নারী-ডিভাইন স্টোন

‘নারী–ডিভাইন স্টোন’ছবির একটি দৃশ্য
‘নারী–ডিভাইন স্টোন’ছবির একটি দৃশ্য

হাসান মাহমুদ রচিত ও নির্মিত ‘নারী–ডিভাইন স্টোন’ নামে ৪৩ মিনিটের চলচিত্রটি আবার দেখলাম। বাংলায় নির্মিত এবং ইংরেজি ও আরবি ভাষার সাবটাইটেল সংযোজিত এই ছবিটি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ১৫টি ইসলামি সংস্থা অনুমোদন করেছে। বাংলাদেশে এ ধরনের আর কোনো ছবি হয়েছে বলে জানি না। ছবিটিতে ইসলাম ও কোরআনবিরোধী কতগুলো আইন শরিয়া মারফত চৌদ্দ শ বছর ধরে মুসলমান নারীকে কীভাবে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সর্বোপরি মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে—তা দেখানো হয়েছে। সব মুসলমানেরই একবার হলেও এই ছবিটি দেখা উচিত।
উত্তর আমেরিকার বাঙালি শিল্পী-সাহিত্যিক সমাজে হাসান মাহমুদ একটি পরিচিত নাম। তিন দশকের কাছাকাছি সময় ধরে কানাডার টরন্টোতে বসবাস করছেন। কবিতা রচনায় তাঁর কৃতিত্ব থাকলেও বিভিন্ন উদ্দীপনামূলক গল্পকার হিসেবে তিনি খ্যাতি পেয়েছেন বেশি। ‘আমি বাংলার কথা কই’ বইটিতে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে প্রাক-বর্তমান কাল পর্যন্ত বাঙালির গর্ব করার মতো অনেক ঘটনা ও মনীষীর কথা গল্পাকারে বলা আছে। একটি অনুবাদসহ তিনি মোট পাঁচটি বই প্রকাশ করেছেন। কিন্তু তিনি শরিয়া ও ইসলাম ধর্মের একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে যে বইটির জন্য বেশি পরিচিতি পেয়েছেন, সেটি হচ্ছে ‘শরিয়া কি বলে, আমরা কি করি’। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি (২০১৮) বইটি ইংরেজিতে ‘হাউ শরিয়াইজম হাইজ্যাকড ইসলাম’ নামেও প্রকাশিত হয়েছে। মূলত কোরআনের সঙ্গে সংঘাতপূর্ণ হাদিস কীভাবে বর্তমান ইসলামকে নিয়ন্ত্রণ করছে, অসংখ্য উদাহরণ দিয়ে তা দেখানো হয়েছে এই দুটি বইয়ে। তার অন্য দুটি বইয়ের নাম ‘আল্-ভোঁদড়ের দেশ’, এবং ‘অজানা একাত্তর’ (অনুবাদ)।
হজরত মোহাম্মদ (সা.)–এর শিক্ষা অবলম্বনে হাসান মাহমুদের রচিত ও স্বকণ্ঠে আবৃত্তি করা ‘জিহ্বা’ কবিতাটি ইউটিউবে দর্শক-শ্রোতারা ২২ লাখ বার শুনেছেন ও দেখেছেন এবং বাষট্টি হাজার বার শেয়ার করেছেন। ইতিমধ্যেই ‘শরিয়া কি বলে, আমরা কি করি’ বইটি পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে এবং আলোচিত হয়েছে। সেই সুবাদে তিনি এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা ও কানাডায় বহু আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ও সংবাদমাধ্যমে বক্তা হিসেবে ও অজস্র নিবন্ধ লিখে সুনাম অর্জন করেছেন। সম্প্রতি বইটি ইংরেজিতেও অনূদিত হয়েছে। হাসান মাহমুদ কয়েকটি প্রগতিশীল ইসলামি সংগঠনের সঙ্গেও জড়িত।
প্রায় তিন দশক ধরে তাঁর ইসলাম ধর্ম ও ইতিহাসভিত্তিক গবেষণার ফলাফলের দুইটি দিক তিনি ‘ডিভাইন স্টোন’ নামে একটি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন। এর একটি দিক হচ্ছে, খুনের সব আলামত বজায় থাকলেও কোনো চাক্ষুষ পুরুষ-সাক্ষী ছাড়া খুনিকে নির্দোষ সাব্যস্ত করতেই হবে। আর অন্যটি হচ্ছে, চারজন পুরুষ সাক্ষী না থাকলে কোনো ধর্ষকের কোনো সাজা তো হবেই না, বরং অভিযোগকারী ধর্ষিতাকে শাস্তি এমনকি পাথর ছুড়ে মেরে ফেলার বিধান রাখা হয়েছে। তেমনি পাথরের আঘাতে নিহত সোমালিয়ার ১৪ বছরের গণধর্ষিতা আয়েশা দুহুলো যাকে শরিয়া আদালত পাথর ছুড়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে, তার স্মৃতির প্রতি ছবিটি উৎসর্গ করা হয়েছে। অনেক মুসলিম দেশে ও বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলেও বেসরকারি শরিয়া আদালত বসিয়ে এ ধরনের আইন প্রয়োগে গ্রামাঞ্চলে অনেক ধর্ষিতাকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।
