ধরাছোঁয়ার নাগালে

দেখতে নাকি মেয়েদের মতো দেখায় আমাকে। মহল্লা আর ক্লাসের বড় ছেলেগুলো ‘মাইয়া পোলা’ বলে ক্ষ্যাপায়। রিকশা গ্যারেজ, দোকানের লোকজন এমনকি মসজিদের হুজুর সুযোগ পেলে গাল টিপে ধরে চুমু মেরে দেয় আড়ালে। সেদিন ফালতু হেলাল পাছা চেপে ধরল। কোলের দিকে নিয়ে ডলে দিল বেশ করে। আমি ঝটকা মারতেই কানের কাছে খসখস করে বলল, ‘আইসক্রিম খাওয়ামু তোরে।’
সেকেন্ড ইয়ারের এক ছাত্রনেতা অনেক দিন ধরে চাচ্ছে আমাকে। ওকে প্রায়ই বলতে শুনি, ‘তুই একটা জোস মাল।’ পাত্তা দিই না দেখে চোখ পাকায়, ‘আমারে কিন্তু দিতে হবে একদিন।’ ‘কী দিতে হবে’, কিছুটা বুঝতে পারি। কলেজে ভর্তি হওয়ার আগে বাসার হুজুর একবার আরবি পড়াতে বসে বুক খামচে ধরে শরীর ঘষতে শুরু করেছিলেন। সেদিন বোন একটা এসে পড়ায় আর কিছু করেননি। তবে আমার মেয়ে-ছেলেমি শরীর হুজুরকে উত্তেজিত করেছিল ভীষণ, সেটা বেশ বুঝতে পেরেছিলাম।
আমার পাঁচ বোন। এর মধ্যে তিনটি দেখতে বেশ কালো। রং ফরসা করার জন্য ওদের চেষ্টা খুব বেশি রকমের। মাসে অন্তত দুবার ত্বক পরিচর্যা আর রূপচর্চার প্রসাধনী আনিয়ে নেয় ওরা আমাকে দিয়ে। এনে দিই হাসিমুখে। ওরা জিনিসগুলোর নাম কাগজে লিখে দেয়। অনেক সময় কসমেটিকসের দোকানে পাওয়া যায় না। তখন দূরের মাল্টি শপে যেতে হয়। বড় মার্কেটগুলোতে গেলে পাওয়া যায়। ওদের গুরুত্বপূর্ণ প্রসাধনী আনতে শহরে চলে যাই। বিরক্তি লাগে না ওদের জিনিস নিয়ে আসতে। সারা বাড়িতে ফরসা রঙের একজনই আছে; আমি। বোনেরা বলে আমার নাকি দুধেকলা গায়ের রং। দেখে নাকি হিংসাই হবে মেয়েদের!
যেকোনো জায়গায় বেড়াতে যেতে আমার আপত্তি না থাকলেও বোনদের আছে। ওরা সবার সঙ্গে মিশতে চায় না আমার মতো। কথাও বলে কম। আত্মীয় বাড়ি ছাড়া অন্য কোথাও বেড়াতে যেতে চায় না। ওদের খুশি বাড়িতে কেউ বেড়াতে এলে। পানিটা এগিয়ে দেবে। বানিয়ে দেবে চা-নাশতা। বাড়িয়ে দেবে পাল্টে ফেলার কাপড়-চোপড়।
দিনকাল বেশ ভালোই কাটছিল আমার। না, ভুল বললাম। আসলে খারাপের দিকেই যাচ্ছিল। কেননা এরই মাঝে একদিন ফালতু হেলালের হাতে ধরা পড়ে গেলাম। হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল সে রুস্তমের গ্যারেজে। ছুটতে পারলাম না কিছুতেই। অন্ধকারে একটা মচমচে চৌকির ওপর ফেলে দিয়ে যা ইচ্ছে করল সে। বুঝলাম না কিছুই। শুধু সিগারেটের গন্ধ ছড়ানো মুখে হিসহিস করছিল, ‘মাইয়া গোত্থন বেশি নরোম রে তুই! তোর ...মারুম।’
জোর জবরদস্তি; মেয়েদের মতো অভিজ্ঞতা নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। আমার ধর্ষণকারী সম্বন্ধে বললাম না কাউকে কিছুই। বললে বিপদে পড়ব। রাস্তাঘাটে হাঁটতে দেবে না!
কিছুদিনের মধ্যে বিপদে পড়ে গেল বোন একটা। কোচিং ক্লাস করতে খুব সকালে একা যাচ্ছিল। পথে ঝাপটা পার্টি ছিনতাই করতে লাগে। কে একজন নাকি যাচ্ছিল সেখান দিয়ে। উদ্ধার করে বাড়ি নিয়ে আসে সে! অবাক হয়ে দেখতে পাই বোনটাকে নিয়ে এসেছে সেই ফালতু হেলাল! বোনদের নিয়ে বড় ধরনের অহংকার ছিল মনে। এর পর থেকে ওদের নিয়ে নিজের চেয়ে বেশি আতঙ্কিত হয়ে উঠি। দেখতে কালো, বিয়ে থা হচ্ছে না একজনেরও।
হঠাৎ এক সন্ধ্যায় পাড়ার মুরব্বিরা আসেন আমাদের বাড়িতে। আমাকে ডেকে পাঠান। ওদের ভয় পাই আমি, বড়দের রাগ আর কথার তেজ সাংঘাতিক! সাধারণত পাড়ার গণ্যমান্যদের সামনে পড়তে চাই না। চারপাশে নারী সমাজ, আর এ কারণে নিজেকে অসহায় একঘরে আরেক ‘মেয়েমানুষ’ই মনে হয় আমার।
সব দোষ চাপিয়ে দেওয়া হলো আমার ওপর।
‘তুই জানিস না? অথচ ওই হেলাল তোর বন্ধু! এমন বন্ধু, যারে সবাই ফালতু বলে, বখাটে বলে...’
