বৈরী সময় পেরিয়ে

সে বড় আনন্দের সময়! কী উত্তেজনাময় দিনগুলো! আরিফ মাহমুদ তার শিক্ষাজীবনের দিনগুলোয় উঁকি দেয়। একটার পর একটা পাস দিয়েছে। অসম্ভব ভালো ফলাফল করেছে। ফি বছরের প্রথম হওয়ার খবরগুলোও এত আনন্দ আর উত্তেজনা বয়ে আনেনি। অতি সাধারণ প্রায় দরিদ্র এক গ্রামীণ পরিবারে তার জন্ম। বাবা স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলশিক্ষক। পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের গুরুত্ব তিনি বোঝেন। আশপাশের লোকজনের খুশি দেখে তাঁরাও খুশি হন। মনে মনে দিন গোনেন, ছেলে পাস দিয়ে আর কত দিন পরে মস্ত বড় চাকরি পাবে, তাঁদের দুঃখের দিন শেষ হবে! আরিফকে শেষ পাস দেওয়া পড়াশুনা করানো পর্যন্ত আরিফের বাবার আর্থিক জোগান সামান্যই। মেধাবী ছাত্র হওয়ার কল্যাণে বৃত্তি পাওয়ার সঙ্গে নিজের চেষ্টা যোগ করে লেখাপড়া চালিয়ে গেছে। কষ্ট কিছু কম সে করেনি লেখাপড়া চালিয়ে যেতে। তার মনে পড়ছে যেদিন ফলিত রসায়নে এমএসসি পাসের রেজাল্ট নিয়ে গ্রামে মা-বাবার কাছে ফিরেছিল, শুনে তাঁরা খুশিতে কেঁদে ফেলেছিলেন। মা কেবলই কাঁদছিলেন আর তার মাথায়, চুলে, চিবুকে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। বাবা হাত তুলে মোনাজাত করেছিলেন। তারপরই পরামর্শ দিয়েছিলেন এখন যত তাড়াতাড়ি পারা যায় চাকরির দেখতে। স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন তাকে উচ্চশিক্ষিত করতে গিয়ে সংসারের অনেক ক্ষতি করতে হয়েছে। সামান্য যে জমি–জিরাত ছিল, বিক্রি করতে হয়েছে। দুধের গাই গেছে। অন্য দুই ছেলে–মেয়ের দিকে মনোযোগ দেওয়া হয়নি। সুতরাং আরিফ যেন এখন থেকে ভাই–বোন দুটো’র দায়িত্ব নেয়। আরিফের শুনতে খারাপ লাগলেও মেনে নেয়, বিষয়টা তো সত্যি। জ্ঞাতি, কুটুম, গ্রামের মানুষজন আসতে শুরু করেছিল। সবাই আরিফের সুখ্যাতি করেছিল। মুরুব্বিরা আশা প্রকাশ করলেন এবার তাঁদের এই হিরের টুকরো ছেলে ডি.সি, এসপি, জজ–ব্যারিস্টার হয়ে গ্রামের উন্নয়ন করবে। এই দিনটি ছিল আরিফের জীবনে আরেকটি আনন্দময় দিন।
এরপর তিনি বাবা, মা, আত্মীয়-মুরুব্বি সকলকে হতাশ করে সরকারি চাকরির চেষ্টা না করে, বিসিএস না দিয়ে বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানি ‘বায়্যার’ এর পেস্টিসাইড ডিভিশনে এরিয়া সেলস ম্যানেজারের চাকরি নেন।
মোটাদাগের মাসিক বেতন। উন্নতি করার সুযোগ আছে। দিনটি মনের মণিকোঠায় সেজে গুঁজে বসে আছে। সৌভাগ্যই বলতে হবে তাঁকে নিজ অঞ্চলেই পোস্টিং দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ তাঁর কার্য অঞ্চল বগুড়া-নওগাঁ-নাটোর-পাবনা। তিনি বগুড়া শহরের সূত্রাপুরে ছোট্ট একটা বাসা ভাড়া করে থাকেন। ছোট ভাই-বোন দুটোকে নিজের কাছে এনে রাখেন। বোনটা বড়, ভাইটা ছোট। বোন মালিহা বগুড়ার বিখ্যাত ভিক্টোরিয়াল মেমোরিয়াল গভর্নমেন্ট গার্লস স্কুল, আর ভাই আশফাক বগুড়া জিলা স্কুলে পড়ছে। তারা খুব খুশি। ক্রমশ তারা শহর জীবনে অভ্যস্ত হতে শুরু করে। মা-বাবা নন্দীগ্রামেই থাকে। আরিফ প্রতি মাসেই নিয়ম করে বাবার নামে মানি অর্ডার পাঠিয়ে দেন। তাঁরা ভালো আছেন। আরিফ মালিহা আর আশফাককে সঙ্গে করে মাসে একবার দু’দিনের জন্য গ্রামে বেরিয়ে আসেন।