চলচ্চিত্রের পাঁচটি চরিত্রই প্রধান। তাঁদের কথোপকথন থেকেই বিভিন্ন শরিয়া আইনের সঙ্গে ধর্মীয় জীবনের অসংগতির ব্যাপারে আমরা জানতে পারি। গ্রামের মাতবর, মাওলানা ও প্রতিবাদী তরুণ নিজাম শরিয়া আইন চালু করার আগে ‘সর্বশ্রদ্ধেয় ও জ্ঞানী’ বুবুর অভিমত জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটাতো ইসলামি সমস্যা, আর আমিতো মাইয়া মানুষ। ইসলামি সমস্যায় মাইয়াগো কেউ জিগায়না। শরিয়া হইল অজানা জগৎ, অজানা সমস্যা, অজানা সমাধান, (এই আইন চালু করার আগে) ভাইজান খুব সাবধান।’ তিনি প্রশ্ন করেন, ‘আল্লাহতো এক কিন্তু আল্লাহর আইন চাইর রকম হয় কেন?’
গ্রামে পরীক্ষামূলকভাবে শরিয়া আইন চালু করার পরে অনেক আধুনিক ও ঐতিহাসিক বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে নিজাম দেখতে পেল, ‘শরিয়া আইনে এমন কতগুলো আইন আছে যা সাংঘাতিক নারীবিরোধী, অমুসলিমবিরোধী আর ইসলামবিরোধী। শরিয়া আইনে কোনো সাক্ষী ছাড়াই স্বামী স্ত্রীকে তালাক দিতে পারবে, কিন্তু কোরআনের সুরা তালাকের ২ নম্বর আয়াতে আছে তালাকের অবশ্যই দুজন সাক্ষী লাগবে।’ তাঁর জবানিতে শরিয়া আইন সম্পর্কে আমরা আরও জানতে পারি, ‘গণহত্যাকারী ও গণধর্ষণকারী তওবা করলে তার কোনো শাস্তি হবে না।’ গ্রামে শরিয়া আইন চালুর ব্যাপারে প্রথমে সে নিজে উদ্যোগী হলেও ইসলাম ও শরিয়া সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন শেষে সে অনুভব করল, ‘চৌদ্দ শ বছর ধরে আমরা কিতাবের আলোকে মানবাধিকারকে দেখেছি, আর এখন মানবাধিকারের আলোকে কিতাবকে আমাদের দেখতেই হবে।’
গ্রামের বখাটে যুবক ও নারী উত্ত্যক্তকারী সায়ীদ আবিষ্কার করে, দেশের প্রচলিত আইনে শাস্তির বিধান থাকলেও শরিয়া আইনের ফাঁকে সে অনায়াসেই তার লালসা চরিতার্থ করতে পারবে। সায়ীদ সেই আইনগুলোকে সম্বল করে নির্জন বাড়িতে নিজামের প্রেয়সী ও মাতবরের মেয়ে পিনুকে ধর্ষণ করে। বুবু তা স্বচক্ষে দেখতে পেলেও নারী-সাক্ষী অগ্রহণযোগ্য বিধায়, খুঁটির সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধা অবস্থায় সায়ীদ শরিয়া আইনের দোহাই দিয়ে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে। কিন্তু ততক্ষণে মাতবর, মৌলানা ও নিজাম শরিয়া আইনের ত্রুটিগুলো উপলব্ধি করতে পারে। উপায়ান্তর না দেখে ধর্ষণকারী শরিয়ার আরেকটি আইনের শরণাপন্ন হয়ে ধর্ষিতাকে আর্থিক জরিমানা দেওয়ার প্রস্তাব করে। তাতেও সফল না হলে সে ধর্ষিতার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে তাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয় এবং নিজেকে ছেড়ে দিতে অনুনয় করতে থাকে। তখন বুবুর সংলাপ যেন পুরুষতন্ত্রের ওপর মহাকালের চাবুক হয়ে নেমে আসে—‘হাজার বছর ধরে তোমরা (পুরুষ-ধর্মগুরুরা) ওর দড়ি খুলে দেয়েছো, আজ আমরা তাদের দড়ি খুলে দেব। পিনু ছাইড়া দে ওরে, কাইটা দে দড়ি!’ ছবিতে দেখানো না হলেও বোঝা যায়, পিনু তার ধর্ষকের ‘জীবন-দড়িটি’ ধারালো দা দিয়ে কুপিয়ে খুলে দেয়!