বিষয়টা না জানার ভান করতে গিয়ে ধরা পড়ে যাই। কাহিনি গুটিয়ে আনতে চাই।
‘এসব তো আমি কিছুই জানি না!’
‘অবাক হওয়ার ভান করছিস? তোর বোন পালিয়েছে কি-না তোর বন্ধু ফালতু হেলালের সাথে! আবার বলছিস তুই জানিস না?’
কলেজের সেই ছাত্রনেতা পথ আটকে দিল একদিন।
একা ফিরছিলাম। ধরে নিয়ে গেল ক্যাম্পাসের ভাঙাচোরা এক রুমে। বলল, ছাড়ছে না আজ কোনো কিছুতেই। আরও বলল, বাড়িতে ফিরে যেতে হলে ওর কথায় রাজি হওয়া লাগবে। না হলে বোন একটাকে ডেকে নিয়ে আসতে হবে সেখানে। ওর প্রস্তাব মেনে না নিয়ে উপায় থাকল না। ছুরি, পিস্তল সবই রয়েছে দেখলাম ওর। তাই ভাই হয়ে বোনের মান-ইজ্জত বাঁচাতে নিজেরই করতে হলো দেহদান!
বাড়িতে এখন চার বোন। ওদের চেহারা আরেকটু কালো দেখায় আজকাল। পাড়ার বড় ভাইরা অভয় দিয়ে বলে, ‘আমরা আছি না? তোর ভয় কি! তুই তো আবার বিদেশে চলে যেতে পারিস বাবার কাছে, তাই না?’
আমি বলি না কিছু। দেখে উৎসাহ বাড়ে বড় ভাইদের, ‘আচ্ছা একটা কথা বল তো দেখি!’
‘জি কি কথা?’
‘তোর বোনদের বিয়ে দিয়ে দিস না কেন? আমরা তো আছিই!’
কোনোভাবে কেটে গেল আরও কিছু বছর।
বাবার মৃত্যু হলো হজ পালনে গিয়ে, ফিরতি পথে মদিনায় সড়ক দুর্ঘটনায়। মায়ের ধরা পড়ল ক্যানসার।
চার বোনের তিনজন নিল চাকরি। প্রাইভেট স্কুল, এনজিও, আর পরিবার পরিকল্পনা দপ্তরে।
বোনদের জন্য প্রসাধনী সামগ্রী এখন আর এনে দিতে হয় না। ওদেরটা ওরাই জোগাড় করে নেয়। মায়ের ডাক্তার খরচ চালিয়ে যাওয়ার জন্য কি-ই না করতে হয় আমার!
পাড়ার ময় মুরুব্বিরা এ খবর জানার চেষ্টা করে এখনো যে, বোনগুলোর বিয়ে দেওয়া হলো নাকি! অনেক বয়স হয়ে গেছে, তারপরও মা বেঁচে আছেন ক্যানসার শরীরে। তাও আবার একেবারে ব্লাড ক্যানসার! কয় দিন টিকে থাকবেন কে বলতে পারে?
আত্মীয়-স্বজন এখন কেউ আর আসে না। বাড়িটাও খুব সম্ভব বিক্রি করে দিতে হবে আমাকে। মায়ের জন্য উন্নত সেবা-শুশ্রূষা দরকার। বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে কোথায় যাব জানি না।
ছোট যে বোন চলে গিয়েছিল ওকে দেখতে যাই মাঝে মাঝে লুকিয়ে, যাতে অন্য বোনেরা জানতে না পারে। পালিয়ে বিয়ে করেছে বলে কোনো দুঃখ আছে কিনা ওর, বুঝি না। অনেক কথার পর বোনটা যেন সান্ত্বনা দেয় আমাকে, ‘ভাই রে আমার তো একটা সংসার হয়েছে তাই না?’
আমি বলতে চাই, ‘তাই বলে ওই বখাটেকে নিয়ে!’ বলতে পারি না।
মিনমিন করে বলি, ‘তোর বড় আরও তিনটার কি হবে, একবার চিন্তা করেছিলি?’
‘ওদেরও এই করতে হবে আমার মতো। বুঝতে পারছিস?’
‘বুঝতে পারছি না। কেন!’
‘তুই তো ফরসা, বুঝবি কেমন করে! তোর ওই কালো কালো চেহারার বোনগুলোকে কে আসছে বিয়ে করে নিয়ে যেতে?’
আগে ঘুমাতাম বোনদের সঙ্গে। আজকাল রাতে একাই ঘুমাই। তবে ঘুম আসে না। সজাগ থেকে রাত কাটাই। মাঝ রাতের পরে আর খাটে শুয়ে থাকতে পারি না। অস্বস্তি লাগে। একাকী লাগে। যেন ভয় দেখাতে আসে একা এই রাত।
মধ্যরাতে বাইরে বেরিয়ে এসে আকাশের নিচে দাঁড়াই। ওপরে তাকাই, অনেক ওপরে। দেখা যায় নাকি কাউকে, যে কি না সৃষ্টি করে সবকিছুকে! কাউকে কালো আর কাউকে সাদা করে। কাউকে সবকিছু দিয়ে, আর কাউকে কোনো কিছু না দিয়ে।
আমি খালি চোখে সৌরজগতটাকে দেখতে পাই। গ্রহ-তারা সব নেমে আসে হাতের নাগালে। দূর আকাশের সবকিছুই জানা হয়ে যায় আমার। পুরো নাড়িনক্ষত্র। একা এক রাতের আকাশ দর্শনে। শুধু জীবন আসে না ধরাছোঁয়ার নাগালে।