শুরু থেকেই নিজ চাকরি এবং নিজ পদ, অবস্থান সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন এবং জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছিলেন। জীবনের সঙ্গে উন্নতির সেতু তৈরি করে নিয়েছিলেন। আর সে জন্যেই মাত্র দুই বছরে তাঁকে ডিভিশনাল হেড করেছিল কোম্পানি। বেতন, সুবিধা, সামাজিক সম্মান, অবস্থান লাফ দিয়ে উঠে গিয়েছিল।
একদিন বাবা এলেন বড় মামাকে সঙ্গে নিয়ে কোম্পানির দেওয়া তার নতুন বাসায়। আরিফ সেদিন রংপুর গিয়েছিলেন। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে বাবা আর মামাকে একসঙ্গে দেখে খুব খুশি হলেন, আবার একটু চিন্তিতও হয়ে পড়লেন। মামা সেটা বুঝতে পেরে বললেন, “বাবা আরিফ, তোমার কপালে চিন্তার রেখা টানার মতো কোনো বিষয় ঘটেনি। বরং একটা সুখবর আছে। সে বিষয়ে তোমার সঙ্গে আলাপ–আলোচনা করে তোমার মতামত জানার জন্যই আমরা এসেছি। তোমার বাবা একা আসতে চাইলেন না, তাই আমারও আসা।” আরিফের যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। তিনি তার বাবার দিকে ফিরলেন। বাবাকে ভালো করে দেখলেন।
মনে হলো বাবার যেন শরীর একটু করে ভাঙছে। বয়সটা একটু একটু করে পরিণতির দিকে এগোচ্ছে। আরিফ বললেন, “বাবা, আপনার শরীর কেমন আছে? অম্বলের ব্যথা কমেছে? ওষুধ ঠিকমতো খান? বাতের ওষুধ?”
বাবা আরিফকে আশ্বস্ত করেন, তিনি ও আরিফের মা দুজনই সহী সালামতে আছেন। বাবা বলেন, “তুমি বাইরে থেকে এসেছ। হাত মুখ ধুয়ে একটু বিশ্রাম কর। খাওয়া–দাওয়া সেরে আমরা বাকি আলাপ সারব।” আরিফ জি আচ্ছা বলতেই মালিহা এসে বলল, “ভাইজান, বুয়া আপনার জন্য বাথরুমে গরম পানি দিয়ে এসেছে বালতিতে। আপনি গোসল সেরে নিন। আপনার ঘরে চা দিচ্ছি।” বাবা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, “না, না, এখন আবার চা দিবি কি, একবারে টেবিলে খাবার দে। সবাই একসঙ্গে খেয়ে নেবে।” মালিহা জি বাবা, বলে চলে গেল টেবিলে খাবার দিতে।
খাবারের পালা শেষ হওয়ার পর মালিহা আর আশফাককে ভেতরের ঘরে পড়তে পাঠিয়ে বাবা, মামা আর আরিফ বসল আলোচনায়। পান মুখে মামা সবিস্তারে সব বললেন। আরিফ শুধু মৃদু আপত্তির স্বরে বলেছিল মালিহা এখন পড়ছে। ওর লেখাপড়া আগে শেষ হোক, মেয়েদের স্বাবলম্বী হওয়াটা খুব জরুরি। বাবা আর মামা দুজনই বুঝিয়েছিলেন এ রকম ছেলে হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। তা ছাড়া ওরা নিজের থেকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। বিয়ের পরেও মালিহা পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারবে। ওদের কোনো আপত্তি নাই। অতঃপর মাস খানেকের মধ্যে সব সারা হয়ে গেল। বড় ভাই হিসেবে তাঁর খুব কষ্ট হচ্ছিল, আবার বাড়ির বড় সন্তান হিসেবে বোনের বিয়ে দিতে পেরে তিনি অনেকটাই নিশ্চিন্ত বোধ করলেন। দিনটি ছিল ছাব্বিশ অগ্রহায়ণ। এর পর তাঁর জীবনে বড় সরো সুখের দিন আসে ঠিক বছর খানিক পরে। তাঁর নিজের বিয়েতে। সব শুনে আরিফ রাজি হননি। নব্য ধনিক শ্রেণিভুক্ত এই সব চটকদার দেখনদার পরিবারের সঙ্গে তাঁরা কোনোভাবেই মিশে যেতে পারবেন না। ভয় কাজ করেছিল মনে, শেষে নিজের জীবনটাই না অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে! পাছে তার অতি সাধারণ মা-বাবা যেন কষ্ট না পান!
ছোট দুটি ভাই–বোন তার সঙ্গে থাকে, তাদের যেন অসুবিধা না হয়! কিন্তু তার এই ওজর আপত্তিগুলো বিয়ে থামাতে পারেনি। বাবা–মা’র মেয়ে খুব পছন্দ। মামারা ওই পরিবারে আত্মীয়তা করতে খুব আগ্রহী। মালিহা আর আশফাক দুজনেই মেয়ে দেখে আসা অবধি তাকেই ভাবীরূপে চিন্তা করছে। অবশেষে মহাধুমধামে বিয়ে হয়ে গেল। কার্তিকের কুড়ি তারিখ, শুক্রবার। সে রাতটি ছিল জীবনের সবচেয়ে ছোট ও মধুর রাত ।
এত আনন্দময় দিন রাত্রির চেয়ে সেই বিশেষ দিনটি বেশি আনন্দময় ছিল কিনা আরিফ বলতে পারবে না। তবে এ নিশ্চিত যে সে দিনটি আলাদা রকমের উত্তেজনা ভরা দিন ছিল। কেমন একটা চাপা উত্তেজনা চারদিকে সবার মধ্যে। এমনকি তার নিজের মধ্যেও। ডাকপিয়ন একটি চিঠি নিয়ে এসেছিলেন। অন্যদিনের মতো, অন্য সব চিঠির মতো চিঠিটি কাউকে দিয়ে চলে যাননি। হাতে নিয়ে বসেছিলেন। প্রায় দুই ঘণ্টা নাকি বসেছিলেন চিঠিটি আরিফের হাতে দিয়ে বড় রকমের বকশিশ আদায় করবেন বলে। এই দুই ঘণ্টায় মহল্লার অর্ধেক মানুষের জানা হয়ে গেছে আরিফ সাহেব আমেরিকা চলে যাচ্ছেন। আমেরিকান অ্যাম্বাসি থেকে চিঠি এসেছে। আরিফ সাহেব ডি.ভি. পেয়েছেন। চিঠিটি হাত বদল হতে পোস্টম্যানের হাতে পাঁচ শ টাকা গুণে দিতে হয়েছিল। সংবাদটি নন্দীগ্রাম পর্যন্ত পৌঁছতে দুটো দিন সময়ও লাগল না। আরিফকে ঘিরে এমন এক উন্মাদনা তৈরি হয়েছে যেন আরিফ আলাদীনের জাদুর চেরাগ পেয়ে গেছেন! ঘষা দিলেই দৈত্য আসবে। দৈত্য এলেই সোনাদানা, মণিমাণিক্য যা চাইবেন, যত চাইবেন, সব তৎক্ষণাৎ পেয়ে যাবেন। সাজ সাজ রব পড়ে গেল। আরিফদের চৌদ্দ পুরুষের বিদেশে যাওয়ার কোনো রেকর্ড নাই। শ্বশুরবাড়ির দিকে, তাদের নতুন পয়সা হয়েছে বটে, তাদের দৌড় বড় জোড় সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক। আমেরিকার কথা শুনে তো সবার চোখ চকচকে। তার খালাতো, মামাতো, ফুপাতো ভাইদের কারও কারও গোপনে উপর্যুপরি অনুরোধ জানাতে বাকি রইল না যে, আরিফ ভাইয়া গিয়ে সেটল্ হলেই যেন তাদের ভিসা পাঠিয়ে দেন। আরিফ মহাবিরক্ত। কিছুতেই কাউকে বোঝাতে পারে না যে বিষয়টা তেমন নয়। মিথ্যা সব আশ্বাস দিয়ে যেতে হয়। আরিফ চারদিকের এই মিথ্যা চটকের আর কল্পিত সুখ আনন্দের আশার জোয়ারে ভাসতে লাগলেন। তার এত বড় চাকরি, সুবিশাল ফার্নিশড বাসা, দামি গাড়ি, ড্রাইভার, দারোয়ান, এসব মূল্যহীন হয়ে পড়ল। একমাত্র মূল্যবান হয়ে পড়ল আমেরিকা চলে যাওয়া। একবার শুধু চলে যাওয়া! তারপরই তো সব পেয়ে যাওয়া হাতের মুঠোয়!
