নিজের পাতা ফাঁদে ট্রাম্প

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স

আর্জেন্টিনা থেকে দেশে ফিরে আসতে না আসতেই টুইটে ম্যুলার তদন্তের বিরুদ্ধে সমালোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

গতকাল সোমবার এক টুইটে ট্রাম্প মন্তব্য করেন, ‘তাঁর একসময়ের ডান হাত মাইকেল কোহেনের জেল হওয়াই উচিত। সে একটা মিথ্যাবাদী। মিথ্যা বলার জন্য যতটা শাস্তি প্রাপ্য, তার পুরোটাই কোহেনের হওয়া উচিত।’

কোহেনের ওপর ট্রাম্পের ক্ষিপ্ত হওয়ার কারণ আছে। কোহেন একসময় ট্রাম্পের সব ঘটন-অঘটনের সহচর ছিলেন। তাঁকে অনেক সময় ট্রাম্পের ‘ফিক্সার’ নামেও অভিহিত করা হয়। তিনি আদালতে বলে এসেছেন, মস্কোর সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে কংগ্রেসের কাছে মিথ্যা বলেছেন। কাজটা তিনি বাধ্য হয়েই করেছেন। ট্রাম্প ও তাঁর সহকর্মীরা মস্কোর সঙ্গে ব্যবসার ব্যাপারে বরাবর ‘না না’ বলে এসেছেন। তাই তাঁকেও একই সুরে কথা বলার জন্য মিথ্যা বলতে হয়েছে।

কোহেন আদালতের কাছে অনুরোধ করেছেন, শাস্তি দেওয়ার আগে তাঁর এই কথা যেন মাথায় রাখা হয়।

কোহেনের উকিলেরা অনুরোধ করেছেন, তাঁদের মক্কেল ইতিমধ্যে বিস্তর মানসিক শাস্তি ভোগ করেছেন। সেটাই যথেষ্ট। তাঁকে নতুন করে জেলে পাঠানো ঠিক হবে না।

ট্রাম্পের টুইট এই অনুরোধের জবাবেই লেখা। তাঁকে জড়িয়ে সাক্ষ্য দেওয়ায় তিনি কোহেনকে দুর্বল বলে পরিহাস করেছেন। অন্যদিকে, তিনি বিশেষ কৌঁসুলি রবার্ট ম্যুলারের তদন্তের অপর ‘টার্গেট’ সাবেক সহযোগী রজার স্টোনকে সাহসী বলে প্রশংসা করেছেন।

অভিযোগ রয়েছে, স্টোন ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহচর জেরোম কোর্সি হিলারি ক্লিনটন ও ডেমোক্রেটিক পার্টির জন্য ক্ষতিকর ই–মেইল ফাঁসের ব্যাপারে উইকিলিকসের অ্যাসাঞ্জের সঙ্গে হাত মিলিয়ে একযোগে কাজ করেছেন। তাঁরা দুজনেই ম্যুলারের সঙ্গে সহযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। এই কারণেই স্টোনকে সাহসী বলে বাহবা দিয়েছেন ট্রাম্প।

কিন্তু কাজটা করে নিজের বানানো ফাঁদে নিজেই ফেঁসে যেতে পারেন ট্রাম্প। গতকাল যে টুইট ট্রাম্প করেন, তার ভাষা নিম্নরূপ: ‘(স্টোন বলেছেন) আমি কখনো ট্রাম্পের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেব না। রজার স্টোনের এই কথার অর্থ লাগামছাড়া কৌঁসুলির (ম্যুলার) চাপের মুখে তিনি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ব্যাপারে মিথ্যা বলতে সম্মত হননি। জেনে ভালো লাগছে, এখনো এমন মানুষ আছে, যাদের বুকের পাটা আছে।’

একজন অনুগত মিত্রের সাহসিকতায় আন্তরিকভাবে মুগ্ধ হয়েই হয়তো ট্রাম্প এমন একটি টুইট করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, এমন টুইট পাঠিয়ে তিনি কি একটি সরকারি তদন্তে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করছেন?