ছবির শেষে দুটি স্থিরচিত্র লেখায় দেখানো হয়, ‘নবীজির জীবনে বা কোরআনের কোথাও এ ধরনের মামলায় মহিলা সাক্ষীকে নাকচ করা হয়নি’, অথচ শাফেয়ি, হানাফি ইত্যাদি শরিয়া আইনে ও কোরআনের তথাকথিত ব্যাখ্যায় ‘হুদুদ (খুন, জখম, চুরি, ডাকাতি, মদ্যপান, কাউকে বদনাম করা ইত্যাদি) মামলায় মহিলা সাক্ষীকে অগ্রাহ্য, নাকচ, প্রত্যাখ্যান বা বাতিল করা হয়েছে।’
চরিত্রগতভাবে ধর্ষকের বয়স, পোশাক, বচন এবং বাচনভঙ্গি তাকে একটি ঘৃণিত চরিত্রে পরিণত করেছে; অভিনেতা হিসেবে সে তাই সার্থক। প্রচলিত প্রতিপত্তিশালী ও হীন চরিত্রের বিপরীতে গ্রামের মাতবর ও মৌলানার চরিত্র দুটোকে অনেক মানবিকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
ইসলামিক বিশ্বে সৌদি আরব, ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং ইন্দোনেশিয়ার পর মালয়েশিয়ায় শরিয়া আইন চালুর পক্ষে বর্তমানে জোর তৎপরতা চলছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশও খুব পিছিয়ে নেই। সেখানে মাদ্রাসার উত্তরোত্তর প্রসার, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন ইসলামি সংগঠন ও ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, নতুন নতুন ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে ‘আল্লাহর আইন’ বা শরিয়া আইন চালুর স্লোগান এবং সর্বোপরি ধর্ম নিরপেক্ষ হিসেবে জন্ম নিয়েও রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্রে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্থান দেওয়ার ফলে অদূর ভবিষ্যতে আমরাও যে না বুঝেই দেশে শরিয়া আইন চালু করব না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
সবচেয়ে অনুশোচনার ব্যাপার হচ্ছে, শরিয়া আইন নারী জাতিকে সামাজিক-মানবিক-অর্থনৈতিকভাবে অপমানিত ও পঙ্গু করে রেখেছে, আধুনিক কিছু নারী সেগুলোকে ইসলামবিরোধীদের প্রচারণা মনে করেন অথবা দেখেও না দেখার ভান করে থাকেন। তাই একটু ধৈর্য ধরে ‘নারী–ডিভাইন স্টোন’ ছবিটি দেখলে কোরআন ও ইসলাম ধর্মকে অবমাননা না করেও যারা শরিয়া আইনের ভেতর দিয়ে সামাজিক অনাচারগুলোকে ধর্মীয় লেবাস পরিয়ে মানবতার অবমাননা করে চলেছেন, তাদের উদ্দেশ্য কিছুটা বোঝা যাবে।
সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে হাসান মাহমুদের এই প্রচেষ্টায় আমাদের সবার সাড়া দেওয়া উচিত।

মেরিল্যান্ড, আমেরিকা