বাবা বলেছিলেন, “বাবা আরিফ, চেনা সুখ অচেনা অঢেল ঐশ্বর্যের চেয়ে ভালো”। বাবা বোঝাতে চেয়েছিলেন ভিনদেশি ঠাকুরের চেয়ে স্বদেশি কুকুর ভালো। ফল হয়নি।
আরিফ সাহেব চাকরি ছেড়ে, কোম্পানির বাসা ছেড়ে, ছোট একটা বাসা ভাড়া করে বাবা-মাকে ভাই-বোনের সঙ্গে থাকার ব্যবস্থা করে, তাদের সবকিছু টেক কেয়ার করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলে গিয়েছিলেন, সব পেয়েছিল/// দেশে।
আমেরিকায় এসেই কিন্তু বুঝে গেছেন যে আশা ও প্রাপ্তি, স্বপ্ন ও বাস্তবতার মাঝে ঢের ফারাক। শুভংকরের ফাঁকিটা ধরতে তার সময় লাগল না। প্রাণ তাঁর কেঁদে উঠল। কিন্তু ফেরার তো আর পথ নাই। মন বসাতে চেষ্টা করেন। পারেন না। সারাক্ষণ মন পড়ে থাকে বাংলাদেশে। সেখানকার সেই বর্ণাঢ্য সাজানো জীবন, আর বর্তমানের এই ফাঁক–ফাঁকির কৃত্রিম সুখী চেহারার জীবন! তুলনা চলে আসে মনে, আর কষ্ট বাড়ে। বগুড়ারই এক পরিচিতজনের ঠিকানা নিয়ে তার সঙ্গে আলাপ করে চলে আসেন অনেক স্বপ্ন নিয়ে। এসেই স্বপ্ন ভঙ্গ হয়। উডসাইডের ওই দুই বেডরুমের বাসায় তাঁরা থাকেন চারজন। একজন ছাত্র, ‘হেগেন ডাজ’ আইসক্রিম পার্লারে কাজ করেন আর লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছেন। আর তিনজন ইয়েলো ক্যাব চালান। আরিফ সাহেবেরা চারজন। তাঁরা এসে দেখেন, তাঁরা ছাড়াও তাঁদের আগে আরেক প্রৌঢ় দম্পতি এই বাসায় অতিথি হয়েছেন। চার সদস্যের এক পরিবারকে এক বেডরুম, দুই সদস্যের পরিবারকে আরেক বেডরুম ছেড়ে দিয়ে, চার তরুণ বন্ধু বসার ঘরে দুই সোফায় দুজন, কার্পেট করা ফ্লোরে শয্যা পেতে দুজন রাতটুকু কোনোরকমে পার করে দেয়। নানান সমস্যা। প্রত্যেকেরই অনেক কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করতে হচ্ছে। আরিফ পরিবারের অসুবিধা বেশি। কারণ তাদের সঙ্গে দুটি বাচ্চা আছে। তারা পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায় আনতে পারে না। চাকরি নয়, তাঁদের খুঁজতে হবে কাজ। আর কাজ পাওয়ারও আগে খুঁজে পেতে হবে একটা বাসা।
পরিচিতজনদের খুঁজে বের করে, তাদের বলে কয়ে একটা বাসার ব্যবস্থা হয়ে যায়। সাবলেট। বগুড়া শহরেরই এক নব বিবাহিত তরুণ দম্পতির সঙ্গে। দুই দম্পতি দুই ঘরে, ছেলে দুটিকে রান্নাঘরের তাপ ও মসলার ঝাঁজালো গন্ধ থেকে খানিকটা বাঁচিয়ে লিভিং রুমের একদিকে ফ্রেম ও ম্যাট্রেসের বিছানা করে থাকার ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু ঝামেলা কিছু কমেনি। এটা করল কে? ওটা এখানে কেন?