ট্রাম্পের অনুগত পরামর্শদাতা কেলিঅ্যান কনওয়ের স্বামী আইনজীবী জর্জ কনওয়ে তেমনটাই মনে করেন। এক টুইটে জর্জ কনওয়ে বলেছেন, রজার স্টোনকে সরকারি তদন্তে সহযোগিতার বিরুদ্ধে উসকে দিয়ে ট্রাম্প যা করছেন, তার আইনি নাম ‘উইটনেস টেম্পারিং’ বা সাক্ষ্যকাজে অনধিকার হস্তক্ষেপ। এটি একটি ফেডারেল অপরাধ।

জর্জ কনওয়ের এই টুইটের জবাবে কিছু লেখেননি ট্রাম্প। তবে ম্যুলারকে শাপান্ত করে একাধিক টুইট করেছেন তিনি। কোনো সন্দেহ নেই, গত এক সপ্তাহে ম্যুলার যেভাবে সন্তর্পণে তাঁর জাল বিছিয়েছেন, তাতে ট্রাম্পের মেজাজ খাট্টা হওয়ারই কথা। মস্কোর সঙ্গে ব্যবসার ব্যাপারটা এত দিন ‘ওপেন সিক্রেট’ হলেও এ নিয়ে কোনো প্রমাণ মেলেনি। কিন্তু কোহেন হাটে হাঁড়ি ভেঙে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত মস্কো টাওয়ার নির্মাণের ব্যাপারে ট্রাম্প ও তাঁর সহকর্মীরা ক্রেমলিনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। অথচ ট্রাম্প নিজে বরাবর বলে এসেছেন, রাশিয়ার সঙ্গে তাঁর কোনো ব্যবসা নেই, কোনো বিনিয়োগ নেই। এই মিথ্যাচার উল্লেখ করে আগামী কংগ্রেসে ডেমোক্র্যাটরা ট্রাম্পকে অভিশংসনের উদ্যোগ নিতে পারেন।

কোহেনের স্বীকারোক্তিটি এসেছে ম্যুলারের কাছে ট্রাম্পের লিখিত প্রশ্নের উত্তর পাঠানোর পর। সম্ভবত, মস্কো টাওয়ারের ব্যাপারে ম্যুলার তাঁকে প্রশ্ন করেছেন। ট্রাম্প যদি সেই লিখিত উত্তরে যথারীতি মিথ্যা বলে থাকেন, তাহলে কোহেনের স্বীকারোক্তির পর তিনি বিপদে পড়তে পারেন। এরই নাম ‘পারজুরি ট্রাপ’ বা মিথ্যাচারের ফাঁদ, যার ভয়ে এত দিন ম্যুলারের সামনে প্রশ্নোত্তরে হাজির হতে ইতস্তত করছিলেন ট্রাম্প।

শুধু কোহেনের মুখের কথা নয়, মস্কোর ব্যাপারে অডিও রেকর্ডিং ও ই–মেইল প্রমাণপত্রও এখন ম্যুলারের থাবায়। বিপদ টের পেয়ে ট্রাম্প এতটাই মুষড়ে পড়েন যে বুয়েনস এইরেসে জি-২০ বৈঠকে পুতিনের সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত একটি বৈঠক তাঁকে বাতিল করতে হয়।

বিপদ এখানেই শেষ নয়। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে ম্যুলার তদন্তে আরও বেশ কিছু ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে, যার অধিকাংশই ট্রাম্পের বিপক্ষে যেতে পারে।

ট্রাম্পের সাবেক ক্যাম্পেইন চেয়ারম্যান পল ম্যানাফোর্ট ম্যুলার তদন্তে রাজসাক্ষী হতে সম্মত হয়েও পরে মিথ্যা বলেছেন। এই কারণে তাঁর বিরুদ্ধে নতুন অভিযোগনামা পেশ করা হবে। এই অভিযোগপত্রে সম্ভবত জানা যাবে, কোন কোন ক্ষেত্রে ম্যানাফোর্ট মিথ্যা বলেছেন, আর সেসব মিথ্যার কোনটির সঙ্গে ট্রাম্প জড়িত।

ট্রাম্পের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাও এফবিআইয়ের কাছে রাশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের প্রশ্নে মিথ্যা বলার কথা স্বীকার করেছেন। ১৮ ডিসেম্বর আদালত জানাবেন, কত দিন তাঁকে জেলের ঘানি টানতে হবে।