাজে। ৩ জুন থেকে প্রায় তিন মাসের নিবিড় প্রশিক্ষণে (ইনটেনসিভ ট্রেইনিং) এ যাচ্ছে। অফিস চাইছে, তার আর কি করার আছে! এখানে ৩০ মে শেষ ডিউটি তার। সেদিন ওই পিচ্চিদের সঙ্গে শেষ দেখা হবে। বড়রা তো প্রতিদিনই বিদায় বলে ফেলছে, ‘উই উইল মিস ইউ ব্যাপ’ বলে...পিচ্চিরাও কি এমন বলবে?
এর আগে সে আমেরিকার কত জায়গায় গেছে, কাজ করেছে। কিন্তু এমন বন্ধন এর আগে সে অনুভব করেনি! সে চলে যাবে এই কথা শুনে সে কোনো দিন কাউকে কাঁদতে দেখেনি! অবশ্য তার বউ কোথাও দু-এক সপ্তাহের জন্য যাওয়ার আগে চোখ মোছে। এখানেই প্রথম দেখেছে দু-একজন কে কাঁদতে। ওরা তার সাথে এমনকি ঘনিষ্ঠও নয়।
দীপা নামের যে ইন্ডিয়ান মেয়েটা তার সাথে কাজ করত, তার সে কি কান্না! এগুলো রক্তের বন্ধনকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে কখনো কখনো। দীপা মেয়েটার দাঁত তেত্রিশটা। হাসলে অসম্ভব সুন্দর লাগে তাঁকে। অনেক মিস করবে সে দীপাকে।

৫.
আজ কাজ ছিল না তার। খুব ব্যস্ত থাকায় তবুও তার ডাক পড়ে চার ঘণ্টার জন্য। ফ্রেড নামের এক ৮-৯ বছরের ছেলে, আর ১১ বছরের একটা মেয়ে এল, নাম ক্যাথি—
ছেলে টা বলল, ‘তুমি কি চলে যাচ্ছ বব?’
- হ্যাঁ, চলে যাচ্ছি..
- কেন, কোথায় যাচ্ছ তুমি? কেন যাচ্ছ বব?
- ডিসিতে যাচ্ছি, নতুন একটা চাকরিতে যোগ দিতে...
- কাম’অন বব! নো, প্লিজ, সে নো। উই উইল মিস ইউ বব...
- হোয়াই ইউ উইল? আমরা বন্ধুও নই, আত্মীয়ও নই।
- তুমি তাই, তুমি তা-ই! বব, আই লাভ ইউ, লাভ ইউ...
বলতে বলতেই ছেলেটা বাপনকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠল। তারপর সামলে নিয়ে ফ্রেড আবার বলল, ‘বব, আমার যদি টাকা থাকত, আমি তোমাকে একটা সিনেমার ভিডিও সিডি কিনে দিতাম!’
- তুমি এই যে বললে, আমি পেয়ে গেছি। মুভিটার নাম বলো...
- ‘ট্রপিক থান্ডার’। তুমি অবশ্যই দেখবে মুভিটা। আমি টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে তোমাকে কিনে পাঠাব!
- ঠিক আছে। আমি দেখে নেব...
- বব, তুমি তোমার ঠিকানা দিয়ে যাবে? আমি মুভিটা তোমাকে পাঠিয়ে দেব ঠিক ঠিক একদিন...
এই বলে ছেলেটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে...
ক্যাথি নামের মেয়েটা বলল, ‘বব তোমার কি মনে আছে, একদিন তুমি ফ্রেডকে একটা পিৎজা অপার করেছিলে? তার কাছে ওই দিন একটি ডলারও ছিল না। আমরা দুজনেই ছিলাম ভীষণ ক্ষুধার্ত। কিন্তু তুমি আমাকে দিলে না।’
- ওহ, সত্যি? আমি খুবই দুঃখিত, আমার মনে পড়ছে না।
- ইট’স ওকে। তুমি আমার বন্ধুকে খাইয়েছ, তাতেই আমি খুশি।
-থ্যাংকস
- বব আমরা খুব ভালো বন্ধু ছিলাম। ইউ ডিজার্ভ আ ভেরি সিনসিয়ার হাগ ফ্রম মি...
(আমেরিকায় বাচ্চা মেয়েদের হাগ তো দূরের কথা, ছোঁয়াও বিধিবহির্ভূত! কিন্তু ক্যাথি কি তা বোঝে? না বাপন বোঝে!)
ক্যাথির কান্না থামে না। কোথায় যেন এদের অলিখিত বন্ধন! এ বন্ধন না রক্তের, না আত্মীয়তার। এ বন্ধন কোনো সুতোয় বোনা নয়, এই বন্ধন প্রাকৃতিক শাদা চোখে দেখা মুশকিল। এ বন্ধন দেখতে চাইলে হৃদয়ের চোখ দিয়ে দেখতে হয়! মানুষের কয়টা চোখ থাকে? কমপক্ষে ছয়টা চোখ থাকে অনেকের। শরীরী চোখ, মনের চোখ আর হৃদয়ের...

৬.
বাপনের তিন মেয়ে। মেজো মেয়ের বয়স ক্যাথির সমান হবে বোধ করি। ওর মনে হলো এ যেন ক্যাথি নয়। এই মেয়েটি তার তিন মেয়ে! তার তিন কন্যা তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে...

৭.
বাপন যেন বহুদিন পর আবার মন খুলে মনে মনে কাঁদল এমন... বহুদিন পর... এ কান্না হৃদয় বিদীর্ণ করে দেয়। এ কান্না দেখা যায় না, শুধুই অনুভব করা যায়...