মা, রান্না বন্ধ কর, গন্ধ আসছে। সবচেয়ে বেশি অসুবিধা বাথরুম ব্যবহার নিয়ে। ছয়জন মানুষের একটিমাত্র বাথরুম। বড়রা বুঝলেও ছোটরা বুঝতে চায় না। অন্যের সমস্যা না বুঝে, তাদের কাজের সময়ের হিসাব না রেখে যখন-তখন ভেতরে ঢোকে। এ ছাড়া আছে আরেক বড় সমস্যা কিচেন ব্যবহার নিয়ে। ঠোকাঠুকি লেগে যায় মাঝে মধ্যে। তাঁদের আচরণবিধি পাল্টে যেতে শুরু করে। বাস্তবতা বড় নিষ্ঠুর। এই আগুনের আঁচ রাতে আরিফ সাহেবের শরীর মন দুই’ই পোড়ায়। তিনি দিন দিন কুণ্ঠিত হতে থাকেন। মন মরা হতে থাকেন। হাতের টাকা আগেই শেষ।
বাসা ভাড়ার অগ্রিম, জামানত, নতুন দেশে নতুন সংসার গড়ার প্রয়োজনে তার অনিচ্ছাতেও তাঁর স্ত্রী নিজের ভাইয়ের কাছ থেকে টাকা ধার করে আনান। তাঁর আত্মসম্মানবোধে বড় আঘাত করে।
কাজ না পেয়ে, ভোর রাতে বেরিয়ে কঠিন শীতের কামড় সয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে নিউজ পেপার বিক্রির কাজ নিয়েছিলন। প্রতিদিন মাত্র চার ঘণ্টার কাজ। এক মাস করার পর ঠান্ডা লেগে নিউমোনিয়ার অবস্থা হয়ে গেল।
ডাক্তার হাসপাতাল করেও সিক বেডে পড়ে থাকতে হলো পাঁচ সপ্তাহ। আরও চার সপ্তাহ গেল বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য ইমুনাইজেশানসহ নানা বাধ্যবাধকতা পূরণ করতে। দেশে স্ত্রীর ভাইয়ের কাছে অর্থ ঋণ বাড়ছেই। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে হতাশা। বাংলাদেশে স্ত্রী ছিল প্রেমময়ী। তার আনন্দ-বেদনার নিত্য সাথি। এখন শুধুই বেদনার। তার কাছে সংসার এখন তিক্ত করলার রস। তবুও নিয়ম করে দিন চলে যায়, রাত আসে, রাত চলে যায়, দিন আসে। আরিফ আহমেদ এরপর যে কাজ নেন তা আরও কষ্টের। পুরোটাই কায়িক শ্রম এবং সেটাও বেশি সময়ের নয়। তা দিয়ে সংসার খরচের অর্ধেকও হয় না। ছেলে দুজন স্কুলে যাওয়ার আগে টাকা চায় মাঝেমধ্যে। অন্য ছেলে মেয়েদের রেফারেন্স দেয়, তাদের খরচের ফিরিস্তি দেয়। বাবা হয়ে তিনি নীরবে, মাথা-চোখ মেঝের সঙ্গে গেঁথে রাখতেন। ছেলেদের মা ছেলেদের সামনেই তাদের পক্ষ নিয়ে তাঁকে অপমান-অবজ্ঞাসূচক কথায় মুখ ঝামটা দিতেন, যেটা বাংলাদেশে কল্পনাতীত ছিল। আরিফ বাথরুমে জলের কল খুলে দিয়ে হাউমাউ কাঁদতেন।
তখন ভদ্রলোক সিকিউরিটির কাজ করেন। এই কাজ জোটাতেও তাঁকে পয়সা, শ্রম কম খরচ করতে হয়নি! রেজিস্ট্রেশন করিয়ে, ক্লাস করে, পরীক্ষা দিয়ে, স্টেট থেকে সিকিউরিটি লাইসেন্স করিয়ে তারপর চাকরির আবেদন!
তিনি সেসব করে এখন কুইন্স লাইব্রেরির করোনা শাখায় সিকিউরিটির জব করেন। ১৯৯৭ সালে নিউইয়র্ক স্টেটের ন্যূনতম মজুরি $৪.২৫ হিসেবে ৪০ ঘণ্টার পরে ৭/৮ ঘণ্টা ওভারটাইম করে ট্যাক্স কেটে সপ্তাহে $১৭০.০০ ডলারের চেক পেতেন হাতে। সাবলেটে এক ঘরের ভাড়া দিতে হতো মাসে $৮০০.০০ অর্থাৎ সপ্তাহে $২০০.০০। সুতরাং তিনি স্ত্রী-পুত্রদের কোনো শখ আহ্লাদ মেটানো দূরে থাক, একদিনও তাদের নিয়ে বাইরে যেতেন না। কাজের অছিলায় বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়াতেন। একদিন রাতে খাওয়ার সময় ছেলেদের সামনে মাথায় দেওয়ার জন্য নারিকেল তেল আনেননি বলে কি হেনস্তাই না করলেন! ভদ্রলোক এর মধ্যে নানাভাবে তার কোম্পানির আমেরিকার প্রধান কার্যালয় নিউজার্সিতে যোগাযোগ করার অনেক চেষ্টা করেছেন, একবার গিয়ে দেখা করতে সমর্থও হয়েছিলেন। লাভ হয়নি। সরাসরি বলে দিয়েছেন তাঁদের কমিউনিকেশন স্কিলস একেবারেই নেই। তাঁদের দিয়ে কোম্পানির কোনো কাজ হবে না। ভদ্রলোক বুঝে গিয়েছিলেন যা বোঝার। তাই সিকিউরিটির কাজ করতে করতেই ড্রাইভার্স লাইসেন্স, হ্যাক লাইসেন্স করে ফেলে নিয়মিতভাবে ইয়েলো ক্যাব চালানো শুরু করেন। মানতে কষ্ট হতো। আড়ালে চোখের জল ঝরাতেন। কিন্তু যখন দেখলেন আর কোনো আর্থিক সমস্যা হচ্ছে না, দেশেও বাবার কাছে নিয়মিত টাকা পাঠিয়ে তাদের ভালো রাখার ব্যবস্থা করতে পারছেন, তখন থেকে তার মনের মেঘও সরে গিয়ে সেখানে সূর্য হাসে। স্ত্রী আবার গৃহিণী ভূমিকায়। আস্তে আস্তে দেশের ধারের টাকাও শোধ।
দেখতে দেখতে অনেকগুলি বছর। বাবা চলে গেলেন ২০০২-এ, মাকে আনতে চেয়েছিলেন, অনেক বুঝিয়েছিলেন, লাভ হয়নি। মা স্বামীর ভিটা, তাঁর নিজের সংসার ছেড়ে আসতে রাজি হননি। মাকে ভালো রাখতে যত্নের ত্রুটি করেননি। এরপর মা’ও পৃথিবীর মায়া ছাড়লেন ২০০৮ সালে। ছোট ভাই, বোন-বোন জামাই, তাদের ছেলেটাকে নিজেদের কাছে নিয়ে এসেছেন। ভাই আইটি সেক্টরে চাকরি নিয়ে টেক্সাসে সেটেলড্। বোন এখন তার পরিবার নিয়ে নিউজার্সির হোবোকেনে, সুখে আছে।
নিজেরা ভালো আছেন। খুব ভালো আছেন। ছেলে দুটোই যথাসময়ে পড়াশোনা খুব ভালোভাবে শেষ করে বড় ছেলে আমেরিকান এয়ারলাইনসে অ্যাভিয়েশন ইঞ্জিনিয়ার এবং ছোটজন ইন্টার্নশিপ শেষ করে হাউস সার্জন হিসেবে মাউন্ট সাইনাইয়ে কর্মরত। ছোট ছেলের আজ বিশেষ দিন জীবনের। বড় ছেলের এই দিনটি পেরিয়ে গেছে দু’বছর আগে। আয়োজনে কোনো ত্রুটি রাখেননি। আবার বাহুল্য কিছুও হতে দেননি। বরং বাংলাদেশে তাদের দাদু-দাদির নামে ছদকা স্বরূপ নন্দীগ্রামে তাদের নিজ গ্রামে দরিদ্র পিতামাতার দশ জন ছেলেমেয়েকে উচ্চশিক্ষার অসুবিধা দূর করতে প্রতিজনকে নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা করে দিয়েছেন। এই সিদ্ধান্তে তার ছেলেরা, ভাই-বোন খুব খুশি। আজ ছোট ছেলের বিয়ে দিলেন। অনুষ্ঠানাদি শেষ।
অতিথিরা চলে গেছেন। তাঁরাও কিছুক্ষণ আগে বাসায় ফিরেছেন।
ফ্রেশ হয়ে নিজের ঘরের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ভাবছিলেন আজ থেকে পিতা হিসেবে তার দায়িত্ব শেষ করলেন। সফলতার সঙ্গেই পাড়ি দিলেন জীবনের দীর্ঘ পথ । কষ্ট হয়েছে, যন্ত্রণা পেয়েছেন। কিন্তু জীবন তো এমনই। দূর আকাশের চাঁদকে খুব কাছে মনে হলো আজ। ঘরে ফিরে ঘরের চাঁদকে একটা সুন্দর হাসি উপহার দিয়ে বললেন, “চট জলদি রেডি হও, চল লং ড্রাইভে বেরোই।” তিনি বললেন, “তোমার কি মাথা খারাপ? এত ধকলের পর এই রাতে কোথায় বেরোবে?” বললেন বটে, তবে তৈরি হয়ে নিলেন পাঁচ মিনিটে। মার্সিডিজ ছুটে চলেছে এফ,ডি, আর ড্রাইভ ধরে। নদীর এপারে জলের ওপরে দাঁড়িয়ে আছে মোহনীয় রাতের অপ্সরী পৃথিবীর রাজধানী নিউইয়র্ক। সেদিকে এক ঝলক তাকিয়ে আরিফ স্ত্রীকে বললেন, “ওই দেখ, এই সেই নিউইয়র্ক, দূর থেকে যার রূপের প্রেমে মাতাল তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র প্রেমিকেরা দলে দলে পতঙ্গের মতো প্রাণ বলি দিতে ছুটে আসে।” মিসেস আরিফ দূরে আলোর মালা পরা রাতের সুন্দরীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “তা হবে কেন, কে আর মরে বল? তবে ধৈর্য তো ধরতেই হয়! কিছু হারিয়েই তো কিছু পেতে হয়!” আরিফ তর্ক করেন না। মেনে নেন। আর সত্যি তো আজ তার সবচেয়ে আনন্দের দিন। গাড়ি ঘুরিয়ে বলেন, “চল ডিটমার্সের ‘মার্থায় যাই। টগবগে, প্রাণ–প্রাচুর্যে ভরা তরুণ-তরুণীদের সঙ্গে বসে হট কাপাচিনোতে চুমুক দিয়ে উজ্জীবিত হই প্রাণের দিকে। জীবনের দিকে।” মিসেস আরিফ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে বললেন, “বেশ।”